গ্রামীণ ব্যাংক ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র গভীর উদ্বিগ্ন

গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ সংশোধনের উদ্যোগে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। গতকাল রবিবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র প্যাট্রিক ভেনট্রেল এক বিবৃতিতে এ উদ্বেগের কথা জানান। এর আগে গত শনিবার প্রায় অভিন্ন এক বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের সিনেটর বারবারা বক্সার গভীর হতাশা প্রকাশের পাশাপাশি গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় 'হস্তক্ষেপ' না করতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আরমযান জানিয়েছিলেন।


যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বিবৃতিতে বলা হয়, 'বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি গ্রামীণ ব্যাংকে তাদের (বাংলাদেশ সরকার) নির্বাচিত চেয়ারম্যানের মাধ্যমে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের যে উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে তাতে যুক্তরাষ্ট্র গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।'
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিবৃতি অনুযায়ী, ওই দেশটি মনে করে, বাংলাদেশ সরকারের এই উদ্যোগে বাংলাদেশ ও বিশ্বে সুপরিচিত এ ব্যাংকটির কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটবে। বিবৃতিতে আরো বলা হয়, 'গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটে এমন কোনো উদ্যোগ না নিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন গত মে মাসে ঢাকা সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। সরকারের নেওয়া সাম্প্রতিক উদ্যোগের ফলে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রতিষ্ঠিত এ ব্যাংকটির কার্যক্রম হুমকির মুখে পড়বে বলে আমরা উদ্বিগ্ন।'
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর বলেছে, 'গ্রামীণ ব্যাংকের স্বাধীনতা, সুষ্ঠু কার্যক্রম ও গুরুত্বের প্রতি সম্মান দেখাতে আমরা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই।' দেশটি গ্রামীণ ব্যাংকের নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতেও বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র চায়, এমন একজন যোগ্য ব্যক্তিকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে নিয়োগ করা হবে, গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতি যার আন্তরিকতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই এবং যিনি উন্নয়নের মাধ্যমে ব্যাংকটির ৮৩ লাখ গ্রাহকের আশা বাঁচিয়ে রাখতে পারবেন।
গত শনিবার যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর বারবারা বক্সার এক বিবৃতিতে বলেন, 'গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণ আরোপের প্রচেষ্টায় আমি খুব হতাশ।' তিনি বলেন, 'ওই উদ্যোগ বাংলাদেশের লাখ লাখ নারীর দারিদ্র্যবিমোচন প্রচেষ্টার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংক যাতে দরিদ্র পরিবারগুলোকে ব্যবসা শুরুতে সহায়তার গুরুদায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখতে পারে সেজন্য ব্যাংকের নেতৃত্ব সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব এর পরিচালনা পর্ষদের হাতেই থাকা উচিত।'
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের গতকালের বিবৃতিকে গ্রামীণ ব্যাংক ইস্যুতে দুই দেশের সম্পর্কে ফের টানাপড়েন হিসেবে দেখছেন কূটনীতিকরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কূটনীতিক গতকাল রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানা নিয়ে একটি ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। অনেকে মনে করেন, এটা ইউনূস সাহেবের (ড. মুহাম্মদ ইউনূস) ব্যাংক। এ ব্যাপারে বিদেশে জোরালো প্রচারণাও চালানো হয়। কিন্তু এটি বাংলাদেশ সরকারের প্রণয়ন করা আইনে চলছে।'
উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার মন্ত্রিসভা 'গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ (সংশোধন) ২০১২'-এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়। এর মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংকে চেয়ারম্যানের কর্তৃত্ব বাড়ানো হয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের বর্তমান পদ্ধতি হলো সিলেকশন বোর্ড। খসড়া আইনে সেটি সংশোধন করে বলা হয়েছে, এখন থেকে গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান সিলেকশন বোর্ডের সঙ্গে পরামর্শ করে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগ করবেন।
সরকারের পক্ষ থেকে একজন প্রতিনিধিকে গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
সিনেটর বারবারা যুক্তি দেখিয়ে বলেছেন, গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে শেয়ার গ্রাহকদের দ্বারা নির্বাচিত ৯ জন নারী প্রতিনিধি রয়েছেন। স্থায়ীভাবে কাউকে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষমতা তাঁদের কাছেই থাকা উচিত।
এর আগে গত ২৭ জুন বারবারা বক্সারের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র সিনেটের ১৭ জন নারী সদস্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লেখা এক চিঠিতে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের ক্ষমতা ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদের কাছে দেওয়ার আহ্বান জানান।
নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে অপসারণ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের টানাপড়েন শুরু হয়। এ ইস্যুতে উদ্বেগ ও যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রত্যাশার কথা জানাতে গত বছরের শুরুর দিকে ঢাকা সফর করেন দেশটির দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ও'ব্লেক জুনিয়র। ইউনূস ইস্যুর সম্মানজনক সমাধান না হলে ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কে কালো ছায়া পড়বে এবং সমাধান হলে হিলারিকে ঢাকা সফরে আসতে রাজি করাতে উৎসাহবোধ করবেন বলেও তখন সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছিলেন ব্লেক। কিন্তু এরপরও বাংলাদেশ অনড় থাকায় দৃশ্যত গ্রামীণ ব্যাংকের সক্রিয় কার্যক্রম অব্যাহত রাখার ওপরই জোর দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। গত মে মাসে হিলারি ঢাকা সফরে এলেও দৃশ্যত তাঁর সরকারি কার্যক্রম ছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কেই ঘিরে।
এরপরও গত ১৯ জুলাই কংগ্রেসের এক শুনানিতে সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ও'ব্লেক জুনিয়র বলেছেন, গ্রামীণ ব্যাংক ভালো কাজ করে চলেছে। তিনি আরো বলেন, গ্রামীণ ব্যাংকের সক্রিয় কার্যক্রম ও গুরুত্ব অব্যাহত রাখতে ড. ইউনূসের এমন একজন যোগ্য উত্তরসূরি নির্বাচনের ওপর যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্ব দিচ্ছে, যা বাংলাদেশ সরকার ও গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ- উভয় পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।
ড. ইউনূস ৬০ বছরের বয়সসীমা অতিক্রমের পর ৭১ বছর বয়স পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর ওই বর্ধিত সময়ে দায়িত্বে থাকা বৈধ ছিল কি না, তিনি সে সময় ব্যাংক থেকে বেতন-ভাতা বাবদ কত টাকা নিয়েছেন এবং ওই অর্থ নেওয়া বৈধ ছিল কি না- এসব বিষয় খতিয়ে দেখতে গত বৃহস্পতিবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছেন।
পাশাপাশি গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি থাকাকালে ড. ইউনূস ওয়েজ আর্নার হিসেবে কত টাকা বিদেশ থেকে এনেছেন এবং তিনি তা আনতে পারেন কি না, আর এনে থাকলে কর অব্যাহতি নিয়েছিলেন কি না- সেসব বিষয়েও একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করে শিগগিরই মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থাপনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর)।
মন্ত্রিসভার বৈঠকের ওই সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনার পর ড. ইউনূস এক বিবৃতিতে গ্রামীণ ব্যাংক রক্ষায় দেশবাসীকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। এরপর গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর নতুন করে উদ্বেগের কথা জানাল।

No comments

Powered by Blogger.