লন্ডন অলিম্পিকের বর্ণাঢ্য উদ্বোধন হচ্ছে আজ by গাজীউল হাসান খান

এক অপূর্ব আলো ঝলমল ও উৎসবমুখর পরিবেশের মধ্যে আজ পূর্ব লন্ডনের স্ট্রাটফোর্ডে নবনির্মিত স্টেডিয়ামে পর্দা উঠবে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম শো, ৩০তম অলিম্পিক গেমসের। বাংলাদেশি অধ্যুষিত স্ট্রাটফোর্ড ও লিভ্যালি এলাকার অলিম্পিক পার্ক ও ভিলেজের দিকে তাকালে মনে হয়, এখানে এসে মিশে গেছে রূপকথার সঙ্গে একবিংশ শতাব্দীর


বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। ব্রিটিশদের উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির বহুমুখী পরিকল্পনায় ক্রীড়া জগৎকে টেনে তোলা হয়েছে এক নতুন নান্দনিক ধ্যান-ধারণার সর্বোচ্চ পর্যায়ে। ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রীষ্মকাল শুরু হলেও এবার এক হেঁয়ালিপূর্ণ আবহাওয়া মাথায় নিয়ে শুরু হচ্ছে ১৭ দিনব্যাপী অলিম্পিক গেমস। এ সময়ে মোট ৩৪টি স্থানে সুসম্পন্ন হবে ২৬টি ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। তাই মেঘ-বৃষ্টি-রোদের খেয়ালি আনাগোনার মধ্যে এখানে বসেছে বিশ্বের খ্যাতিমান ক্রীড়াবিদ ও ক্রীড়ামোদীদের এক অসাধারণ মিলনমেলা। অলিম্পিক গেমস উপলক্ষে লন্ডন মহানগরী সর্বত্র সেজেছে উৎসবের এক বর্ণালি সাজে। ১৯৯৭ থেকে বিগত সাত বছরের সযত্ন পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির পর এক বিশাল আয়োজনের মধ্যে আজ আনুষ্ঠানিকভাবে অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধনী ঘোষণা করবেন ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ, রাষ্ট্রক্ষমতায় এ বছর যিনি তাঁর হীরক জয়ন্তী পালন করেছেন। লন্ডন অলিম্পিক ২০১২-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের রাষ্ট্র কিংবা সরকারপ্রধানরা। তা ছাড়া আরো অনেক গণ্যমান্য অতিথি ও তারকা ব্যক্তি উপস্থিত থাকবেন বলেও ঘোষণা করা হয়েছে।
এবারের অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধনী প্যারেডে বিশ্বের ২০৫টি দেশের মোট ১০ হাজার ৫০০ সম্ভাবনাময় তরুণ ক্রীড়াবিদ অংশ নেবেন বলে জানা গেছে। তাঁরা মোট ২৬টি ভিন্ন ভিন্ন খেলায় স্বর্ণ, রৌপ্য ও তাম্র জয়ের জন্য এক শ্বাসরুদ্ধকর প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করবেন। তাঁদের সে প্রতিযোগিতার জীবন্ত দৃশ্য এবার বিশ্বের রেকর্ড পরিমাণ দর্শক অর্থাৎ প্রায় চার বিলিয়ন মানুষ সরাসরি টেলিভিশনের পর্দায় উপভোগ করবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তা ছাড়া ইতিমধ্যে অলিম্পিকের বিভিন্ন গেমসের প্রায় ৯০ লাখ টিকিট বিক্রি হয়েছে। টিকিট ক্রয়কারীরা অলিম্পিক গেমসের নির্ধারিত ভেন্যুতে উপস্থিত হয়ে বিভিন্ন খেলা দেখবেন বলে আশা করা যায়। বিভিন্ন স্প্রিন্ট থেকে ফুটবল, হকি, টেনিস, বাস্কেটবল, ভলিবল ও নৌকা প্রতিযোগিতাসহ বেশ কিছু গেমস রয়েছে, যেখানে