ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-সংস্কার হয় আর ভাঙে

পিচঢালা পথের কোথাও গর্তের সৃষ্টি হলে ঢালা হয় আস্ত ইটের সঙ্গে কাদামাটির মিশ্রণ। এরপর একপসলা বৃষ্টি আর অতিরিক্ত মালামাল বহনকারী গাড়ির চাপে ছোট গর্ত আরো বড় হয়। যেখানে রাস্তা ভাঙে, সেখানেও এমন জোড়াতালি দেওয়া হয়। ফলে ভাঙা রাস্তা আরো বেশি ভেঙে যায়।


ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চট্টগ্রাম সিটি গেট থেকে মিরসরাইয়ের বারইয়ারহাট পর্যন্ত ৭৮ কিলোমিটার এলাকার এখন এমনই দুর্দশা।
ঢাকার দিককার চিত্রও সুখকর নয়। রাজধানীর অদূরের কাঁচপুর ব্রিজ থেকে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম পর্যন্ত ১৪০ কিলোমিটার অংশের এখন বেহাল দশা। মেরামতে চলেছে জোড়াতালি। এ ছাড়া আছে ২২টি বাসস্ট্যান্ডে অবৈধ স্থাপনা, ৩৫ বাঁক এবং ঝুঁকিপূর্ণ মেঘনা ও গোমতি সেতু। ফলে আসন্ন ঈদে এই মহাসড়ক ধরে ঘরমুখো মানুষের জনদুর্ভোগের আশঙ্কা করা হচ্ছে।
চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারগামী মহাসড়কটির অবস্থাও করুণ। কক্সবাজার সড়ক ও জনপথ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দোহাজারী অংশের ৭৫ কিলোমিটার সড়কের অবস্থা বেশি খারাপ। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার সড়ক বিভাগের সীমান্তবর্তী এলাকা আজিজনগর পর্যন্ত কমপক্ষে ২০ কিলোমিটারে ছোট-বড় গর্ত এবং খন্দক রয়েছে। সরেজমিন দেখা গেছে, উখিয়া উপজেলার বালুখালী থেকে শুরু করে টেকনাফের দমদমিয়া পর্যন্ত অসংখ্য গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।
চট্টগ্রাম উপকণ্ঠে ভয়াল চিত্র : ৩ আগস্ট শুক্রবার ঢাকা থেকে চাঁদপুর যাচ্ছিলেন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। কুমিল্লার গৌরিপুরে যাত্রাবিরতি করে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, 'ছোট-খাটো সড়কে বেহাল অবস্থা বিরাজ করলেও বড় মহাসড়কের কোথাও এখন গর্ত নেই।' তবে কালের কণ্ঠের সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের একাধিক স্থানে হাজারো গর্ত। ফলে প্রধান সড়ক বন্ধ হয়ে অচলাবস্থা বিরাজ করছে। এর মধ্যে বারইয়ারহাট থেকে চট্টগ্রাম সিটি গেট পর্যন্ত অংশটিও পড়ে। অবশ্য মন্ত্রিত্ব পাওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ওবায়দুল কাদের বারইয়ারহাট থেকে চট্টগ্রাম সিটি গেট পর্যন্ত মহাসড়কের অংশ সরেজমিন দেখেছেন বলে জানা যায়নি।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, চট্টগ্রাম সিটি গেট থেকে মিরসরাইয়ের বারইয়ারহাট পর্যন্ত ৭৮ কিলোমিটার এলাকায় অসংখ্য খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। দিনভর চোখে পড়ে জোড়াতালির নানা ছবি, কোথাওবা ভাঙন। সন্ধ্যার পর দেখা মেলে তীব্র যানজট। ২৪৫ কিলোমিটার দূরত্বের এ সড়ক চার লেনে সমপ্রসারণের কাজ চলায় কিছুটা আশার আলো জ্বলে উঠলেও বর্তমানে সড়কের বেহাল দশা। মূলত দাউদকান্দি সেতুর টোলপ্লাজা থেকে চট্টগ্রাম সিটি গেট পর্যন্ত ১৯২ কিলোমিটার এলাকায় চার লেনের কাজ চলছে। বাকি সড়ক আগে থেকেই চার লেন হওয়ায় সেখানে নতুন করে সমপ্রসারণের প্রয়োজনীয়তা নেই।
