ট্রেনের অগ্রিম টিকিটও নেই-লঞ্চের কেবিন নিয়েও শঙ্কা

ধানমণ্ডির মো. সিরাজুল ইসলামের চেহারা মলিন। রাত জেগে কমলাপুর রেলস্টেশনে এসে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। টানা আট ঘণ্টা দাঁড়ানোর পরও কাউন্টার থেকে ১৪ আগস্ট চট্টগ্রাম যাওয়ার কোনো ট্রেনের টিকিট তিনি পাননি। একই দিনের রাজশাহীর সিল্কসিটি ট্রেনের একটি টিকিট কিনতে নারায়ণগঞ্জ থেকে এসেছিলেন সবুর মিয়া।


তিনি কাকুতি মিনতি করেও কোনো টিকিট পাননি।
ঈদ উপলক্ষে গতকাল রবিবার থেকে ট্রেনের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু হয়েছে কমলাপুর রেলস্টেশনে। গতকাল বিক্রি হয়েছে বিভিন্ন রুটের ১৪ আগস্টের টিকিট। এই দিনের টিকিট কিনতে অনেকেই ভোর থেকে, কেউবা গভীর রাত থেকে স্টেশন প্রাঙ্গণে জড়ো হন। সকালে বিক্রি শুরুর কয়েক ঘণ্টা পরই টিকিট নেই, টিকিট নেই রব ওঠে। এ কারণে লাইনে দাঁড়ানো অনেকেই ক্ষুব্ধ হয়ে স্টেশন ব্যবস্থাপক খায়রুল বাশারসহ স্টেশনের বিভিন্ন কর্মকর্তার কাছে ছুটে যান। কিন্তু লাভ হয়নি।
এদিকে নৌপথের যাত্রীদের কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, লঞ্চের কেবিনের টিকিট গোপনে বিক্রি চলছে।
১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস। পরদিন ১৬ আগস্ট পবিত্র শবেকদর। দুই দিনই সরকারি ছুটি। এরপর শুক্র-শনি সাপ্তাহিক ছুটি। ১৯ থেকে ২১ আগস্ট ঈদের ছুটি। এভাবে টানা সাত দিন বন্ধ। ঈদের পরে ২২ ও ২৩ আগস্ট দুই দিন অফিস খোলা। এই দুই দিন ঐচ্ছিক ছুটি মিললে টানা ১১ দিন ছুটি কাটানো যাবে। ফলে সরকারি চাকরিজীবীরা ১৪ আগস্ট রাতের টিকিট পেতে মরিয়া ছিলেন। কিন্তু গতকাল অনেকেই ১৪ আগস্টের ট্রেনে ভ্রমণের টিকিট পাননি।
১৪ তারিখের টিকিট কিনতে আসা মোবাশ্বের আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, তিনি ১৪ আগস্টের তূর্ণা নিশীথা ও গোধূলি ট্রেনের দুটো করে মোট চারটি টিকিট নিতে এসেছিলেন। সঙ্গে ছিল ভাগিনা মারুফ আহমদ। ভোরে এসেই স্টেশনে ভিড় দেখতে পান। তাঁরা লাইনে দাঁড়িয়েও টিকিট পাননি।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকেও স্টেশনের বিভিন্ন কাউন্টারের সামনে অগ্রিম টিকিট প্রার্থীদের ভিড় চোখে পড়ে। ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের একটি টিকিট পেতে অন্য অনেকের মতোই অপেক্ষায় ছিলেন শিউলি বেগম। শিউলি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বাসে চট্টগ্রাম যাওয়া এই সময়ে ঠিক হবে না। কয়েক দিন আগে বাসে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসার পথে ছোট-বড় গর্ত চোখে পড়েছে। গৌরীপুর বাজার থেকে ওইদিন যে যানজট শুরু হয়েছিল তাতে ঢাকা আসতে ছয় ঘণ্টা বিলম্ব হয়েছে। এ কারণে এবার ট্রেনেই বাড়ি যাব। কিন্তু টিকিট কখন পাব জানি না।' তার পাশে দাঁড়ানো ফৌজিয়া বেগম বললেন, 'লাইনে দাঁড়িয়েই আছি চার ঘণ্টা ধরে। চট্টগ্রামের কোনো ট্রেনের টিকিট যে পাব তার আশা নেই।'
দুপুর ১২টায় জানা গেল, ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম রুটের মহানগর গোধূলি, মহানগর প্রভাতী ও তূর্ণা নিশীথার ৬০-৭০ ভাগ টিকিটই শেষ হয়ে গেছে।
