ধর্ম- রমজানের শিক্ষা সহিষ্ণু ও সহনশীল হওয়া by আবদুস সবুর খান

রোজা ব্যক্তিকে আত্মসংযমী, কষ্টসহিষ্ণু ও অন্যের প্রতি সহনশীল হতে শেখায়। সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সব রকমের পানাহার থেকে বিরত থেকে ব্যক্তি ক্ষুধা-পিপাসার কষ্ট সম্মক উপলব্ধি করে একদিকে যেমন কষ্টসহিষ্ণু হয়ে ওঠে অপর দিকে গরিব-দুঃখী, যারা প্রতিদিনই অনাহার-অর্ধাহারে কাটায়, জীবনে যাদের হররোজ রোজা, সেই অভাবী


মানুষদের প্রতি আরও সহনশীল হয়ে ওঠে, এটিই মাহে রমজানের সিয়াম সাধনার মূল লক্ষ্য। কিন্তু আমরা বাস্তব জীবনে এমন অনেক রোজাদারকে দেখি, যারা সহিষ্ণু হওয়ার পরিবর্তে রোজা রেখে ক্ষুধা-পিপাসার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আরও অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। অহেতুক রাগারাগি করে, ঝগড়া-বিবাদে জড়িয়ে যায়। যা দেখে আমরা কেউ কেউ বলি, ‘রোজায় ধরেছে।’ যেন রোজা রাখলে এ রকম অসহিষ্ণু আচরণ করাই স্বাভাবিক। অথচ রাসুল (সা.) এরূপ আচরণকারী রোজাদারদের কঠোরভাবে সতর্ক করেছেন।
হজরত ইমাম গাজ্জালি (র.)-এর এক বর্ণনা থেকে জানা যায়, একদা রাসুল (সা.)-এর মজলিশে উপস্থিত সাহাবিরা আরজ করলেন,‘ইয়া রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ)! অমুক মহিলা সারা দিন রোজা রাখে এবং সমস্ত রাত্রি জাগ্রত থেকে আল্লাহ্র এবাদত করে। কিন্তু তার মেজাজ খুবই উগ্র। কর্কশ বাক্যের দ্বারা সে প্রতিবেশীদের সর্বদা জ্বালাতন করে, কষ্ট দেয়।’
এ কথা শুনে নবী করিম (সা.) বললেন, ‘এই মহিলা দোজখে যাবে।’ তিনি আরও এরশাদ করলেন, ‘সিরকা যেমন মধুকে নষ্ট করে, মানুষের মন্দ স্বভাবও তেমনি তার সর্ববিধ এবাদতকে নষ্ট করে ফেলে।’ স্বভাবতই রাসুল (সা.) হাদিসে উল্লেখ করেছেন, ‘রোজা ঢাল স্বরূপ। সুতরাং, যে ব্যক্তি রোজা রাখবে তার দাঙ্গা-ফ্যাসাদ হতে বিরত থাকা উচিত। কেউ তাকে গালিগালাজ করলে কিংবা তার সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হলে তার পরিষ্কার ভাষায় বলে দেয়া উচিত, আমি রোজাদার।’
রাসুল (সা.) রোজাদারের প্রতি সহনশীল হতেও উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি বলেছেন, তোমাদের মধ্যে যে রোজাদারের প্রতি সহনশীল হয়, তার শ্রম লাঘব করে, মহান আল্লাহ্ তার প্রতি অসীম রহমত বর্ষণ করেন। মাহে রমজান উপলক্ষে সরকার অফিস সময়সূচি দুই ঘণ্টা কমিয়ে দিয়েছে। আমরা যারা কলকারখানা এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিক। যাদের অধীন অনেক শ্রমিক-কর্মচারী রয়েছে, তারাও মাহে রমজানে আমাদের অধীন শ্রমিক-কর্মচারীদের শ্রম কিছুটা হালকা করে দিতে পারি। অন্য সময় যাদের দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ করতে হয় এ সময় তাদের কর্মঘণ্টা দুই ঘণ্টা কমিয়ে দিতে পারি। যেখানে দুজন শ্রমিক প্রয়োজন সেখানে তিনজন শ্রমিক নিয়োগ দিলে তাদের শ্রমের বোঝা অনেকটা হালকা হবে।
অপর দিকে আমাদের গৃহস্থালি কাজে নিয়োজিত লোকটির প্রতিও আমাদের সহনশীল হওয়া উচিত। এমনিতেই রোজার মাসে ইফতারি ও সেহরির সময় তাদের ওপরে অতিরিক্ত কাজের চাপ পড়ে। আমাদের সঙ্গে সঙ্গে তারাও রোজা রাখে। সুতরাং, তাদের প্রতিও আমাদের একজন রোজাদারের মতোই সহনশীল আচরণ করা উচিত। আমরা ইফতারিতে এবং সেহরিতে যা খাই তাদেরকেউ তাই খেতে দেয়া উচিত। আমার আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে, পরিচিত-অপরিচিতদের মধ্যে যারা অসহায়, অভাবী তাদের প্রতিও আমাদের সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত। রোজার শিক্ষাও তাই।
ইসলামের প্রতিটি এবাদতই কিন্তু সামষ্টিকভাবে আদায় করার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে। এর লক্ষ্য হচ্ছে পারস্পরিক সহানুভূতিশীল একটি মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। কোরআন তেলাওয়াত, রোজা, নামাজ, তারাবি— এসব হচ্ছে খোদায়ি লক্ষ্য হাসিল করার প্রস্তুতি, উপায়, প্রশিক্ষণ এবং হাতিয়ার বা আয়ুধ। এসবের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও খোদায়ি গুণাবলি অর্জন করে মানুষের প্রতি সহমর্মী, সহানুভূতিশীল ও দয়ালু হয়ে খোদা তাআলার অনুগ্রহ লাভ করা।
আল্লাহ্র রাসুল (সা.) তাঁর উম্মতদের মাহে রমজানে বেশি বেশি নফল এবাদত বা ভালো কাজ করায় উদ্বুদ্ধ করেছেন। কারণ, বান্দা সর্বদা নফল এবাদতের মাধ্যমেই খোদাতাআলার নৈকট্য লাভ করতে থাকে। নফল এবাদত বা ভালো কাজের ফলে আল্লাহ্ তাঁর বান্দাকে বন্ধু বানিয়ে নেন। হাদিসে কুদসিতে এ প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন, ‘আর যখন আমি তাকে আমার বন্ধু বানিয়ে নিই, তখন আমি তার কান হয়ে যাই, যা দ্বারা সে শোনে, আমি তার চোখ হয়ে যাই, যা দ্বারা সে দেখে, আমি তার হাত হয়ে যাই, যা দ্বারা সে স্পর্শ করে এবং আমি তার পা হয়ে যাই, যা দ্বারা সে চলাফেরা করে। সে আমার কাছে প্রার্থনা করলে অবশ্যই আমি তাকে দেই এবং সে আমার কাছে আশ্রয় চাইলে আমি তাকে আশ্রয় দেই।’ (বুখারি)
মহান আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে মাহে রমজানের সিয়াম সাধনার মাধ্যমে তাঁর এসব গুণাবলি অর্জন করে আমাদের সামাজিক জীবনে তা অনুশীলন করার তাউফিক দান করুন।
ড. আবদুস সবুর খান: সহযোগী অধ্যাপক, ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.