গত শুক্রবার মহাসড়কের মিরসরাই সদরের দুই পাশে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে শুরু হয় জোড়াতালি। বড় গর্তে আস্ত ইট বিছিয়ে এর ওপর ছিটিয়ে দেওয়া হয় মাটি। কাজ এখানেই শেষ। এ দৃশ্য দেখে উপস্থিত ব্যবসায়ী ও পথচারীরা রহস্য করে মন্তব্য করেন, 'বাড়ির উঠান গর্ত হয়ে গেলেও এর চেয়ে ভালো মেরামত হয়। আর এটি কি না দেশের বড় মহাসড়ক।' বিকেলের জোড়াতালির পর সন্ধ্যা নাগাদ একপশলা বৃষ্টি হয়। রাতে আরো কিছুক্ষণ বৃষ্টির পর শনিবার সকালের দৃশ্য, সাড়ে তিন ফুটের গর্ত ভরাটের পর পাঁচ ফুটে পরিণত হয়েছে। শুকনো গর্তের স্থলে দেখা যায় কর্দমাক্ত খানাখন্দ।
মিরসরাই সদরের মতো অভিন্ন অবস্থা এদিককার পুরো ৭৮ কিলোমিটার এলাকায়ই। সড়কের যেখানে গর্ত চোখে পড়ে, সেখানেই দেওয়া হয় এমন জোড়াতালি। সম্ভবত ঈদ পর্যন্ত এভাবেই চলবে।
গত শনিবার বারইয়ারহাট থেকে চট্টগ্রামমুখী উত্তরা সার্ভিসের একটি বাসে কথা হয় চালকের সহকারীর সঙ্গে। যেখানে গাড়ি অটোমেটিক (স্বয়ংক্রিয়ভাবে) থেমে যায়, সেখানে নামিয়ে দেবেন- এ প্রতিবেদকের মুখে এমন কথা শুনে সহকারী হেসে ওঠেন। বলেন, 'বুঝেছি, আমনে (আপনি) বড়দারোগাহাট স্কেলে নামবেন।'
আসলেই বড়দারোগাহাট স্কেলে এলে সব গাড়ি থেমে যেতে বাধ্য হয়। মহাসড়কের প্রায় ৫০০ মিটার অংশ গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে 'সর্বোচ্চ মানের' মেরামত করা হয়েছিল। তবে দুই মাসও টেকেনি, বরং আগের চেয়েও ভয়ংকর অবস্থা সৃষ্টি হয়। ডিসেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত সেখানে প্রধান সড়ক বন্ধ রয়েছে, দুই পাশে নির্মিত এক লেনের বিকল্প সড়ক দিয়ে এখন ধীরগতিতে যানবাহন চলাচল করছে।
বড়দারোগাহাটের মতো বারইয়ারহাট পৌর সদরের ৫০০ মিটার এলাকায়ও অচলাবস্থা দেখা দেয় বেশির ভাগ সময়। সেখানেও উভয় পাশে সরু সড়ক থাকায় গাড়ি চলাচল কোনোমতে অব্যাহত আছে। প্রায় প্রতিদিনই বারইয়ারহাট পৌর সদরে জোড়াতালি চোখে পড়ে। কিন্তু রাত শেষে পরদিন সকালের ছবি আগের দিনের তুলনায় খারাপ হয়ে যায়।
একইভাবে ভাটিয়ারী, সীতাকুণ্ড বাইপাস এলাকা, নিজামপুর, হাদিফকিরহাট, মিঠাছড়া বাইপাসের সড়কে এবড়োখেবড়ো অবস্থা। জোরারগঞ্জ বাজারের যুবরাজ বিতানের সামনের রাস্তায় বেশ কয়েকটি গর্তকে ছোটখাটো ডোবা বললে অত্যুক্তি হবে না। ফেনীর মহিপালের ১৫ কিলোমিটার উত্তরে মোহাম্মদ আলী রেলক্রসিং এলাকায় সড়কেও ভাঙন দেখা গেছে। সেখান থেকে বাকি অংশের অবস্থা স্বাভাবিক।
