শ নি বা রে র বিশেষ প্রতিবেদন-দ্বীপ জেলার আশীর্বাদ by নেয়ামত উল্যাহ

ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার আলীগাঁও গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক আবদুস শহীদ (৯৯)। বছর দুয়েক আগে চোখে ছানি পড়ে তাঁর। ধীরে ধীরে প্রায় দৃষ্টিহীন হয়ে পড়েন তিনি। টাকাপয়সাও নেই যে অস্ত্রোপচার করাবেন।এমন অসহায় পরিস্থিতিতে তাঁকে কে যেন জানালেন একটি হাসপাতালের কথা, সেখানে বিনা পয়সায় চিকিৎসা হয়।


একদিন সেই হাসপাতালে গিয়ে সম্পূর্ণ বিনা খরচে চোখের অস্ত্রোপচার করালেন আবদুস শহীদ। এখন তাঁর চোখ ভালো হয়ে গেছে। দেখতে পাচ্ছেন সবকিছু। অনুভূতি জানতে চাইলে কিছু বলার আগেই হু হু করে কেঁদে ফেলেন।
শুধু আবদুস শহীদই নন, গত ২৫ ডিসেম্বর তাঁর মতো আরও ৩৯ জনের চোখে বিনা পয়সায় অস্ত্রোপচার করা হয় ওই হাসপাতালে। এটির নাম নিজাম-হাসিনা ফাউন্ডেশন হাসপাতাল। ঠিকানা ভোলা সদর।
নিজাম-হাসিনা ফাউন্ডেশন শুধু হাসপাতাল গড়ে অসহায় রোগীদের বিনা পয়সায় চিকিৎসাসেবাই দিচ্ছে না, এই ফাউন্ডেশনের অধীনে আরও বেশ কিছু সেবামূলক কাজ হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা, দুস্থ বিধবা ভাতা, দরিদ্র শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান, এতিমখানা, বৃদ্ধাশ্রম পরিচালনা, শীতবস্ত্র বিতরণ, বিদ্যালয় ও মসজিদের ভবন নির্মাণ, বিদ্যালয়ে শিশুদের দুপুরের খাবার সরবরাহ। এ ছাড়া ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল গড়ে তোলারও প্রক্রিয়া চলছে।
শুরুর কথা: নিজাম-হাসিনা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দিন। ভোলার দৌলতখান উপজেলায় জন্ম তাঁর। নদীভাঙনের শিকার মানুষের দুঃখ-কষ্ট দেখে বড় হয়েছেন। একপর্যায়ে তাঁদের নিজের বাড়িও নদীতে ভেঙে যায়। তাঁর ভাষায় ‘নদী ভাঙার পরে আমাদের পরিবার অনেকটা নিঃস্ব হয়ে যায়। বাবা বিনা চিকিৎসায় মারা যান। আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, তখন মা মারা যান। মা মারা যাওয়ার খবরও তাৎক্ষণিকভাবে পাইনি। মাও অনেকটা অবহেলা-অনাদরে মারা গেছেন। এসব কষ্ট থেকেই মানবসেবায় নিজেকে সম্পৃক্ত করেছি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেন নিজাম উদ্দিন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার পর এখন তিনি একটি বিমা কোম্পানির অংশীদার।
তাঁর জীবনের দুঃখ-কষ্ট থেকে মানবসেবার তাগিদে ২০০০ সালে নিজের ও স্ত্রী হাসিনা বেগমের নামে গড়ে তোলেন ‘নিজাম-হাসিনা ফাউন্ডেশন’। নিজের সঞ্চিত অর্থের একটি অংশ ফাউন্ডেশনের তহবিলে দেন। এখন নিজস্ব আয়েই চলছে এই ফাউন্ডেশন। ফাউন্ডেশন গঠনের আগে থেকেই নিজের উদ্যোগে শীতবস্ত্র বিতরণ ও চক্ষুশিবিরের মাধ্যমে অসহায় রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া শুরু করেন নিজাম উদ্দিন।
