সময়চিত্র- আমাদের রোল মডেল কে? by আসিফ নজরুল

প্রতিটি গর্বিত জাতির রোল মডেল থাকে। রোল মডেলদের দেখে তরুণ প্রজন্ম অনুপ্রাণিত হয়, রোল মডেলদের কর্ম ও অবদান আলোকবর্তিকার মতো থাকে তাঁদের সামনে। রোল মডেল সমসাময়িকও হতে পারেন। এই যেমন বাংলাদেশে এখনকার নারীদের রোল মডেল হতে পারেন সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, নিশাত মজুমদার বা সদ্য এসএসসি পাস করা জুঁই নামের তরুণীটি।


আরও ব্যাপক অর্থে আমাদের রোল মডেল হতে পারেন বাংলাদেশের প্রথম ও একমাত্র নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি শুধু নোবেলজয়ী নন, তাঁর চিন্তা, পরিকল্পনা ও উদ্ভাবন অর্ধশতাধিক দেশ অনুসরণ করছে। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাঁকে অধ্যয়নের জন্য বিভিন্ন সেন্টার বা ডিপার্টমেন্ট খুলছে। অন্য অনেক নোবেলজয়ীর চেয়ে তাঁর স্থান ইতিমধ্যে অনেক ওপরে চলে গেছে। তাঁর সামাজিক ব্যবসার মডেল যদি সফল হয়, তিনি তাহলে আরেকটি নোবেল পেতে পারেন, এমন ধারণাও করা হচ্ছে এখন। ড. ইউনূসের কারণে এ দেশের কৃষকেরা মহাজনী ঋণের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন, নারীরা স্বাবলম্বী হয়েছেন এবং সমাজে সাম্প্রদায়িকতা ও কূপমণ্ডূকতা বহুলাংশে রোধ করা গেছে।
তিনি তাই বিনা দ্বিধায় আমাদের রোল মডেল হতে পারতেন। হতেনও, যদি না আমাদের রাজনীতি এমন সর্বগ্রাসী হয়ে উঠত। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতাদের কাছে তিনি রোল মডেল নন। তাঁদের মতে, তিনি বরং বর্জনীয়, নিন্দনীয় ও সর্বনাশা একজন ব্যক্তি! আমাদের এমনকি এ-ও শুনতে হয়েছিল যে পদ্মা সেতুর ঋণ বাতিল হয়েছে, তার কারণ আবুল হোসেন না, তার কারণ ড. ইউনূস!
এখন অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকারের কাছে রোল মডেল হচ্ছে সৈয়দ আবুল হোসেনের মতো ব্যক্তিরাই। নির্দিষ্ট করে বললে আবুল হোসেনই। তাঁকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দুর্নীতিমুক্ত বলে সার্টিফিকেট দিয়েছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাঁকে প্রকৃত দেশপ্রেমিক বলে আখ্যায়িত করেছেন। দুই তুখোড় রাজনীতিবিদ মন্ত্রীর (ওবায়দুল কাদের ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত) দায়িত্ব তিনি একসময় একা পালন করেছেন। পরে তাঁকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়ার পর এর মর্যাদা বাড়ানোর জন্য টেলিযোগাযোগের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি খাতকে এর সঙ্গে যুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তিনি নিশ্চয়ই অত্যন্ত যোগ্য ও দক্ষ বলেই এসব করা হয়েছে। সৎ, দেশপ্রেমিক ও সুযোগ্য এ ব্যক্তিটি কি আমাদের রোল মডেল হতে পারেন না? আমাদের তরুণসমাজে কি তাঁর জীবন ও আদর্শে দীক্ষিত হতে পারেন না?
হয়তো পারেন। তবে যদি কেউ আবুল হোসেনের মতো হতে চান, তাঁকে অবশ্যই ড. ইউনূসকে বর্জন করতে হবে। তাঁর বিরুদ্ধে শুধু যে রাজনীতিকেরা বলেন, তা নয়, তাঁর ওপর রাগ রয়েছে এ দেশের বিভিন্ন পেশার মানুষেরও। আমি আমার ব্যক্তিগত জীবন থেকে তিনটি উদাহরণ দিয়ে কেন ড. ইউনূস বর্জনীয় আর কেন আবুল গ্রহণীয় হওয়া উচিত, সেই আলোচনা করব!

দুই.
ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে প্রচারণা তুঙ্গে তখন। তাঁকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে সরানোর নোটিশ এসেছে। বিষয়টি বিচারাধীন বলে তিনি তখনো গ্রামীণের অফিসে আসছেন। বিষাদগ্রস্ত নোবেলে লরিয়েটের সঙ্গে একটি মিটিং শেষ করে আমি গ্রামীণের অফিসের নিচে নেমেছি গাড়িতে ওঠার জন্য। আমার ড্রাইভার আড়চোখে ড. ইউনূসকে দেখেন, গাড়িতে ওঠার পর আমাকে জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হন। তারপর গ্রামীণের অফিস থেকে বের হওয়ামাত্র ফোঁস করে নিশ্বাস ছেড়ে বলেন, ‘হেতে লোক ভালো না!’ কেন ভালো না? দীর্ঘ আলাপচারিতায় জানা গেল, অন্য কয়েকজনের সঙ্গে আমার ড্রাইভারও গ্রামীণ থেকে ঋণ নিয়েছিলেন ‘বাড়ির কাজবাজ’ করার জন্য। তিনি বার কয়েক নির্দিষ্ট তারিখে ঋণের টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হন। পরে এই টাকা দিতেই হবে বুঝতে পেরে তাঁর এক ভাতিজার কাছ থেকে টাকা নিয়ে তা পরিশোধ করেন। তাঁর ক্ষোভ, ‘হেগো টাকা নিলে কোনো মাফ নাই!’ আমার ড্রাইভার আমার থেকে প্রায়ই ঋণ নেন, মাঝেমধ্যে ঠিক সময়ে পরিশোধ করতে পারেন না। আমি কখনো কখনো অল্প টাকা হলে তাঁকে ‘মাফ’ও করে দিই। অথচ গ্রামীণের কাছে কোনো মাফ নেই! আমি তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, মাফ করে দিলে গ্রামীণের অফিসের খরচ আসবে কোত্থেকে? বহু লোক এ রকম মাফ চাইলে অন্যদের ঋণ দেবে কোত্থেকে? তা ছাড়া ব্যক্তিঋণ মাফ করা যায়, প্রতিষ্ঠান তা করতে পারে না। সে আমাকে অম্লান বদলে বলে, ‘সরকারেও তো তারে খারাপ কয়!’
ড. ইউনূস তাই খারাপ! ঋণ পরিশোধে অনিচ্ছুকদের কাছে তিনি রোল মডেল হতেই পারেন না। কিন্তু দেশের শিক্ষিত সমাজের কী অবস্থা? আমি লক্ষ করলাম, সে সময় দেশের একটি পত্রিকায় তাঁর বিরুদ্ধে অশালীন, অসত্য ও অরুচিকর প্রচারণা চলছে প্রতিদিন। পত্রিকার সম্পাদক আমার পরিচিত, আমি তাঁকে ড. ইউনূসের একজন গুণমুদ্ধ হিসেবে জানতাম। একটি অনুষ্ঠানে আমার পাশে তিনি খেতে বসেছেন। নানা তর্কবিতর্ক চলল ড. ইউনূসকে নিয়ে। আমি কিছুতেই তাঁর বিরাগের কারণ বুঝতে পারছি না। একপর্যায়ে ক্ষুদ্ধ তিনি স্বগতোক্তির মতো করে বলেন, ‘নোবেল পেয়ে মাথায় ওঠে গেছে, আমার রিপোর্টার দিনের পর দিন ঘুরেছে, আমাদের স্বাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় নেই তার। তারে আমি কি করি দেখেন না!’
যতই এলেবেলে পত্রিকা হোক, ড. ইউনূস যতই ব্যস্ত থাকুন, তাঁর যদি সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় না থাকে, তাহলে তো তিনি সাংঘাতিক অপরাধী! কাজেই সেই পত্রিকার কাছে এমনকি তাঁর কিছু পাঠকের কাছেও হয়তো তিনি খুব খারাপ একজন ব্যক্তি। আমার তাতে আপত্তি নেই। বিষয়টি ভুলে যাই পরে। এই মাত্র সেদিন একটি জনপ্রিয় টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানে গিয়ে আমার চৈতন্যোদয় ঘটে। অনুষ্ঠানটি ড. ইউনূসের সামাজিক ব্যবসাবিষয়ক সেমিনারের মাত্র কয়েক দিন পরে। বিখ্যাত একজন ব্যক্তি ডিনারের টেবিলে ড. ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংকের সমালোচনা শুরু করেন এই বলে যে ‘এর সুদের হার অন্যান্য কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ে বেশি।’ আমি বললাম, অবশ্যই যৌক্তিক তা। কারণ, গ্রামীণ ব্যাংক কোনো কোলেটারাল ছাড়া ঋণ দেয় বলে এর ঝুঁকি বেশি এবং অনেক বিস্তৃত অবকাঠামো বলে এর খরচও বেশি। আমি তাঁকে বললাম, গ্রামীণ ব্যাংকের সুদের হার মহাজনী ঋণ থেকে বহু গুণে কম। গ্রামীণ ব্যাংক আছে বলে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে কৃষককে আত্মহত্যা করতে হয় না, আর ভারতে মহাজনী ঋণ আছে বলে লাখ লাখ কৃষক আত্মহত্যা করেন। তিনি কাঁচা যুক্তি দিয়ে আরও কিছুক্ষণ তর্ক করে ক্ষান্ত দেন। চলে আসার সময় আমার কানের কাছে মুখ এনে তিনি বলেন, ‘তবে যা-ই বলেন, তাঁর মন খুবই ছোট!’ আমি বলি, সেটা ঠিক কি না, আমি জানি না। কিন্তু তাঁর কীর্তি অনেক বড়। তিনি তাতেই উৎসাহ পান। আমাকে নিম্নকণ্ঠে জানান, গত পাঁচ বছর ধরে তিনি ম্যাগসাইসাই পুরস্কার পাবেন বলে শুনছেন। ড. ইউনূস একটু বললেই হয়ে যায়!