বড়দারোগাহাট স্কেল এলাকায় অচলাবস্থা প্রসঙ্গে চার লেন প্রকল্পের অতিরিক্ত পরিচালক স্বপন কুমার নাথ কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রো নতুন যে ডিজাইনে গত বছর উন্নতমানের মেরামত করেছে, তা বাংলাদেশের আবহাওয়ায় উপযোগী ছিল না। ফলে কয়েক দিনের মাথায় এত ভালোমানের মেরামতও ভেস্তে যায়।
অন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রেজা কনস্ট্রাকশনের ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী শাখাওয়াত হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রতিদিনই মেরামতকাজ অব্যাহত আছে। এভাবে পুরো মাস চলবে, তবে এর বেশি মেরামতের সম্ভাবনা নেই।
যাত্রী ও চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চট্টগ্রাম সিটি গেট থেকে ভাটিয়ারী- এই ১৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতেই চার-পাঁচ ঘণ্টার বেশি সময় লেগে যায়। দুঃসহ এ যানজট অব্যাহত রয়েছে গত দুই মাসের বেশি সময় ধরে। প্রতি সন্ধ্যায় এ অবস্থা শুরু হয়ে শেষ হয় ভোর রাতে। চট্টগ্রাম থেকে ফেনীগামী স্টারলাইন পরিবহনের সহকারী চালক হুমায়ুন কবির বলেন, 'এখন গাড়ি কম, তবু এত যানজট। ঈদের আগে যখন যানবাহনের চাপ বাড়বে, তখন পরিস্থিতি কী হবে- ভাবতেই গা শিউরে ওঠে।'
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম নবী কালের কণ্ঠকে বলেন, 'ঈদে যেন নির্বিঘ্নে মানুষ ঘরে ফিরতে পারে- তার আগাম ব্যবস্থা নেওয়া হোক। সড়কের বর্তমান পরিস্থিতিতে আশঙ্কা বাড়ছে, ঈদে ভোগান্তি আরো বাড়তে পারে।'
মহাসড়কের এদিকটায় সড়কের দুই পাশে অবৈধ স্থাপনা ও দুর্বল ড্রেনেজ ব্যবস্থাও যানজট বাধায়।
প্রকৌশলী শাখাওয়াত বলেন, বারইয়ারহাট পৌর সদরে আগামী ঈদের পর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান শুরু হবে। অন্যান্য স্থানেও যেখানে অবৈধ স্থাপনা রয়েছে, তাদেরকে সরিয়ে নিতে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। অবৈধ স্থাপনার কারণে সড়কের পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। জমে থাকা পানিতে একাকার সড়কে অতিরিক্ত মালবাহী গাড়ির চাপে সৃষ্টি হয় খানাখন্দক। এতে গাড়ির গতি কমে লেগে যায় যানজট।
সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের চট্টগ্রামের নির্বাহী প্রকৌশলী রানাপ্রিয় বড়ুয়ার অভিযোগ, বাজার কমিটি তৎপর হলে এমন অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার কথা নয়। বাজার কমিটি ড্রেনেজ ব্যবস্থা সক্রিয় করলে সওজের পক্ষ থেকে যেকোনো ধরনের সহায়তা দেওয়া হবে।
কাঁচপুর-চৌদ্দগ্রাম বেহালদশা : গতকাল শনিবারও মহাসড়কের কাঁচপুর ব্রিজ থেকে মেঘনা সেতু টোলপ্লাজা পর্যন্ত মেরামতকাজ চলেছে। দাউদকান্দি-গোমতি সেতু থেকে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট পর্যন্ত জোড়াতালি দিয়ে মেরামতকাজ করা হয়েছে। তবে কুমিল্লার বিশ্বরোড থেকে চৌদ্দগ্রামের শোয়াগাজী পর্যন্ত মেরামতকাজ এখনো শেষ হয়নি। ফলে অতি বর্ষণে রাস্তা ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে এবং যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটতে পারে।
