আদালতে প্রায় ৩০ লাখ মামলা বিচারাধীন- মামলা জট ১ by বিকাশ দত্ত

বিচারক সঙ্কট, সাক্ষীদের গড়হাজিরা, কিছু আইনজীবীর ভূমিকার কারণে দেশের উচ্চ ও নিম্ন আদালতে প্রায় ৩০ লাখ মামলা বিচারাধীন রয়েছে। মামলা দায়েরের চেয়ে নিষ্পত্তির হার অনেকাংশে কম। ফলে প্রতিদিন নতুন করে মামলাজটে যুক্ত হচ্ছে সিংহভাগ মামলা।


এর কারণ হিসেবে জানা গেছে, বিচারক স্বল্পতা, আইনজীবীদের ভূমিকা, সর্বোপরি মান্ধাতা আমলের দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা চলা। আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ বলেছেন, মামলাজট দূর করতে দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার কার্যবিধি সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এদিকে মামলাজটে আইনজীবীদের ভূমিকার কথা সরাসরি অস্বীকার করেছে আইনজীবীরা। তাঁরা বলেছেন, সনাতন পদ্ধতিগত কারণেই মামলা জটযুক্ত হচ্ছে। সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রার একেএম শামসুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেছেন, মামলার জট আদিকাল থেকেই চলে আসছে। যে হারে মামলা হয় নিষ্পত্তিও হয় সে হারে কম। বিচার পাওয়ার জন্য জনগণ মামলা করে থকে। তারা যদি আদালতে এসে হতাশা ব্যক্ত করেন তা হলে মামলা হবে না। কোন কোন মামলা ৮০ বা ৯০ সালের আবার কিছু মামলা আছে ১৯৭০ সালেরও। নিম্ন আদালতে এখনও একটি এজলাসে একাধিক বিচারক বসে বিচারকাজ পরিচালনা করছেন। একই সঙ্গে রয়েছে বিচারক সঙ্কট, জায়গার অভাব, সাক্ষীদের নানা ধরনের বিড়ম্বনা বিশেষ করে পুলিশ, ডাক্তার যাঁরা সাক্ষী হন তাঁরা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বদলি হবার কারণেও মামলা শুনানিতে বিঘœ ঘটে। পাশাপাশি খুনের মামলার বড় ধরনের বিষয় হলো ময়নাতদন্ত। এর রিপোর্ট ছাড়া মামলা হয় না। এটা দিতেও অনেক সময় দেরি হয়।
অন্যদিকে সুপ্রীমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক জনকণ্ঠকে বলেছেন, বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ হয়ে গেছে। এখন মামলাজট দূর করতে আইনমন্ত্রী বা সরকারের কোন ভূমিকা নেই। এখন সম্পূর্র্ণ দায়দায়িত্ব প্রধান বিচারপতির। যেমনটি জাতীয় সংসদের ক্ষেত্রে স্পীকার সব কিছু করে থাকেন। বদলি, পদোন্নতি, এ ক্ষেত্রেও প্রধান বিচারপতির ভূমিকাও একই রূপ। এখানে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী প্রধান বিচারপতি।
উল্লেখ্য, জনসংখ্যার পাশাপাশি মামলাও দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। সে তুলনায় নিষ্পত্তি কম হচ্ছে। যার ফলে প্রতিদিন নতুন করে জটে যুক্ত হচ্ছে মামলা। এর সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। উচ্চ আদালতে এখন বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ২,৭৯ ৯২৩টি। এর মধ্যে জানুয়ারি পর্যন্ত আপীল বিভাগে দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা ছিল ১২ হাজার ৪শ’ ৪১টি। হাইকোর্টে দেওয়ানি মামলা ছিল ৭৯ হাজার ৮ শ’ ৯০টি। ফৌজদারি ১ লাখ ৫৩ হাজার ১শ’ ২২টি। রিট ৪১ হাজার ৫ শ’ ৭৯টি। আদিম মামলা ৫ হাজার ৫শ’ ৩২টি। মোট ২ লাখ ৭৯ হাজার ৯শ’ ২৩টি। এ বছর ফাইলিং হয়েছে দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা মিলে ৪৪ হাজর ৬৮৬টি। নিষ্পত্তি হয়েছে ৬৮ হাজার ৪শ’ ২৫টি। এতে দেখা যায় প্রায় ২৪ হাজার মামলা অধিক নিষ্পত্তি হয়েছে।
