দূরদেশ-‘ফ্রাইডে নিউজ ডাম্প’ by আলী রীয়াজ

যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের মধ্যে একটা অলিখিত প্রচলিত ব্যবস্থা আছে, যার সঙ্গে এ দেশে সাংবাদিকতা যাঁরা করেন তাঁরা কম-বেশি সবাই পরিচিত। বিশেষ করে যাঁরা ক্ষমতার শীর্ষবিন্দু হোয়াইট হাউসে সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেন, তাঁরা এর সঙ্গে শুধু সম্যকভাবে পরিচিতই নন, এ নিয়ে খানিকটা অসন্তুষ্টও; কিন্ত তাঁরা জানেন এ বিষয়ে তাঁরা কিছু করতে পারবেন না।


ফলে তাঁরা এ বিষয়ে কেবল সতর্ক থাকতে পারেন এবং থাকেনও। এই প্রচলিত ব্যবস্থাটির কোনো নাম নেই সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের কাছে, এটি পরিচিত ‘ফ্রাইডে নিউজ ডাম্প’ বলে। এর অন্য একটি নামও আছে: ‘টেইক আউট দা ট্র্যাশ ডে’। আসল ঘটনাটি হলো, প্রশাসনের জন্য যে খবরটি খারাপ তা শুক্রবার বিকেলে সাংবাদিকদের জানানো। এ দেশে শুক্রবার বিকেল থেকেই লোকজন সপ্তাহান্তের ছুটির মেজাজে চলে যান এবং গোটা উইকএন্ড শনিবার ও রোববার— সংবাদপত্র বা গণমাধ্যমের দিকে খুব মনোযোগ দেন না। ফলে সে সময় প্রশাসনের জন্য কোনো বিরূপ খবর থাকলেও তা সাধারণের মনোযোগ আকর্ষণ করবে না। তদুপরি তা নিয়ে গণমাধ্যমে আলাপ-আলোচনাও হবে না। কেননা অনেক কেব্ল টিভিতে সপ্তাহান্তে রাজনৈতিক আলা—আলোচনার অনুষ্ঠান থাকেও না। ফলে প্রশাসন সব সময় চেষ্টা করে খারাপ খবর কিংবা বিরূপ তথ্যাদি শুক্রবার বিকেলে সাংবাদিকদের ধরিয়ে দিতে। ‘ফ্রাইডে নিউজ ডাম্প’-এর বিষয়টি সাংবাদিকতার পাঠ্যসূচিতে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়নি, তবে ক্লাসরুমে যা আলোচিত হয় তা বলাই বাহুল্য; একইভাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সব ক্লাসে না হলেও ক্যাম্পেইন পলিটিক্স বা নির্বাচনী প্রচারাভিযান-সংক্রান্ত ক্লাসে তা নিয়ে আলোচনা করতেই হয়। এর অন্যতম কারণ হলো, এই অভ্যাস এখন নির্বাচনী প্রচারাভিযানেও সমভাবে ব্যবহূত হয়ে থাকে।
সাধারণ লোকজন এই কয়েক বছর আগে পর্যন্ত এ নিয়ে খুব বেশি জানতেন না। বিষয়টি সাধারণের কাছে তুলে ধরার কাজটি করে ‘ওয়েস্ট উইং’ বলে একটি জনপ্রিয় টিভি ধারাবাহিক (১৯৯৯-২০০৬, এনবিসি)। হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্টের দপ্তর হলো ওয়েস্ট উইংয়ে, ধারাবাহিকটি ছিল প্রেসিডেন্টের দপ্তর নিয়ে, সেখানে কী হয়, তারা কীভাবে পরিস্থিতি সামাল দেয়, এসব নিয়ে। প্রথম বছরের ত্রয়োদশ এপিসোডের নাম ছিল ‘টেইক আউট দা ট্র্যাশ ডে’। যার বাংলা করলে দাঁড়ায়, ময়লা ফেলার দিন। হোয়াইট হাউস একটা সংকটের মুখে অন্যান্য ঝামেলা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। এই অবস্থায় হোয়াইট হাউসের রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও ডিপুটি চিফ অব স্টাফ জশ লাইমেন এবং তাঁর সহকারী দোনার মধ্যকার কথোপকথন এ রকম:
ডনা: টেইক আউট দা ট্র্যাশ ডে কী?
