হোয়াটমোরও দেখলেন বাংলাদেশ প্রস্তুত by নোমান মোহাম্মদ

ইউরোপিয়ান ফুটবলে এমনটা দেখা যায় হরহামেশা। নরউইচ-সান্ডারল্যান্ডের 'ছোট' ম্যাচ দেখার জন্য গ্যালারিতে হয়তো স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন। কিংবা গ্রেনাদা-লেভান্তে ম্যাচের আপাতনিরীহ দর্শক হোসে মরিনহো। নিছক খেলা দেখার জন্য আসেন না তাঁরা।


হয়তো ম্যানইউর পরের ম্যাচ নরউইচের সঙ্গে কিংবা রিয়াল মাদ্রিদ খেলবে লেভান্তের বিপক্ষে। প্রতিপক্ষের শক্তি-দুর্বলতা তাই আগাম আঁচের চেষ্টা ফার্গুসন-মরিনহোদের।
ক্রিকেট-সংস্কৃতির খুব প্রচলিত ধারা নয় এটি। ব্যতিক্রম হয়ে কাল কলম্বোর কোল্টস ক্রিকেট মাঠে চলে এলেন ডেভ হোয়াটমোর। সেই সাতসকালে। পাকিস্তান জাতীয় দলের কোচ শ্যেনদৃষ্টিতে পরখ করলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের। ২৫ সেপ্টেম্বর টোয়েন্টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে মুখোমুখি হবে হোয়াটমোরের সাবেক ও বর্তমান দল।
সে জন্যই তাঁর এই হোমওয়ার্ক। এই বাংলাদেশকে হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগই যে নেই আর!
কালকের প্র্যাকটিস ম্যাচে সেটি আরেকবার মনে করিয়ে দিলেন আশরাফুল-সাকিবরা। জিম্বাবুয়ের করা ১৩৪ রান তারা টপকেছে অনায়াস স্বাচ্ছন্দ্যে। ১০ বল ও ৫ উইকেট হাতে রেখেই। তবুও ম্যাচ শেষে দলের প্রতিনিধি হয়ে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে আসা আশরাফুলের আক্ষেপ, জয়টা আরো সহজে হতে পারত। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশের পারফরম্যান্সের রাজসিকতা তাতেই উদ্ভাসিত। পরোক্ষে মূল টুর্নামেন্টের প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড-পাকিস্তানকে দেওয়া হুঙ্কারও। হাফ প্যান্ট-গেঞ্জির ঘরোয়া পোশাকে মাঠে আসা গুফো হোয়াটমোর কি খেলা শেষে কপালে কয়েকটা ভাঁজ বাড়িয়ে নিয়েই ফিরলেন না?
পায়ের তলায় খড়ম পরে পর্যটকের মতো পুরো দুনিয়াই প্রায় ঘুরে ফেলল বাংলাদেশ। এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রস্তুতির জন্য। রূপকথার মতো এশিয়া কাপের পর থেকেই এর শুরু। জিম্বাবুয়েতে গিয়ে ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্ট, এরপর আয়ারল্যান্ড-নেদারল্যান্ডস সফর, তারপর ভূ-গোলকের অন্য প্রান্তে ক্যারিবীয় দ্বীপ ত্রিনিদাদ হয়ে এই শ্রীলঙ্কায়। ক্যারিবিয়ান সফরের পর আর দেশে ফেরেনি রিচার্ড পাইবাসের দল। ১২ তারিখ এই দ্বীপে পা রাখার পর পরশু ঘণ্টা তিনেকের অনুশীলন। আর কাল প্র্যাকটিস ম্যাচে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি সেরে নেওয়া। আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে কাল আরেকটি প্রস্তুতি ম্যাচের পরই মূল পর্বের চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ নেওয়ার জন্য বাংলাদেশের যে পূর্ণ প্রস্তুতি আছে, এই ঘোষণার প্রতিফলন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে জয়ে।
