সমাজ-শিশুটির জবানবন্দি কি সরকার শুনবে? by জোবাইদা নাসরীন

পত্রিকার পাতায় যখন ঢাকার অদূরে সাভারে সাত বছরের মেয়েটিকে ধর্ষণ এবং তাকে গর্তে ফেলে রাখার ঘটনা পড়ছিলাম, তখন মনে হচ্ছিল, আমাদের আশপাশের হাজারো নারী-শিশুর কথা। ঢাকা শহরে খেলার জায়গা না থাকলেও মফস্বলে কিংবা গ্রামাঞ্চলে এখনো শিশুরা পাশের বাড়ি, মাঠ কিংবা উঠানে খেলে।


তাদের খেলা, আনন্দে উচ্ছল হয়ে ওঠা আমাদের মনে করিয়ে দেয় হারিয়ে যাওয়া শৈশবের দিনগুলোকে। এই শীতের মৌসুমে ৭-১০ বছর বয়সী শিশুদের অনেকেরই একটু দূরের কোনো জায়গায় গিয়ে চড়ুইভাতি রান্নায় মেতে ওঠার কথা। কিন্তু এখন খুব কম জায়গাতেই শিশুদের এই আনন্দ লক্ষ করা যায়। কারণ অনেক। সবচেয়ে বড় কারণ নিঃসন্দেহে নারী-শিশুর নিরাপত্তা। এমনিতেই আমাদের দেশে নারী ও শিশুদের কোনো শৈশব নেই। শৈশবের আনন্দ-উচ্ছলতা তাদের জীবনে আসে না, আসলে আসতে দেওয়া হয় না। সে যে নারী, তাকে তা নানাভাবে শিশু বয়স থেকেই বুঝিয়ে দেওয়া হয়। সেই বোঝানোর বাইরেও আরও কিছু থাকে, যা তার এই বয়সে বোঝার কথা নয়।
কিন্তু সাভারে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হওয়া মেয়েটির সাত বছরের জমিন তখন পর্যন্ত জানত না, এই ছোট্ট শরীরটিই তার শত্রু, তার বয়স যতই হোক না কেন। মেয়েটি পৃথিবী কী, তা-ই জানত না হয়তো। আশপাশের বন্ধুবান্ধব চেনা জগৎ নিয়েই হয়তো সে পৃথিবীকে দেখছিল। প্রজাপতির মতো উড়ে উড়ে বন্ধুদের সঙ্গে খেলায় মেতেছিল। কিন্তু জীবন তাকে এই বয়সেই চিনিয়ে দিয়েছে অন্য কিছু। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নির্যাতনের একটির সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে গেছে ইতিমধ্যেই। পত্রিকা থেকে আরও জানা গেছে, ধর্ষণকারী তাকে ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাকে গর্তে ফেলে গিয়েছিল। মেয়েটি এতটা নির্যাতনের পর রক্তাক্ত অবস্থায় শীতের মধ্যে আগের দিন সন্ধ্যা থেকে পরের দিন সকাল পর্যন্ত সেই গর্তে পড়ে ছিল এবং গর্ত থেকে ওঠার চেষ্টা করেছে, বাঁচার চেষ্টা করেছে। রক্তে ভেজা মেয়েটিকে যখন প্রতিবেশী উদ্ধার করেন, তখনো সে বাঁচার আকুতি করছিল। যে পৃথিবীতে বাঁচার তার এত আকুতি, সেই পৃথিবীর মানুষই তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে নিষ্ঠুর এক পৃথিবীর সঙ্গে। হ্যাঁ, মেয়েটিকে বেঁচে থাকতেই যে হবে। অন্যদের জানাতে হবে, পৃথিবীতে বসবাসকারী হিংস্র মানুষগুলোর কাহিনি। মেয়েটির বেঁচে থাকা আমাদের সেই সাহসের দিকেই এগিয়ে নিয়ে যায়।
মেয়েটি যখন বাইরে অন্য বন্ধুদের সঙ্গে খেলায় মগ্ন, তখন কর্মজীবী, খেটে খাওয়া পরিবারের মেয়েটির বাবা-মা বাসায় ছিলেন না। নিজেদের প্রতিদিনকার জীবনযুদ্ধে তাঁরা ব্যস্ত ছিলেন। কাজ শেষে বাড়িতে ফিরে এসে তাঁরা মেয়েটিকে খুঁজে পাননি। পরে রক্তাক্ত অবস্থায় মেয়েকে পেয়েও তাঁরা এ ঘটনার প্রতিকার চেয়ে এখন পর্যন্ত কোনো মামলা করেননি। এই রাষ্ট্রে, এই সমাজব্যবস্থায় বসবাস করে তাঁরা এতটুকু বুঝে গেছেন, তাঁদের ন্যায়বিচার পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ, নির্যাতনকারীরা যে অনেক বেশি ক্ষমতাশালী। তাই তাঁরা মামলা করতেও ভয় পাচ্ছেন।