জশ: শুক্রবার
ডনা: না, মানে আমি জানতে চাইছি তার মানে কী?
জশ: যেসব খবর নিয়ে আমরা খুশি না, কিন্তু সাংবাদিকদের দিতেই হবে, সেই খবরগুলো আমরা সব একত্র করে শুক্রবার সাংবাদিকদের দেব।
ডনা: সব একসঙ্গে দাও কেন?
জশ: মানে একটা একটা করে নয় কেন?
ডনা: আমি ভেবেছিলাম তুমি চাইবে সেগুলো আস্তে আস্তে ছড়িয়ে দেওয়া হোক।
জশ: তাঁদের হাতে ভরাবার নির্দিষ্ট পরিমাণ কলাম ইঞ্চি আছে তাই না? যা-ই হোক না কেন, সেগুলো তাঁরা ভরাবে।
ডনা: ঠিক বলেছ।
জশ: তা হলে তুমি যদি একটা খবর দাও, তাঁরা সেটা দিয়েই তাঁদের নির্দিষ্ট কলাম ইঞ্চি ভরাবে।
ডনা: আর আমরা যদি পাঁচটা খবর দিই?
জশ: তা হলে সেটা হবে এক-পঞ্চমাংশ...
ডনা: তোমরা এটা শুক্রবারেই করো কেন?
যশ: কেননা শনিবারে কেউ সংবাদপত্র পড়ে না।
ডনা: আর তোমরাই হচ্ছ আসল পপুলিস্ট, তাই না?
যুক্তরাষ্ট্রে এটা কোনো একটি প্রশাসনের সময় ব্যবহূত হয়েছে তা নয়। সব সময়ই এই আচরণ চলে এসেছে। দু-একটা উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে। প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ যখন পুনঃ নির্বাচনের প্রার্থী, তখন প্রশ্ন উঠেছিল ন্যাশনাল গার্ডের সদস্য হিসেবে তিনি সুবিধা নিয়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধে যাননি, তাঁর এই রেকর্ড তাঁর জন্য খুব ইতিবাচক ছিল না। তাই সাংবাদিকদের চাপের মুখে এই রেকর্ড প্রকাশ করা হয় ২০০৪ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার। ইরাকে আবু-গারাইব কারাগারে মার্কিন সেনাদের আচরণ, বিশেষত অত্যাচারের খবর যখন বেরোয়, তখন প্রশাসন ২০০৪ সালের ১৫ জানুয়ারি শুক্রবার ঘোষণা দেয় তারা এ নিয়ে অবগত এবং তার তদন্ত হবে। একইভাবে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যখন সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি অভিযুক্ত সন্ত্রাসীদের বিচারের জন্য বুশ আমলের ট্রাইব্যুনালগুলো বহাল রাখবেন, তার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল এক শুক্রবারেই। নির্বাচনী প্রচারণায় এই পদ্ধতির ব্যবহার দেখতে পাই যখন রিপাবলিকান প্রার্থী মিট রমনি তাঁর এবং স্ত্রীর সম্পদের হিসাব দেন এক শুক্রবারের সন্ধ্যায়, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এ নিয়ে বেশি আলোচনায় রমনি মোটেই উৎসাহী নন। এ ধরনের কোনো রীতি চালু আছে এবং তা বেশ গুরুত্বের সঙ্গে অনুসরণ করা হয়, এটা ক্ষমতায় থাকার সময় কেউই স্বীকার করেন না। কিন্ত ক্ষমতার বাইরে যাওয়ার পর এ নিয়ে কেউ কেউ মুখ খোলেন বটে। যেমন, প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের প্রেস সেক্রেটারি জো লকহার্ট ২০০৫ সালে পাবলিক রেডিও এনপিআর-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছিলেন যে এই চেষ্টা সব প্রশাসনেরই আছে। তবে তাঁর ধারণা, এতে খুব লাভ হয় না। জর্জ বুশের আমলে তাঁর রাজনৈতিক উপদেষ্টা ছিলেন কার্ল রোভ। রোভ নিজে এ ধরনের রীতি কেবল অনুসরণই করেছেন তা নয়, কারও কারও মতে তিনি একে ব্যবহার করেছেন সবচেয়ে বেশি। তিনি অবশ্য ওবামা প্রশাসনের বিরুদ্ধে প্রায়ই এ নিয়ে অভিযোগ করে থাকেন।