আন্তনগর এক্সপ্রেস 'নীল সাগর'-এর টিকিট সংগ্রহের জন্য গত শনিবার মধ্যরাত থেকে স্টেশনে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় ছিলেন আবদুল হালিম। গতকাল দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটে হঠাৎ শুনলেন কাউন্টারে টিকিট নেই। কাউন্টার থেকে বলা হলো, ১৪ আগস্টের নীল সাগরের সব টিকিট শেষ।
ঠিক একই সময়ে দ্রুতযান এক্সপ্রেস ও পদ্মা এক্সপ্রেসের কাউন্টার থেকেও ঘোষণা এলো, ১৪ আগস্টের অগ্রিম টিকিট শেষ।
বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্রে জানা যায়, কমলাপুর রেলস্টেশনে ঈদে প্রতিদিনের বিভিন্ন আন্তনগর ট্রেনে মোট আসন প্রায় ১৩ হাজার। এর মধ্যে ই-টিকেটিংয়ের জন্য বরাদ্দ ২৫ ভাগ, ভিআইপি আসন ৫ ভাগ, রেলওয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য মোট আসনের মধ্যে ৫ ভাগ বরাদ্দ রয়েছে।
গতকাল কাউন্টারে টিকিট না পেয়ে অনেকে ইন্টারনেটে টিকিট সংগ্রহের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু তখন সেখানেও তাঁরা টিকিট নেই দেখতে পান।
আজ ১৫ আগস্টের টিকিট : রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার কমলাপুর ও চট্টগ্রাম রেলস্টেশন থেকে ৯ আগস্ট পর্যন্ত বিশেষ ব্যবস্থাপনায় কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত আন্তনগর ট্রেনের বিভিন্ন গন্তব্যের টিকিট বিক্রি করা হবে। আজ বিক্রি হবে ১৫ আগস্ট যাত্রার টিকিট। এ ছাড়া ১৬ আগস্টের টিকিট ৭ আগস্ট, ১৭ আগস্টের টিকিট ৮ আগস্ট এবং ১৮ আগস্টের টিকিট ৯ আগস্ট বিক্রি করা হবে। ৫ থেকে ৯ আগস্ট পর্যন্ত বিক্রীত অগ্রিম টিকিট ফেরত নেওয়া হবে না। এ সময়ে অগ্রিম টিকিটের পাশাপাশি চলতি টিকিট বিক্রিরও ব্যবস্থা থাকবে। একজন সর্বোচ্চ চারটি টিকিট নিতে পারবে।
কেবিনের টিকিট গোপনে? : 'শুনলাম গোপনে নাকি লঞ্চের কেবিনের টিকিট বিক্রি শেষ হয়ে যাচ্ছে। যদি তাই হয়ে থাকে, তবে আমরা কী করব, কিভাবে বাড়ি যাব।' সারা বছর ঢাকায় থাকেন, ঈদে বরিশালের গ্রামের বাড়ি যাবেন বৃদ্ধ মা-বাবার সঙ্গে ঈদ করতে- এমন একজন যাত্রী উৎকণ্ঠিত হয়ে গতকাল রবিবার এভাবেই জানতে চান এ প্রতিবেদকের কাছে।
উদ্বিগ্ন ওই যাত্রীর কথা অনুসারে একটি বড় লঞ্চ কম্পানির মালিকের কাছে বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুললে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই মালিক বলেন, 'আসলেই তাই, চাহিদার তুলনায় কেবিন সংখ্যা এতই কম যে, পরিচিত, প্রভাবশালী ও মন্ত্রী-এমপিদের তদবিরে আরো আগে থেকেই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি, তাদের বুকিং নিয়েই তো কুলোনো যাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত যে কিভাবে কী হবে বুঝতে পারছি না।' একটু থেমে তিনি যোগ করেন, 'তবে ভরসা বিশেষ সার্ভিস, যেহেতু ঈদের সময় কোনো রোটেশন থাকবে না, সব কম্পানির সব লঞ্চ চলবে। তাই নয়-ছয় করে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে।' তিনি জানান, কেবিন নিয়ে টানাপড়েন হলেও সাধারণ ডেকের টিকিট ঘাট থেকেই পাওয়া যাবে।