২০১২ সালের ১ জানুযারি পর্যন্ত বিচারাধীন মামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে, ঢাকা বিভাগ দেওয়ানি মামলা ২ লাখ ১১ হাজার ৩৩৯টি। ফৌজদারি ১ লাখ ৪২ হাজার ৯৮৬টি। চট্টগ্রাম বিভাগে দেওয়ানি মামলা ১ লাখ ৩০ হাজার ৭৩০টি। ফৌজদারি ৭৪ হাজার ৫২৭। রাজশাহী বিভাগে দেওয়ানি মামলা ১ লাখ ৬৫ হাজার ১৪৮টি। ফৌজদারি মামলা ৭৮ হাজার ৫৪৬টি। খুলনা বিভাগে দেওয়ানি মামলা ১ লাখ ১৪ হাজার ৯৮টি। বরিশাল বিভাগে দেওয়ানি মামলা ৫১ হাজার ১৫৮টি। ফৌজদারি ১৩ হাজার ৪৮০টি। সিলেট বিভাগে দেওয়ানি মামলা ৩০ হাজার ৩১৬টি। ফৌজদারি ১৯ হাজার ১শ’ ৬১টি। মোট দেওয়ানি ৭ লাখ ১ হাজার ৭৮৯টি। ফৌজদারি ৩ লাখ ৭৪ হাজার ৩৭৫টি।
পাশাপাশি এ বছর ঢাকা বিভাগে সিভিল মামলা দায়ের হয়েছে ৩৮ হাজার ৮শ’। নিষ্পত্তি হয়েছে ১৪ হাজার ৫৯টি। এক বছরে ২৪ হাজার মামলা বেশি ফাইল হয়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগে দায়ের হয়েছে ১৭ হাজার ৮৬২টি। নিষ্পত্তি হয়েছে ৭ হাজার ১২৭টি। রাজশাহী বিভাগে দায়ের হয়েছে ২৪ হাজার ২৪১টি । নিষ্পত্তি হয়েছে ১৩ হাজার ৭৩৪টি। খুলনা বিভাগে দায়ের হয়েছে ২৭ হাজার ২৮৯টি। নিষ্পত্তি হয়েছে ১৯ হাজার ৫০৯টি। বরিশাল বিভাগে দায়ের হয়েছে ১০ হাজার ৭৭১টি। নিষ্পত্তি হয়েছে ৭ হাজার ৩৯৮টি। সিলেট বিভাগে দায়ের হয়েছে ১১ হাজার ৯৭৯টি। নিষ্পত্তি হয়েছে ৮ হাজার ৫টি। এ মামলাগুলো জেলা ও দায়রা জজ এবং সমমান ট্রাইব্যুনালে হয়েছে।
পাশাপাশি ম্যাজিস্ট্রেসি কোর্টে ফৌজদারি মামলা জানুয়ারি পর্যন্ত ঢাকা বিভাগে বিচারধীন আছে ৩ লাখ ১১ হাজার ৬৬টি। আগের বছর অর্থাৎ ২০১১ সালের দায়েরকৃত মামলা ২ লাখ ৮২ হাজার ৫৮৮টি। নিষ্পত্তি হয়েছে ২ লাখ ৪৪ হাজার ২০৫টি। এর মধ্যে আগের বছর বাকি রয়েছে ৩৮ হাজার মামলা। চট্টগ্রাম বিভাগে দায়ের হয়েছে ১ লাখ ১৯ হাজার ৪৭৭টি। নিষ্পত্তি হয়েছে ১ লাখ ১৮ হাজার ৬৬টি। বিচারাধীন রয়েছে ১ লাখ ২৪ হাজার ৪৭৮টি। রাজশাহী বিভাগে মামলা দায়ের হয় ১ লাখ ৪৫ হাজর ৮৭৯টি। নিষ্পত্তি হয়েছে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৭০টি। বিচারাধীন রয়েছে ১ লাখ ৪২ হাজার ২০টি। খুলনা বিভাগে মামলা দায়ের হয়েছে ৭২ হাজার ৪৭৮টি। নিষ্পত্তি হয়েছে ৭৮ হাজার ৪৫৮টি। বিচারাধীন রয়েছে ৭৯ হাজার ৬৭৪টি। বারিশাল বিভাগে দায়ের হয়েছে ৫০ হাজার ৭০৭টি। নিষ্পত্তি হয়েছে ৫০ হাজার ৮শ’ ২৩টি। বিচারাধীন আছে ৫৪ হাজার ২৯টি। সিলেট বিভাগে দায়ের হয়েছে ৩৪ হাজার ৯৪০টি। নিষ্পত্তি হয়েছে ৩৩ হাজার ৭০৭টি। বিচারাধীন রয়েছে ৫২ হাজার ২৫১টি।
সূত্র মতে, ২০০৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত হাইকোর্টে বিচারাধীন ছিল ২ লাখ ৬২ হাজার ৩৪৫টি। পরের বছর ২০০৮সালের ৩১ ডিসেম্বর সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৯৩ হাজার ৯০১টি। ২০০৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ লাখ ২৫ হাজার ৫৭১টিতে। এর মধ্যে ফৌজদারি মামলার সংখ্যা ১ লাখ ৯৯ হাজার, দেওয়ানি ৮০ হাজার ২৮৮টি। ২০০৮ সালে হাইকোর্টে দায়ের হয় ৫২ হাজার ৫৯০টি মামলা। এর মধ্যে দেওয়ানি মামলার সংখ্যা ৬ হাজার ৭২৮টি। এবং ফৌজদারি মামলার সংখ্যা ৪৫ হাজর ৮৬২টি। ২০০৯ সালে নতুন মামলা জমা হয় ৫২ হাজার ৪৮৮টি। এর মধ্যে দেওয়ানি ৭ হাজার ৩২টি। রিট ও ফৌজদারি মামলার সংখ্যা ৪৫ হাজার ৪৫৬টি। এ বছর ৩০ জুন পর্যন্ত মোট মামলা ২,৮৬,৪৫০টি। নিষ্পত্তি হয় ৩৫৩১টি। এখন পেন্ডিং আছে ২৮২৯১৩টি মামলা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সুপ্রীমকোর্টের এক আইনজীবী জনকণ্ঠকে বলেছেন, বর্তমান যে হারে মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে সে হারে নিষ্পত্তি হলে আরও ৪০ বছর সময় লাগবে। এই সময়ে আরও নতুন মামলা জমবে সোয়া ১৯ লাখ। এ নিষ্পত্তি করতে আরও সময় লাগবে।