নিজাম-হাসিনা ফাউন্ডেশন হাসপাতাল: ভোলা সদর হাসপাতালসহ বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বেশির ভাগ সময়ই থাকে চিকিৎসক সংকট। এ অঞ্চলের নদীভাঙনকবলিত মানুষের এত টাকাও নেই যে তারা বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নেবেন। অসহায় এসব মানুষের আশ্রয় নিজাম-হাসিনা ফাউন্ডেশন হাসপাতাল।
২০১০ সালের ১ এপ্রিল ভোলা সদর উপজেলার উকিলপাড়ায় চার একর জমির ওপর এ হাসপাতাল গড়ে তোলা হয়। এখানে পাঁচ টাকা দিয়ে একটি টিকিট নিতে হয়। এরপর সম্পূর্ণ বিনা খরচে রোগনির্ণয়, অস্ত্রোপচার, থাকা-খাওয়া, ওষুধ এবং একেবারে নিঃস্ব রোগীদের যাতায়াত খরচ দেওয়া হয়। বর্তমানে এখানে তিনজন নিয়মিত চিকিৎসক ও পর্যাপ্ত নার্স রয়েছেন। শুরু থেকে এ পর্যন্ত এ হাসপাতালের প্রায় পাঁচ হাজার চক্ষু রোগীর চিকিৎসা ও অস্ত্রোপচার করা হয়েছে।
ভোলা সদর থেকে প্রায় ১৫০ মাইল দূরের মনপুরা উপজেলার দাসের হাট থেকে নিজাম-হাসিনা ফাউন্ডেশন হাসপাতালে চোখের অস্ত্রোপচার করিয়েছেন সালেকা খাতুন (৫২)। তাঁর স্বামী ফখরুদ্দিন দরিদ্র জেলে। দুই চোখে ছানি পড়ে দৃষ্টিহীন হয়ে পড়েন। অস্ত্রোপচারের পর দৃষ্টি ফিরে পেয়ে সালেকা বলেন, ‘আমার অ্যান কোয়াল (কপাল) অয়নো টিয়া দিয়া ছানি কাডামু, নিজাম হাসপাতালের লাই আমি অ্যাহোন চোহে দেহি।’
হাসপাতালের পরিচালক আবদুুল মালেক বলেন, ‘জীবনে বহু জেলায় চাকরি করেছি। একদম বিনা পয়সায় চিকিৎসা, অস্ত্রোপচার, চশমা, ওষুধ, থাকা-খাওয়া কোথাও দিতে দেখিনি।’
শীতবস্ত্র ও ভাতা: ফাউন্ডেশন ২০০০ সাল থেকেই প্রতিবছর দরিদ্র ও শীতার্ত মানুষের মধ্যে বস্ত্র বিতরণ করছে। চলতি বছরও চলছে শীতবস্ত্র বিতরণ।
২০১০ সাল থেকে ২০০ জন বয়স্ক দুস্থ বিধবাকে প্রতি মাসে ৫০০ টাকা করে ভাতা দেওয়া হচ্ছে। একই সময় থেকে ২০০ দুস্থ মুক্তিযোদ্ধাকে মাসে এক হাজার টাকা করে সম্মানী ভাতা দেওয়া হচ্ছে। ভোলার প্রবীণ সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা আবু তাহের বলেন, ‘নিজাম-হাসিনা ফাউন্ডেশন মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী দিয়ে দায়িত্ববোধের পরিচয় দিচ্ছে।’
ফাউন্ডেশন থেকে বর্তমানে ৬০ জন শিক্ষার্থীকে উচ্চশিক্ষার জন্য বৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। এই শিক্ষার্থীরা মাসে এক হাজার থেকে আট হাজার টাকা পর্যন্ত বৃত্তি পাচ্ছে। এ ছাড়া ভোলার দুস্থ সাংবাদিক, শিক্ষক, ছাত্রসহ সাধারণ মানুষের এককালীন সহায়তাও করছে ফাউন্ডেশন। পাশাপাশি জেলার আটটি মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনের বেতনও দিচ্ছে এ ফাউন্ডেশন।