এ মহাসড়কের কাঁচপুর, মদনপুর, সোনারগাঁ, ভবেরচর, দাউদকান্দি বিশ্বরোড, গৌরীপুর, রায়পুর, ইলিয়টগঞ্জ বাজার, কুটুম্বপুর, মাধাইয়াবাজার, চান্দিনা, নিমসার কাঁচাবাজার, কুমিল্লার বিশ্বরোড, চৌদ্দগ্রামসহ ২২টি বাসস্ট্যান্ডে অবৈধভাবে দোকানপাট বসানো হয়েছে। বাস থামার স্থানে নসিমন, অটোরিকশা, বেবি ও টেম্পো রাখা হয়। এসব কারণেও যানজট বেড়ে যেতে পারে। এ ব্যাপারে সোনারগাঁ বাসস্ট্যান্ডে অবৈধভাবে পার্ক করে থাকা একটি নসিমনের চালক রহিমউল্লাহ বলেন, 'স্থানীয় শ্রমিক লীগের নেতাদের আর হাইওয়ে পুলিশকে মাসোয়ারা দিয়েই মহাসড়কেই পার্ক রাখি।' চান্দিনা বাসস্ট্যান্ডে ফুটপাত দখল করে অবৈধভাবে ৩০-৪০টি দোকান তুলে ব্যবসা করছেন এমন একজন ফল ব্যবসায়ী আবু কালাম বলেন, 'ক্ষমতাসীন দলের নেতৃবৃন্দের সহযোগিতায় টাকা দিয়ে ব্যবসা করি।'
এ ব্যাপারে সড়ক ও জনপথ বিভাগের কুমিল্লা জোনের উপবিভাগীয় নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জাহিদ হোসেন বলেন, 'মহাসড়কের খারাপ অংশের মেরামতকাজ সড়ক বিভাগের কর্মীরা রাত-দিন করে যাচ্ছেন। মহাসড়কের ওপর অবৈধভাবে গড়ে ওঠা দোকানপাট স্থানীয় প্রশাসনের চত্রচ্ছায়ায় অবৈধভাবে গড়ে তুলে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের নিজস্ব কোনো ম্যাজিস্ট্রেট না থাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারছি না।'
এদিকে তিশা পরিবহনের চালক আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান ঈদের এক সপ্তাহ আগে চলাচল বন্ধ করা হলে ঈদে ঘরমুখো যাত্রীদের যানজটের শিকার হতে হবে না।
মেঘনা ও গোমতি সেতু টোল আদায়কারী প্রতিষ্ঠানের এমডি মো. মাহবুব কবির বলেন, এ সড়ক দিয়ে প্রতিদিন যেখানে ১১ হাজার যানবাহন চলাচল করার কথা, বর্তমানে চলাচল করছে ২২ হাজার এবং ঈদে সেটা হবে অন্তত ২৫ হাজার। এখানদার সেতু দুটি দিয়ে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করা না হলে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে।
হাইওয়ে পুলিশের পূর্বাঞ্চলের পুলিশ সুপার মো. রেজাউল করিম বলেন, ঈদে ঘরমুখো লোকজন যাতে নিরাপদে বাড়ি যেতে পারে, তাই হাইওয়ে পুলিশের সব সদস্যের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। মহাসড়কের ওপর অবৈধভাবে পার্কিং করা অবৈধ যানবাহনগুলো ফিডার রুটে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তা ছাড়া স্থানীয় প্রশাসন এগুলোর বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান চালিয়ে তা জব্দ করা হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, মহাসড়কে যাত্রীবাহী গাড়ির চাপ কেমন থাকবে তার ওপর নির্ভর করবে ট্রাক ও কভারভ্যান চলাচল ওপর নিয়ন্ত্রণ করা হবে কি না।