হাইকোর্টে অবসর যাবার পর বর্তমানে ১০০ জন বিচারপতি আছেন। আপীল বিভাগে বিচারপতি ৭ জন। অন্যদিকে নিম্ন আদালতে প্রায় ১৫৯৮ জন বিচারক রয়েছেন, যা মামলার তুলনায় খুবই অপ্রতুল। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, হাইকোর্টে এক জন বিচারপতির হাতে গড়ে ১৪০০ এবং নিম্ন আদালতে একজন বিচারকের হাতে গড়ে ৩১০০টি মামলা থাকে। কোনভাবেই একজন বিচারপতির পক্ষে নিষ্পত্তি করা সম্ভবপর নয়।
এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ বলেছেন, মামলা জট দূর করতে দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার কার্যবিধি সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দেওয়ানি মামলার বিধি সংশোধনের বিষয়টি এখন স্ট্যান্ডিং কমিটির কাছে আছে। তারা সেখানে যাচাই বাছাই করছে। আর ফৌজদারি মামলার বিধি সংশোধনের বিষয়টি মন্ত্রণালয়ে রয়েছে। আইন কমিশন সংশোধন করে একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছে। মন্ত্রণালয় তা যাচাই বাছাই করছে। শীঘ্রই এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে। তিনি আরও বলেন, এখন থেকে মামলা পরিচালনায় সময় সীমা বেঁধে দেয়ার পাশাপাশি বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি। তিনি বলেন, এতে করে তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে মামলা করার প্রবণতা দূর হবে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে দেওয়ানি কার্যবিধি যা রয়েছে তা ১৯০৮ সালের। মামলা নিষ্পত্তিতে বিভিন্ন স্তরে কোন সময়ের উল্লেখ নেই। আর এ কারণে লাখ লাখ মামলা বছরের পর বছর ঝুলে রয়েছে। দেশের নিম্ন আদালতগুলোতে প্রায় ২০ লাখ মামলা রয়েছে।
সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক শ.ম রেজাউল করিম বলেছেন, পদ্ধতিগত কারণে মামলা দীর্ঘ জটযুক্ত হচ্ছে। সনাতনি পদ্ধতিগত কারণে মামলাজট বেড়ে যাচ্ছে। এ কারণে অনেক মামলার সংশ্লিষ্ট পক্ষের মতে নোটিস জারি হয় বছরের পর বছর বিলম্বে। অপরদিকে নোটিস জারি যথাযথ না হবার কারণে পুনরায় নোটিস জারি করতে হয়। সংশ্লিষ্ট সেকশনে নোটিস জারি হয়ে ফেরৎ আসায় পরে ভুল নথিতে এ বিষয়গুলো উল্লেখ করে নোট প্রদান করা হয় না। জারির তথ্য সেকশনেই পড়ে থাকে। কোন কোন ক্ষেত্রে হারিয়েও যায়। এ কারণে মামলা শুনানির জন্য প্রস্তত হতেই দীর্ঘ বিলম্ব হয়। পুনরায় মামলাকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আদালতের শুনানির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত অনিবার্য হলেও তা করা হয় না। আদালতের এখতিয়ার পরিবর্তন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুনরায সেকশনে চলে যায়। নতুন করে তালিকা অন্তর্ভুক্ত করতে শুনানিতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। ফলে শুধু আইনজীবীদের অভিযুক্ত করা যুক্তিযুক্ত নয়।

No comments

Powered by Blogger.