গত শনিবার লঞ্চ মালিক সমিতির শীর্ষ নেতাদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় ১০ আগস্ট থেকে লঞ্চের আগাম টিকিট ছাড়া হবে। লঞ্চ মালিক সমিতির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, ১৪-২০ আগস্ট পর্যন্ত কোনো রোটেশন পদ্ধতি থাকবে না। রুটভিত্তিক সব লঞ্চ চলাচল করবে।
ভেতরে ভেতের কেবিনের টিকিট নিয়ে নানা তৎপরতা চললেও বাইরে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। গতকাল ঢাকা-বরিশাল রুটের সুন্দরবন-৭ লঞ্চের এক কর্মী বলেন, 'আগাম বুকিংয়ের ব্যাপারে আমরা এখন পর্যন্ত কিছুই জানি না, আমাদের অফিস থেকে জানানো হয়নি। তাই আমাদের কাছে যারা খোঁজ নিতে আসছে তাদেরকে সোজা বলে দিই বুকিং শুরু হয়নি।'
এক প্রশ্নের উত্তরে এই কর্মী জানান, এখন পর্যন্ত বহাল আছে আগের ভাড়াই। এখন ভাড়া সিঙ্গেল কেবিন প্রতিটি ৮৫০ থেকে ৯০০, ডাবল কেবিন এক হাজার ৬০০ টাকা, ইকোনমি ক্লাসের ছোফা প্রতিটি ৪০০ এবং সাধারণ ডেকের ভাড়া মাথাপিছু ২০০ টাকা করে বহাল আছে। যদিও এই ভাড়া একেক লঞ্চে কিছুটা হেরফের আছে। এ ছাড়া সব লঞ্চেই দুই-চারটি করে ভিআইপি কেবিন আছে। সেগুলোর ভাড়া তিন-চার হাজার টাকার ঘরে।
তবে লঞ্চ পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত একাধিক সূত্র জানায়, এবার ঈদে লঞ্চের ভাড়া সিঙ্গেল কেবিন প্রতিটি ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা, ডাবল কেবিন দুই হাজার টাকা বা তারও বেশি, ইকোনমি ক্লাসের ছোফা প্রতিটি ৬০০-৭০০ টাকা এবং সাধারণ ডেকের ভাড়া মাথাপিছু তিন-চার হাজার টাকা করে আদায় করা হতে পারে।
এদিকে প্রতিবারের মতো এবারও ঈদ উপলক্ষে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, বিআইডাব্লিউটিএ, লঞ্চ মালিকদের সংগঠনসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দফায় দফায় বৈঠক করেছে। বৈঠকে যাত্রী হয়রানি বন্ধ, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় না করা এবং টিকিটের সহজলভ্যতার বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের-বিআইডাব্লিউটিএর উপপরিচালক ও ঢাকা নৌবন্দর কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, আগের চেয়ে এবার অনেক বেশি সুশৃঙ্খলভাবে লঞ্চের যাত্রীরা ঈদে বাড়ি ফিরতে পারবে। সে ভাবেই যাবতীয় প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে সরকারি নৌপরিবহন স্টিমার সার্ভিসের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। স্টিমারের কেবিন যাত্রীদের টিকিট প্রাপ্তি সহজলভ্য করার কথা বলে ঘাটে টিকিট বুকিংয়ের ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন সব বুকিং নেওয়া হচ্ছে মতিঝিলের বিআইডাব্লিউটিসির বুকিং দপ্তরে। তবে এ পদক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিআইডাব্লিউটিসির একজন কর্মকর্তা বলেন, মূলত স্টিমারের টিকিট সাধারণ সময়ের চেয়ে আরো কুক্ষিগত করা হয়েছে। এখন কেবল ঊর্ধ্বতন কিছু কর্মকর্তার ইচ্ছামাফিক ওই কেবিন বুকিং হবে।
এ ব্যাপারে বিআইডাব্লিউটিসির ঢাকা বন্দরের ব্যবস্থাপক খালেদ নেওয়াজ বলেন, আশা করি কোনো সমস্যা হবে না। এবার যাত্রীরা যাতে সুন্দরভাবে নির্বিঘ্নে ভ্রমণ করতে পারে তা নিশ্চিত করা হবে।

No comments

Powered by Blogger.