গণতন্ত্র ও সামাজিক ন্যায়বিচারের অভাবে উগ্রবাদ জন্ম নেয়-৬৩ দেশের প্রতিনিধির অংশগ্রহণে আন্তর্জাতিক সম্মেলন উদ্বোধনীতে প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি এবং সামাজিক নিরাপত্তার অভাব থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ সরকারবিরোধী গণবিক্ষোভের পথ বেছে নিচ্ছে। এতে টেকসই গণতন্ত্র ব্যাহত হচ্ছে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সৃষ্টি হচ্ছে গণজাগরণ। তাই শান্তি ও উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্রের কোন বিকল্প নেই।
গণতন্ত্র এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত না হলে সমাজে দারিদ্র্য, অসাম্য, বঞ্চনা এবং প্রান্তিকীকরণ বৃদ্ধি পায়। শেষ পর্যন্ত এগুলো উগ্রবাদ এবং সন্ত্রাসবাদের জন্ম দেয়।
বিশ্বের ৬৩টি দেশের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে রবিবার সকাল থেকে রাজধানীর রূপসী বাংলায় শুরু হওয়া ‘জনগণের ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। ‘টেকসই’ শান্তির জন্য ন্যায়বিচারকে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, আমি মনে করি টেকসই শান্তির জন্য ন্যায়বিচার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটা তখনই অর্জন সম্ভব হবে যখন ক্ষমতায়নের মাধ্যমে জনগণকে অর্থপূর্ণ উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা সম্ভব হবে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী জনগণের ক্ষমতায়নের জন্য দারিদ্র্য ও ক্ষুধা বিমোচন, বৈষম্য দূরীকরণ, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর মাধ্যমে বঞ্চনার অবসান, সবার জন্য কর্মসংস্থান, সকলের অধিকতর অংশগ্রহণ, টেকসই এবং সমতাভিত্তিক প্রবৃদ্ধি ও মানবসম্পদ উন্নয়ন জোরদারকরণ এবং উগ্রবাদ এবং সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি, এসব বিষয় পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত এবং প্রণোদনামূলক।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির সভাপতিত্বে দু’দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক এ সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন পররাষ্ট্র সচিব মিজারুল কায়েস। অন্যদের মধ্যে নেপালের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী নারায়ণ কাজি শ্রেষ্ঠ, শ্রীলঙ্কার পররাষ্ট্রমন্ত্রী জি এল পেইরিস, ভারতের পল্লী উন্নয়নমন্ত্রী জয়রাম রমেশ, ভুটানের পূর্তমন্ত্রী লিওনপো জেশি জিমবা, মালদ্বীপের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী আলী হামিদ, জাতিসংঘের আন্ডারসেক্রেটারি জেনারেল জন ক্লস এবং ইউনেস্কোর উপ-মহাপরিচালক গিটাশিউ এনিডা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।
সম্মেলনে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোর প্রতিনিধি এবং ঢাকা ও নয়াদিল্লীর বিভিন্ন জাতিসংঘ সংস্থা ও ডিপ্লোম্যাটিক মিশনের প্রতিনিধিরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। আন্তর্জাতিক এই সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, জাপানের মতো পরাক্রমশালী দেশসহ জাতিসংঘের মোট ৬৩টি সদস্য দেশের ৮০ প্রতিনিধি ছাড়াও জাতিসংঘের দু’জন আন্ডারসেক্রেটারি জেনারেল, পরিচালকসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের ৬৬তম সাধারণ অধিবেশনে শান্তি, ন্যায়বিচার ও উন্নয়নের জন্য জনগণের ক্ষমতায়ন শীর্ষক তাঁর উত্থাপিত মডেল আন্তরিকভাবে গ্রহণ করায় সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে ধন্যবাদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, “আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে, শান্তি, ন্যায়বিচার ও উন্নয়নের জন্য ‘জনগণের ক্ষমতায়ন’ সম্পর্কিত যে মডেল আমি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৬তম অধিবেশনে উপস্থাপন করেছিলাম, তা আপনাদের হৃদয়ে স্থান পেয়েছে। আপনাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান এই ধারণাকে আরও শক্তিশালী করবে এবং এটি বিশ্ব মানবের কল্যাণে একটি ধ্রুপদী, সর্বজনীন ও কার্যকর মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, বিশ্বের লাখ লাখ মানুষ যারা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বঞ্চনা এবং প্রান্তিকরণের শিকার, তাদের জন্য এই মডেল উৎসর্গ করা যেতে পারে।”
অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি এবং সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাবের কারণে টেকসই শান্তি বিঘিœত হচ্ছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ২০১০ সালের শেষ দিকে আরব বিশ্বে ব্যাপক সরকারবিরোধী বিক্ষোভ ও সহিংসতা শুরু হলে তিউনিসিয়া, মিসর, লিবিয়া ও ইয়েমেনে দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসনের পতন ঘটে। গণমাধ্যমে সাধারণ মানুষের এই আন্দোলন পরিচিতি পায় ‘আরব গণজাগরণ’ হিসেবে।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত তাঁর মডেল বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন দেশের সরকার, নাগরিক সমাজ, জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং উন্নয়নসহযোগীদের অকুণ্ঠ সমর্থনের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সকলের জন্য সমাজ’ সৃষ্টির যে অভিযাত্রা ১৯৯২ সালে রিওতে শুরু হয়েছিল, ১৯৯৫ সালে কোপেনহেগেনে, ২০০০ সালে নিউইয়র্কে এবং ২০১২ সালে আবার রিওতে এসেও তা পূরণ হয়নি। বিশ্বে বর্তমানে প্রায় ১০০ কোটি মানুষ এখনও দৈনিক ২ ডলারের কমে জীবন ধারণ করেন। তাঁরা চরম দারিদ্র্য, ক্ষুধা, রোগ, অপুষ্টি এবং নিরক্ষরতার শিকার।
তিনি বলেন, বিশ্বের লাখ লাখ মানুষ এখনও সংঘাত ও বঞ্চনার মধ্যে বসবাস করছেন। ফলে তাঁদের কাছে স্বাধীনতা, মানবাধিকার এবং শান্তি অধরা থেকে যাচ্ছে। তাছাড়া নতুন নতুন সমস্যা যেমন ক্রমবর্ধমান জ্বালানি ও খাদ্য মূল্য বৃদ্ধি, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, ঋণ সমস্যা, জলবায়ু পরিবর্তন, সবুজ এবং দূষণমুক্ত প্রযুক্তির অভাব এবং ডিজিটাল বিচ্ছিন্নতা দরিদ্র সমাজগুলোকে আরও প্রান্তে ঠেলে দিচ্ছে এবং অতি দরিদ্রদের মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করছে।
শেখ হাসিনা বলেন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সন্তান হিসেবে ছোটবেলা থেকেই আমি নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছি। আমার পিতা বঙ্গবন্ধু স্বাঘীনতা, গণতন্ত্র ও জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। অত্যন্ত কাছ থেকে তাঁর (বঙ্গবন্ধু) এসব কাজ আমি প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছি এবং সেগুলো আমার হৃদয়ে গেঁথে আছে। আর সে কারণেই বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের ক্ষমতায়নের জন্য আমরা এই মডেল বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। যাতে জনগণের জন্য ন্যায়বিচার ও সমতা নিশ্চিত হয়। এর ফলে গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে এবং উন্নয়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে।
আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধিদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জনগণের ক্ষমতায়ন মডেলের কার্যকারিতা, এর বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা এবং দীর্ঘমেয়াদী স্থায়িত্ব এই মডেলের অন্তর্নিহিত বৈষম্যদূরীকরণ এবং ক্ষমতায়নের দক্ষতার মধ্যেই নিহিত রয়েছে। তবে এই মডেলকে আরও শক্তিশালী এবং বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্য করার জন্য আপনাদের মূল্যেবান পরামর্শ অত্যন্ত জরুরী। এই মডেল বাস্তবায়নের জন্য বিশ্বের সরকারসমূহ, নাগরিক সমাজ, জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং উন্নয়নসহযোগীদের অকুণ্ঠ সমর্থনও প্রয়োজন। যা ওডিএ, সবুজ-প্রযুক্তি হস্তান্তর, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় অতিরিক্ত তহবিল যোগানোসহ আমাদের প্রদত্ত সকল প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে নতুনভাবে উৎসাহ যোগাবে। আর তা হলেই বিশ্বের সকল মানুষ মর্যাদা, সমতা এবং স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার নতুন প্রত্যাশায় উজ্জীবিত হবেন।

No comments

Powered by Blogger.