হাজার হাজার দর্শকের সমাগম হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নবনির্মিত অলিম্পিক স্টেডিয়ামে মোট ৮০ হাজার দর্শকের ধারণক্ষমতা রয়েছে। তা ছাড়া ফুটবল ফাইনালের জন্য ওয়েম্বলি স্টেডিয়াম, টেনিসের জন্য উইম্বলডন, আর্চারির জন্য লর্ডস গ্রাউন্ডসহ অন্যান্য আউটডোর গেমসের জন্য রিজেন্টস পার্ক ও হাইড পার্ক এবং ইনডোর গেমসের জন্য মিলেনিয়াম ডোম ও গ্রিনিচ পার্ক স্পোর্টস সেন্টার ব্যবহার করা হবে। এর সবই হচ্ছে প্রবাদতুল্য ভেন্যু। অলিম্পিক গেমসের বেশির ভাগ ভেন্যু বা অনুষ্ঠানস্থলকে তিনটি জোনে ভাগ করা হয়েছে। যেমন- অলিম্পিক জোন, রিভার জোন ও সেন্ট্রাল জোন। তা ছাড়া মাউন্টেন বাইকিং, ক্যানো ও সেইলিংয়ের জন্য বৃহত্তর লন্ডনের বাইরে উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করা হয়েছে। বৃহত্তর লন্ডনের বাইরে ওয়েমাউথে পোর্টল্যান্ড হারবার ও পোর্টল্যান্ড ন্যাশনাল সেইলিং একাডেমীকে বেছে নেওয়া হয়েছে।
লন্ডন অলিম্পিক গেমস ২০১২-এর লাখ লাখ দেশীয় ও বিদেশি দর্শক স্ট্রাটফোর্ড অলিম্পিক স্টেডিয়াম কিংবা ভেন্যুতে সহজে পারাপারের জন্য বিগত কয়েক বছরে লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেন সার্ভিসের ইস্ট লন্ডন লাইনটিকে সম্প্রসারিত করা হয়েছে এবং ডকল্যান্ড লাইট রেলওয়েকে করা হয়েছে আরো অধিক যাত্রী ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন। তা ছাড়া সেন্ট্রাল লন্ডন থেকে নবনির্মিত স্টেডিয়াম পর্যন্ত 'অলিম্পিক জ্যাভেলিন সার্ভিস' নামে একটি সম্পূর্ণ নতুন ট্রেনলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। পাশাপাশি অলিম্পিক পার্কে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে ১২ হাজার গাড়ি রাখার জন্য নতুন একটি কার পার্ক তৈরি করা হয়েছে। বেইজিংয়ের পর লন্ডনে ২০১২ সালে পরবর্তী অলিম্পিক গেমসের স্থান নির্বাচন নিয়ে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং এবং বড় অসুবিধা ছিল প্রস্তাবিত অলিম্পিক পার্ক ও ভিলেজে যাত্রী পরিবহনকে কেন্দ্র করে। সেদিক থেকে প্যারিসের তুলনায় লন্ডনের কিছুটা পশ্চাৎপদতা ছিল। কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার এবং পরবর্তী সরকারের সময় ক্রীড়ামন্ত্রী ও লন্ডন মহানগরীর মেয়র বরিস জনসন সে অসুবিধা কাটিয়ে ওঠার জন্য এক বিশাল পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। প্রায় ১০ বিলিয়ন পাউন্ড স্টার্লিংকে (প্রায় ১৮ বিলিয়ন ইউএস ডলার) লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে পূর্ব লন্ডনের নিউহ্যামে পশ্চাৎপদ স্ট্রাটফোর্ডকে অলিম্পিক নগরী হিসেবে গড়ে তোলার এক উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এর আগে অর্থাৎ ১৯৯২ সালে বার্মিংহাম নগরী এবং ১৯৯৬ ও ২০০০ সালে ম্যানচেস্টার নগরী অলিম্পিক গেমস আয়োজন করার আগ্রহ প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। তার পরই অর্থাৎ ১৯৯৭ সালে ব্রিটিশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন ২০১২ সালে লন্ডনে অলিম্পিক গেমস অনুষ্ঠানের জন্য অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে মাঠে নামে। ব্রিটিশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের সে উদ্যোগের সঙ্গে ছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারসহ সব ক্যাবিনেট সদস্য। ফলে পরবর্তী পর্যায়ে সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির সভায় প্যারিসকে হারিয়ে লন্ডন অলিম্পিক গেমস ২০১২ অনুষ্ঠানের গৌরব অর্জন করে।
বিশ্বের ইতিহাসে লন্ডনই প্রথম নগরী, যেটি তৃতীয়বারের মতো অলিম্পিক গেমস আয়োজনের সুযোগ পেল। এর আগে ১৯০৮ এবং ১৯৪৮ সালে যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয়বারের মতো লন্ডনে অলিম্পিক গেমস অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ১৬ জুলাই ভোরে আমি যখন হিথ্রো বিমানবন্দরের চার নম্বর টার্মিনালে ঢাকা থেকে এসে অবতরণ করি, তখনো আকাশ ছিল অত্যন্ত মেঘাচ্ছন্ন এবং তাপমাত্রা ছিল অত্যন্ত নিচের দিকে। তখন একজন ক্রীড়ামোদী হিসেবে আসন্ন অলিম্পিক গেমসের কথা ভেবে আমার মনে কিছুটা কষ্ট অনুভব করছিলাম। আশা করেছিলাম, অলিম্পিকের সময় লন্ডনের আকাশ হবে মেঘমুক্ত, বলাকার শুভ্র ডানার মতো।
১৬ জুলাই থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অলিম্পিকে অংশগ্রহণকারীরা লন্ডনে আসা শুরু করেছিল। নেমেই দেখি, বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের ভিড়। সবাই সদ্য আগত ক্রীড়াবিদদের সাক্ষাৎকার নিতে ব্যস্ত। ফ্ল্যাশ লাইটের ঘন ঘন আবির্ভাবে চারদিক আলো ঝলমল করে উঠছিল। টার্মিনালের চারদিকে বিশেষ করে ভেতরের লবিতে ও অভ্যর্থনা এলাকায় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আর ছিল ক্রীড়াবিদদের স্বাগত জানাতে স্কুল-কলেজের তরুণ স্বেচ্ছাসেবকরা। অলিম্পিকের ডিজাইন করা আনুষ্ঠানিক পোশাকে তাদের মধ্যে কেউ কেউ ছিল বাংলাদেশি (বাঙালি) স্মার্ট ছেলেমেয়ে।
লন্ডন অলিম্পিক স্মরণীয় করে তোলার জন্য গেমস শুরু হওয়ার ৫০০ দিন আগে নগরীর ঐতিহাসিক কেন্দ্র ট্রাফালগার স্কয়ারে বসানো হয়েছিল একটি কাউন্টডাউন ঘড়ি। তেমনি উদ্বোধনী দিনটি স্মরণীয় করে রাখার জন্যও ব্যবস্থা করা হয়েছে জনপ্রিয় ব্রিটিশ শিল্পীদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের।