দিন দিন কেন যেন সমাজ দানব উৎপাদন করছে বেশি। দানবীয় তৎপরতায় যেন আমাদের বিবেককে বোবা করে দেওয়া হচ্ছে। বাংলা একাডেমী এবং আণবিক শক্তি কমিশন অফিসের মাঝামাঝি একটি জায়গায় বেশ কয়েক বছর ধরে প্রায়ই একজন নারীকে দেখি। দেখেই বোঝা যায়, তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন। একটু খাবারের আশায় এদিক-ওদিক তাকান, কখনো হাসেন কিংবা টাকা চান। কখনো দেখি, নিজেই নিজের সঙ্গে হাজারো কথা বলছেন, কিংবা অন্যের সঙ্গে কোনো কথা বলার চেষ্টা করছেন। আশপাশের লোকজন তাঁকে ‘পাগলি’ বলে সম্বোধন করে।
গত বছরের মাঝামাঝিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এশিয়াটিক সোসাইটিতে যাওয়ার সময় সেই নারীকে আবার দেখি। তাঁর শারীরিক পরিবর্তন আমার চোখে পড়ে। তিনি সন্তানসম্ভবা। কে এই কাজটি করল? ঢাকা শহরে সবাই নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। এই ব্যস্ততার মধ্যে মানসিকভাবে অসুস্থ, আশ্রয়হীন একজন নারীর শারীরিক পরিবর্তন নিয়ে আমরা বিচলিত হই না। সেই নারী আমাদের বোধের জায়গায় আঘাত করলেও সেই বোধকে আমরা নড়াচড়া করতে দিই না। দিই না, কারণ তিনি সমাজ বা রাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নন। তিনি আমাদের নাগরিক কিংবা মধ্যবিত্ত রোমান্টিক কিংবা কপাট জীবনের অংশ নন। একজন ‘পাগলি’র শারীরিক পরিবর্তন আমাদের জগৎ-সংসারে কোনো আঁচড় ফেলে না। আমরা জানতে চাইনি কে সেই লোক, যে মানসিকভাবে অসুস্থ এই নারীর ওপর অত্যাচার করেছে। আমাদের আশপাশেরই কেউ না কেউ হয়তো নারীটিকে ধর্ষণ করেছে। আমি নিশ্চিতভাবেই জানি, তাঁর ধর্ষণকারী নিরাপদে আছে। কারণ সে জানে, তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা হবে না কিংবা একজন ‘পাগলি’র কথা সমাজ বিশ্বাস করবে না। ‘সত্য’ আসলে এভাবেই নির্মিত হয় আর এভাবেই চাপা পড়ে, ডিগবাজি খায়।
বছর দু-এক আগে টঙ্গীতে ছয় বছরের মেয়েকে রেখে কাজে গিয়েছিলেন তার দরিদ্র বাবা-মা। ফিরে এসে বাসায় পেয়েছেন ছোট্ট মেয়েটির লাশ। নরপশুরা মেয়েটিকে ধর্ষণের পর হত্যা করেছে। ফুটফুটে মেয়েটি যখন মৃত্যুর পর খবরের কাগজের মাধ্যমে আমাদের সামনে হাজির হলো, তখনো আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারিনি তার ধর্ষণকারী এবং হত্যাকারীদের বিচার এই রাষ্ট্র করবে?
জীবন আমাদের কুৎসিত অভিজ্ঞতা দিয়ে শুধুই শেখায়, চেনায় পৃথিবীকে, ক্ষমতার সম্পর্ককে। আর আমরা জীবন চিনে, জীবন ধারালো করে প্রতিবাদের সুর তুলি, এক ঘটনা থেকে আরেক ঘটনায় চোখ রাখি; কিন্তু কিছুতেই যেন এই সময়কে, জীবনের দুর্বিষহ অভিজ্ঞতাগুলোকে অতিক্রম করতে পারছি না। আমরা একে অন্যের কাছে হাজির হই মাত্র, কিন্তু রাষ্ট্র, সমাজের হাজিরা আমরা পাই না। ছোট্ট মেয়েটির সাত বছরের রক্তাক্ত জমিনের জবানবন্দি কি সরকার শুনবে দয়া করে?

 জোবাইদা নাসরীন: পিএইচডি গবেষক, ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য।
zobaidanasreen@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.