সকালে টস জিতে আগে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন মুশফিকুর রহিম। বদলে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় থাকা লঙ্কান উইকেটে স্পিনাররা কতটা কী করতে পারবেন, এ নিয়ে শঙ্কা ছিল। সাকিব-রাজ্জাক-সানি-মাহমুদ উল্লাহরা সেটি দূর করে দিয়েছেন। ২০ ওভারের মধ্যে ১৫ ওভারই তাদের। ৬ উইকেটে ১৩৪ রানের বেশি তাই যেতে পারেনি জিম্বাবুয়ে। ক্ষুরধার বোলিংয়ের পাশাপাশি ক্ষীপ্রগতির ফিল্ডিংও ছিল চোখে পড়ার মতো। লং অফ ও লং অনে মাশরাফি-তামিমের দুটি ক্যাচ যার হাইলাইটস।
ব্যাটিংয়ে নেমে ব্রায়ান ভিটোরিকে পুল করতে গিয়ে তামিম ইকবাল (৫) আউট হন দ্বিতীয় ওভারেই। এরপর আশরাফুল-সাকিবের অসাধারণ এক জুটি। উইকেটে দুই পাশে পেসার-স্পিনার সবাইকে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন তাণ্ডবলীলায়। ৫ বাউন্ডারিতে ১৭ বলে ২৮ করা সাকিব মিড উইকেট বাউন্ডারিতে ক্যাচ দিলে ভাঙে ৩২ বলে ৫২ রানের জুটি। সাকিবকে আউট করায় রেমন্ড প্রাইসের ওপর একটু তেতে ছিলেন হয়তো আশরাফুল। ওই ওভারেই পর পর দুই বলে মারেন দুই ছক্কা। প্রথমটি সোজা, পরেরটি মিড অফের ওপর দিয়ে। তবে ভালো শুরুর পর গুলিয়ে ফেলার রোগটা কালও এড়াতে পারলেন না আশরাফুল। ২৫ বলে দুই বাউন্ডারি ও তিন ছক্কায় ৩৮ রান করার পর হয়ে যান আউট। মুশফিক (৩), নাসির (১) চটজলদি প্যাভিলিয়নে ফিরলে খানিকটা থমকে যায় বাংলাদেশ। তবে মাহমুদ উল্লাহ (২৩*) ও জিয়াউর রহমানের (২৬*) অবিচ্ছিন্ন জুটি জয়ের বন্দরে নিয়ে যায় পাইবাসের দলকে। তিন ওভারে যখন ২০ রান প্রয়োজন, তখন জিয়াউরের দুটি ছক্কা দূর করে দেয় ফল নিয়ে অনিশ্চয়তা। খেলা দেখতে বাংলাদেশ থেকে উড়ে আসা মুশফিকুর রহিমের বাবা ও দুই চাচার চোখে-মুখে তখন শিশুর মতো আনন্দ। কণ্ঠে বিজয়ীর উচ্ছ্বাস।
উল্লাস আছে বাংলাদেশ ক্যাম্পেও, তবে মাঝে দ্রুত কয়েকটি উইকেট পড়ার আক্ষেপও সঙ্গী। আশরাফুলের কণ্ঠে তারই প্রতিফলন, 'আমার আর সাকিবের ওই জুটির পর আমরা আরো সহজে জিততে পারতাম। তার পরও জিয়া ও মাহমুদ উল্লাহ যেভাবে শেষ করেছে, সেটি খুব ইতিবাচক।' নিজে বড় ইনিংস না পাওয়ায় খানিকটা হতাশ। সঙ্গে ধারাবাহিকতার কারণে উল্লসিত, 'জিম্বাবুয়ে থেকেই আমি ভালো খেলছি। সর্বশেষ ১২ ইনিংসের মধ্যে ৬-৭টা ইনিংসে গিয়েছি ৩০-এর ঘরে। এরপর সেটিকে বড় রানে পরিণত করতে না পারার হতাশা তো আছেই। আশা করি যেকোনো সময় সেটি চলে আসবে। হয়তো মূল টুর্নামেন্টেই।' ধারাবাহিকতার সঙ্গে চিরবৈরিতা যাঁর, সেই আশরাফুলের এমন ধারাবাহিকতা ওপেনার হয়ে যাওয়ার পর। ভবিষ্যতে সব ধরনের ক্রিকেটেই এই ভূমিকায় নামার ইচ্ছে তাঁর, 'গত বছর ঘরোয়া সব ধরনের ক্রিকেটেই আমি ওপেনার হিসেবে খেলেছি। আমার মনে হয়, এখানে খেললে ইনিংসের পরিকল্পনা করা যায় ভালোমতো। আর নতুন বলে আমি বরাবরই তো ভালো খেলি। সামনে সব ধরনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ওপেনার হিসেবে খেলা যায় কি না, কোচের সঙ্গে কথা বলব।'
সেটি ভবিষ্যতের কথা। আশরাফুল ও বাংলাদেশের কাছে এখন মূর্তিমান বর্তমান হয়ে আছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। সেখানে যে মূর্তিমান আতঙ্ক হতে পারেন সাকিব-তামিম-আশরাফুল-মুশফিকরা, ডেভ হোয়াটমোর অন্তত কাল সেটি জেনে গেছেন!

No comments

Powered by Blogger.