অন্যান্যের মধ্যে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্রিটিশ বাঙালি নৃত্যশিল্পী আকরাম খানের নির্দেশনায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশন করবেন ১২ হাজার শিল্পী ও কলাকুশলী। কিছু ভিন্ন ভিন্ন নৃত্যানুষ্ঠানের পরিবর্তে তিনি তাঁর পরিবেশনায় একটি ব্রিটিশ বহুজাতি ও সংস্কৃতিভিত্তিক সম্পূর্ণ বক্তব্য তুলে ধরার চিন্তা করেছেন। তা ছাড়া এবারের অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দিনটি হচ্ছে শেকসপিয়ারের 'টেম্পেস্ট'। জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবাকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্যই নাকি বেছে নেওয়া হয়েছে এ বিশেষ থিমটি। এখানে উল্লেখ্য, অলিম্পিক স্মারক মুদ্রার ডিজাইনারদের মধ্যেও রয়েছেন একজন বাঙালি তরুণ। তাঁর নাম সায়মন মিয়া। তিনি ২০১২ সালের অলিম্পিক গেমস উপলক্ষে বাজারে ছাড়া পাঁচ পাউন্ডের মুদ্রার ডিজাইন প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েছেন। তা ছাড়া ২১ জুলাই অলিম্পিক স্টেডিয়ামের পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশি অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটস বারা কাউন্সিল প্রদক্ষিণ করেছে অলিম্পিক টর্চ বা মশাল। এতে টাওয়ার হ্যামলেটস বারা কাউন্সিলের ১৪ মশালধারীর মধ্যে দুজন ছিলেন বাঙালি তরুণ। তা ছাড়া অলিম্পিক গেমসে অংশগ্রহণকারী ক্রীড়াবিদ ও স্বেচ্ছাসেবকদের জন্য পোশাক প্রস্তুতকারীদের মধ্যে বাংলাদেশ ছিল একটি অন্যতম প্রধান দেশ। লন্ডন অলিম্পিক গেমস ২০১২-কে কেন্দ্র করে বিভিন্ন টি-শার্ট ও ক্যাপসহ বাংলাদেশে প্রস্তুত বহু নামিদামি কম্পানির স্যুভেনির এখন লন্ডনের প্রায় সর্বত্রই বিক্রি হচ্ছে। মোট কথা, লন্ডন অলিম্পিক গেমস ২০১২-এ বিভিন্ন পর্যায়ে বাঙালি ও বাংলাদেশের অবদান অত্যন্ত স্পষ্টভাবে জড়িয়ে রয়েছে। তা ছাড়া অলিম্পিক উপলক্ষে পূর্ব লন্ডনের বাংলাদেশি অধ্যুষিত ব্রিক লেনকে ব্রিটেনের 'কারি ক্যাপিটাল' ঘোষণা করা হয়েছে, যেখানে গেমস চলাকালে ব্রিটিশ নাগরিক ও বিদেশি ভ্রমণকারীরা, বিশেষ করে ক্রীড়ামোদীরা জনপ্রিয় বাংলাদেশি বা ভারতীয় খাবার খেতে পারেন। ২৭ জুলাই থেকে ১২ আগস্ট পর্যন্ত ১৭ দিনব্যাপী গেমস চলার পর পর্দা নেমে আসবে লন্ডন অলিম্পিকের। তাকে স্মরণীয় ও প্রাণবন্ত করে তোলার জন্যও চেষ্টার কোনো ত্রুটি দেখা যাচ্ছে না। লন্ডন অলিম্পিক গেমস ২০১২-এর সমাপনী অনুষ্ঠানে একসময়ের জনপ্রিয় ব্রিটিশ ব্যান্ড 'স্পাইস গার্লস'-এর শিল্পীরা আবার একত্র হয়ে ১২ আগস্ট সংগীত পরিবেশন করবেন বলে জানা গেছে। তা ছাড়া সে অনুষ্ঠানে জর্জ মাইকেল, দ্য হু, জেসিজে এবং আরো কিছু নামকরা ব্রিটিশ শিল্পী অংশগ্রহণ করবেন বলে জানা গেছে। বিত্ত-বৈভবের বহিঃপ্রকাশের মাধ্যমে নয়; বরং বুদ্ধিবৃত্তি, নান্দনিকতা ও উন্নত সংস্কৃতি এবং ঐশ্বর্যশালী প্রাচীন ব্রিটিশ ঐতিহ্য তুলে ধরার মাধ্যমেই এবারের লন্ডন অলিম্পিক গেমস ২০১২-কে স্মরণীয় করে রাখতে চায় ব্রিটেন। উপহার দিতে চায় স্মরণাতীতকালের এক পরিচ্ছন্ন ক্রীড়া অনুষ্ঠান, নির্মল আনন্দ। (লন্ডন থেকে)
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা বাসস-এর সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক

No comments

Powered by Blogger.