ভবন নির্মাণ: ফাউন্ডেশনের অর্থে ভোলায় গড়ে উঠছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাকা ভবন। এর মধ্যে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয় ভবন, ডায়াবেটিস হাসপাতাল ভবন ও পুলিশ লাইন মসজিদ ভবনের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। নিজাম-হাসিনা ফাউন্ডেশন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, উকিলপাড়া মসজিদ, মিয়াবাড়ির দরজা মসজিদ ও ভোলা প্রেসক্লাব ভবন নির্মাণের কাজ চলছে।
স্কুল ফিডিং: গ্রামের বিদ্যালয়ে যেতে উৎসাহিত করতে স্কুল ফিডিং কর্মসূচি হাতে নেয় ফাউন্ডেশন। গত বছর থেকে ভোলা সদর ও দৌলতখান উপজেলার মেঘনাপারের তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হাজারেরও বেশি শিশুকে দুপুরে নাশতা দেওয়া হচ্ছে ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে।
সদর উপজেলার ধনিয়া খন্দকারবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি তাজুল ইসলাম জানান, এ অঞ্চলের অনেক শিশুর কপালে নিয়মিত তিন বেলা খাবারই জোটে না। অনেক শিশুই অপুষ্টিতে ভোগে। ফাউন্ডেশনের দেওয়া নাশতা তাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। বিদ্যালয়ে শিশুদের উপস্থিতিও বেড়েছে।
এতিমখানা, বৃদ্ধাশ্রম ও মেডিকেল কলেজ: ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে ভোলা সদরের উকিলপাড়ায় ২০০ শয্যার এতিমখানা ২০০২ সালে ও ৩০ শয্যার বৃদ্ধাশ্রম ২০০৭ সালে চালু হয়। পৌর কাঠালিতে ২০০ শয্যার বৃদ্ধাশ্রম ও একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নির্মাণের প্রক্রিয়া চলছে।
তাঁরা যা বলেন: ভোলা জেলা প্রশাসক মেসবাহুল ইসলাম বলেন, ‘নিজাম উদ্দিন একজন সমাজ গড়ার কারিগর, জনসেবক, সর্বোপরি ভালো মানুষ। তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে অসহায় মানুষকে নানা সেবা দিচ্ছেন। নিজাম-হাসিনা ফাউন্ডেশন ভোলার জন্য আশীর্বাদ।’
একই মত প্রকাশ করেন ভোলার পৌর মেয়র মনিরুজ্জামান, ‘আমরা যাঁরা সমাজসেবা করি, তাঁদের কোনো স্বার্থ থাকে। কিন্তু নিজাম-হাসিনা ফাউন্ডেশন নিঃস্বার্থভাবে দরিদ্র মানুষের সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এতে এ অঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সংখ্যা কমবে।’
নিজাম উদ্দিনের কথা: ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘জীবনে অনেক কষ্ট করেছি। ইচ্ছে ছিল অর্থবিত্তের মালিক হলে দেশ ও বঞ্চিত জনগণের সেবা করব। তবে কখনোই রাজনীতিতে নামব না।’
নিজাম উদ্দিন তাঁর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয়টি জানালেন এভাবে, ‘এখনো ভোলায় প্রতিদিন বিনা চিকিৎসায় মানুষ মারা যায়। তাই ইচ্ছা আছে একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল করার। এই ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিয়ে আপাতত সেই পথেই এগোচ্ছি।’
নিজাম উদ্দিন তাঁর ইচ্ছার বাস্তবায়নে সবার সহায়তা ও দোয়া কামনা করেন।

No comments

Powered by Blogger.