এই অলিখিত রীতি বছরের পর বছর চালু থাকলেও দেশের কোনো সংকটের সময় তার ব্যবহারের উদাহরণ নেই। একই ধরনের রীতি যুক্তরাজ্যেও চালু আছে বলে সাংবাদিকেরা অভিযোগ করেন। শুধু তা-ই নয়, অন্তত একটি উদাহরণ রয়েছে যেখানে আন্তর্জাতিক সংকটের সময় ব্রিটিশ সরকারের একজন আরেক জনকে এই সুযোগ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। বিবিসির সাবেক সাংবাদিক কামাল আহমেদ এ প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেছেন, ‘২০০১ সালে টনি ব্লেয়ারের রেলমন্ত্রী ছিলেন স্টিফেন বায়ার্স। রেল বিভাগের যাত্রীসেবার মান বাড়ানোর নানা চেষ্টায় সরকার তখন গলদঘর্ম। কিন্তু,সাম্প্রতিক যেসব তথ্য-উপাত্ত তাঁদের কাছে এসেছে তা সরকারের জন্য রীতিমতো বিব্রতকর। অথচ, এসব তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আর সেই বিষয়টিকে কীভাবে সামাল দেওয়া যায় তা নিয়ে মন্ত্রীর দুজন গণমাধ্যম সংক্রান্ত মন্ত্রণাদাতার মধ্যে ইমেইলে সলাপরামর্শ চলছিল। দিনটা ছিল ১১ সেপ্টেম্বর, যেদিন নিউইয়র্কের টুইন-টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। মিষ্টার বায়ার্সের এই মন্ত্রণাদাতাদের একজন, জো মুর তাঁর ইমেইলে যা লেখেন তার বাংলা করলে দাড়ায়; ‘কোনো বিষয় যদি আমরা কবর দিয়ে ফেলতে চাই, তবে আজকে তা প্রকাশ করার সবচেয়ে ভালো দিন।’ বিষয়টি ফাঁস হয়ে যাওয়ায় জো মুর ক্ষমা চেয়ে পদত্যাগ করেন (কামাল আহমেদ, ‘সময় বেছে নিয়ে পদত্যাগ?’, এইদেশ ডট কম, ২৩ জুলাই ২০১২)। এই ঘটনার পর ব্রিটিশ রাজনীতিবিদেরা বুঝতে পেরেছেন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংকট বা বেদনাবহ পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণের চেষ্টা খুব বিবেচকের কাজ নয়।
পাদটীকা: বাংলাদেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ২২ জুলাই রোববার পদত্যাগ করেছেন। আবুল হোসেন কোন পটভূমিকায় পদত্যাগ করলেন তা সবারই জানা। আবুল হোসেন যখন পদত্যাগ করেন, বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোতে তখন আলোচনার বিষয় দেশের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক, চলচ্চিত্রকার হুমায়ূন আহমেদের জীবনাবসান এবং তাঁর দাফন। হুমায়ূনের স্মরণ ও তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের বিভিন্ন খবরই গণমাধ্যমের প্রধান বিষয়। ব্যাপারটা আশা করি নেহাতই কাকতালীয়।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।

No comments

Powered by Blogger.