ড. ইউনূস তাঁকে ম্যাগসাইসাই পুরস্কার দিতে সুপারিশ করেননি! কাজেই তাঁকে ছি ছি! তিনি যদি কাউকে নোবেল পুরস্কার দিতে সুপারিশ না করেন, তাহলে আরও বড় ছি ছি! এই ছি ছি-ওয়ালা বা তাঁদের সুবিধাভোগী বা অনুসারীদের কাছে তিনি কখনো রোল মডেল হতে পারেন না।

তিন.
ভাগ্য ভালো, আমার জীবনে এসব ঘটনা ঘটেছে। আমি বুঝি সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশকে সুউচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করলেই এই জাতির কারও কারও কাছে রোল মডেল হওয়া যায় না। তিনি ঋণ মাফ করবেন না, চাহিবামাত্র সাক্ষাৎকার দেবেন না, অন্যদের নোবেল বা ম্যাগসাইসাই পাওয়ার ব্যবস্থা না করে নিজেই পাবেন—এসব কেমন কথা!
আবুল হোসেনেরা এসব করেন না। তাঁরা কাউকে ঋণই দেন না। তাঁরা সাক্ষাৎকার তো দেনই, বিজ্ঞাপন দিয়েও জানিয়ে দেন নিজের কীর্তিগাথা। তাঁরা কাউকে নোবেল পাইয়ে দিতে পারেন না বলে নিজে কোনো নোবেল পুরস্কার পান না, পাবেনও না। কাজেই আবুল হোসেনদেরই রোল মডেল হওয়া উচিত এই জাতির কারও কারও কাছে। এই সংগ্রামী নেতার গায়ে কালিমা লাগানোর খেসারত হিসেবে জীবন দিতে হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রকে, নিম্ন বেতনের ছা-পোষা মানুষকে চাঁদা দিতে হয়েছে সেতু নির্মাণের। আর কে জানে, গোটা জাতিকেও হয়তো দিতে হতে পারে বিভিন্ন ধরনের সারচার্জ! তিনি দক্ষ, তিনি সৎ, তিনি খাঁটি দেশপ্রেমিক, তিনি জনপ্রিয়ও। তিনিই রোল মডেল হতে পারেন এ দেশের তরুণসমাজের কাছে!
তবে এ জন্য তাঁকে ক্ষুদ্র একটি কাজ করতে হবে। মন্ত্রিত্বের অবসরে তাঁকে একটি আত্মজীবনী লিখতে হবে। সেখানে তাঁকে অকপটে বলতে হবে, কেমন একজন সাধারণ কর্মচারী থেকে তিনি অল্পসময়ে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন, মন্ত্রী হয়েছেন, দেশপ্রেমিক হয়েছেন। স্যামসন এইচ চৌধুরী বা সৈয়দ মনজুর এলাহী যদি আমাদের তাঁদের ব্যবসায়িক উত্থানের বৃত্তান্ত সবিস্তারে জানাতে পারেন, তাঁরও তা পারা উচিত।
আবুল হোসেনের অকপট আত্মজীবনীই হতে পারে এ দেশের তরুণ প্রজন্মের জন্য চরম শিক্ষণীয় একটি বিষয়! তিনিই তাহলে হতে পারেন সর্বজনীন রোল মডেল। তিনি কি লিখবেন এমন একটি আত্মজীবনী!
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.