কক্সবাজার যাত্রা বিপদসঙ্কুল : রবিবার দুপুর ১২টা ৫ মিনিট। কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কক্সবাজারের ঈদগাঁও ফরিদ আহমদ কলেজের সামনের সড়কের ঝুঁকিপূর্ণ ব্রিজের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন ষাটোর্ধ্ব হাজি কালা মিয়া। তিনি ব্রিজটি দেখিয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'নিরাপদে স্থানটি পার হতে দ্রুত হাঁটছি।' তিনি জানান, এখানে একটি ব্রিজের ওপর আরেকটি বেইলি ব্রিজ কোনোমতে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। ধস ঠেকাতে দেওয়া হয়েছে বালির বস্তা। একটি গাড়ি উঠলেই পুরো ব্রিজ রাস্তাসহ কেঁপে ওঠে। এলাকার আরো অনেকেই বলেন, ব্রিজটি যেকোনো মুহূর্তে ধসে পড়ে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটতে পারে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ উদাসীন।
দুপুর সাড়ে ১২টায় কক্সবাজারের রামু উপজেলায় মহাসড়কের জেটি রাস্তা নামক স্থানে গর্তে আটকা পড়ে একটি মালবাহী ট্রাক। চালক আবুল খায়ের বলেন, 'কিছুদূর যেতে না যেতেই পড়তে হয় গর্তে।' ওই এলাকার ফজলুল করিম জানান, গত বছর দুয়েক ধরে এ সড়কে অসংখ্য গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। কর্তৃপক্ষ মাঝেমধ্যে ইট-বালি দিয়ে যায়। বৃষ্টিতে সেসব ধুয়ে যায়। টেকসই মেরামত না হওয়ার কারণে সড়কে গর্তের সৃষ্টি হয়। এমন অবস্থা কক্সবাজার শহর থেকে চকরিয়া সীমান্ত এলাকা পর্যন্ত।
গতকাল রবিবার সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, কক্সবাজারের লিংক রোড, বাংলাবাজার, খরুলিয়া, রামুর চা বাগান, হাসপাতাল গেইট, রাবার বাগান, গুচ্ছগ্রাম, জেটি রাস্তা, পানির ছড়া, রশিদনগর, নয়াবাজার, জোয়ারিয়ানালা, ঈদগাঁও ফরিদ আহমদ কলেজ, ঈদগাঁও, নয়াপাড়া, খুটাখালী, মালুমঘাট দরগাহ, ফাঁসিয়াখালী, ফাঁসিয়াখালী রশিদ আহমদ চৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে, আর্মি ক্যাম্প, ভেণ্ডি বাজার, চকরিয়া বাস টার্মিনালসহ প্রায় ৩০টি স্পটে অসংখ্য গর্ত। ফলে যান চলাচলে মারাত্মক বিঘ্ন ঘটছে। স্থানীয় লোকজন জানায়, শুধু ইটের খোয়া ও বালি দিয়ে খানাখন্দ ভরাট করার কারণে ফের গর্তের সৃষ্টি হয়। ইনানি পরিবহনের চালক সালেহ আহমদ জানান, কক্সবাজার থেকে চকরিয়া পর্যন্ত ৩০ টিরও বেশি স্থানে গর্তে পড়ে গাড়ি নষ্ট হয়। দুর্ঘটনারও শিকার হতে হয়। তিনি আরো বলেন, 'ঈদগাঁও এবং খরুলিয়া ব্রিজে গাড়ি উঠলে অনেকেই কান্নাকাটি শুরু করেন।'
কক্সবাজার সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জানান, টেকনাফ সীমান্তের স্থল বাণিজ্যের ভারী পণ্যের ট্রাক চলাচলের কারণে এ সড়কটির অবস্থা নাজুক হয়ে পড়েছে সবচেয়ে বেশি। তবে টেকনাফের তুলনায় কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অনেক ভালো রয়েছে। তিনি আরো জানান, এবারের টানা ভারি বর্ষণ, সামুদ্রিক ও পাহাড়ি ঢলের পানির কারণে মহাসড়কটির অবস্থা সবচেয়ে বেশি খারাপ হয়েছে। কক্সবাজার সড়ক বিভাগের টেকনাফ উপবিভাগীয় প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বলেন, সকালে ক্ষতস্থান মেরামত করলে সন্ধ্যায় তা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কেননা প্রবল বর্ষণ অথবা ঢলের পানিতে সড়কের ইট-সুরকি ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তারপরেও কোনো রকমে ইটের কংকর এবং বালি দিয়েই আপাতত সামাল দেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।
সওজ নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, কক্সবাজারের সড়ক-মহাসড়কের এরকম নাজুক অবস্থা সরেজমিন পরিদর্শনের জন্য ঢাকা থেকে এসেছেন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী জুনায়েদ আহমদ শিবিবের নেতৃত্বে একটি দল। দলটি দুই দিন ধরে টেকনাফ থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত মহাসড়ক পরিদর্শন করে। কক্সবাজার সওজের আওতায় টেকনাফ থেকে শাহপরীর দ্বীপ পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ আঞ্চলিক সড়কটিও সামুদ্রিক জোয়ারের পানির তোড়ে খণ্ড খণ্ড হয়ে পড়েছে। দেশের সর্বশেষ সীমান্ত শাহপরীর দ্বীপের সঙ্গে বর্তমানে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ এ কারণে বন্ধ রয়েছে। কক্সবাজার সড়ক ও জনপথ অফিস সুত্রে আরো জানা গেছে, টেকনাফ পর্যন্ত ৩৭০টি ছোট-বড় ব্রিজ-কালভার্ট রয়েছে। এ সবের মধ্যেও কমপক্ষে অর্ধশতাধিক ঝুঁকিপূর্ণ। নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, বর্ষণ কমে গেলে মহাসড়কের কাজ শুরু করা হবে।
কালের কণ্ঠের সাতকানিয়া উপজেলা প্রতিনিধি মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, মহাসড়কের দোহাজারী অংশে ৭৫ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে কমপক্ষে ২০ কিলোমিটারজুড়ে খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে।
দোহাজারী সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ কামরুল আহসান কালের কণ্ঠকে জানান, ইতিমধ্যে ৪৫ লাখ টাকার মেরামতকাজ করা হয়েছে। এ অঙ্কের টাকায় মহাসড়কের ৭০০ মিটার এলাকার কাজ করা হলেও সেই কাজের কোনো চিহ্নই এখন অবশিষ্ট নেই। অভিযোগ রয়েছে- কাজে কারচুপির সুবিধার্থেই অনেক আগের টেন্ডারে বর্ষা মৌসুমের জরুরি কাজ করা হয়েছে। নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, এবার যে পরিমাণ বৃষ্টি হচ্ছে তাতে করে সড়ক টিকিয়ে রাখাই দায় হয়ে পড়েছে। শংখ নদীর ব্রিজটিও হয়ে পড়েছে ঝুঁকিপূর্ণ।
ঈদের পরে পর্যটকের ঢল নামবে কক্সবাজারে- এরকমই আশা স্থানীয় পর্যটন ব্যবসায়ীদের। কক্সবাজারের হোটেল-রেস্তরাঁ মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম সিকদার বলেন, 'এমনিতেই গেল বছর নানা কারণে পর্যটকের আগমন কম ঘটেছে। এবারও যদি সড়কের বেহাল দশার কারণে ব্যবসা মন্দ হয় আমরা যাব কোথায়?'

No comments

Powered by Blogger.