আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৩৩)-প্রতিটি মানুষই যেন একটি দ্বীপ by আলী যাকের

স্কুল-কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে ঢুকতে পারাটাই একটা রোমাঞ্চকর ব্যাপার। এ এক ভিন্ন দুনিয়া। প্রথমেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে হকচকিয়ে যা আবিষ্কার করলাম, তা হলো মেয়েদের উপস্থিতি। স্কুল-কলেজ জীবনে ছেলেদের সঙ্গে কাটিয়ে এই প্রথম কো-এডুকেশনাল শিক্ষাজগতে প্রবেশ করলাম। যদিও তখনকার চিত্রটি ঠিক আজকের মতো ছিল না।


অর্থাৎ পরিমিতসংখ্যক মেয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করত। তবুও কিছু কিছু বিভাগে যেমন_ইংরেজি, বাংলা, সমাজবিজ্ঞান অথবা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনেক মেয়েই ভর্তি হতো। স্কুলে থাকতেই বন্ধুবর ইমরুল চৌধুরীর কল্যাণে জীবনানন্দ দাশ ও রবীন্দ্রনাথের আধুনিক কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয় সেই কোনোকালে হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে সেই পরিচিতি পূর্ণতা পেল। রবীন্দ্রনাথের ক্যামেলিয়ার সেই অবিস্মরণীয় প্রথম চরণটি, 'নাম তার কমলা। দেখেছি তার খাতার ওপরে লেখা_সে চলেছিল ট্রামে, তার ভাইকে নিয়ে কলেজের রাস্তায়। আমি ছিলেম পিছনের বেঞ্চিতে।' মনে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে অনেক খাতার ওপরে এই 'কমলা' নামটি খুঁজে খুঁজে মরেছি। সার্থক হইনি, সবাই তো আর রবীন্দ্রনাথের ভাগ্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না!
ইউনিভার্সিটির সব কিছুই যে ভালো লাগত, তা কিন্তু নয়। আজীবন স্ব-ইচ্ছায় এক নিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতিতে শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনের মধ্যে আমার বিচরণ। স্ব-ইচ্ছায় বললাম এই কারণে যে আমার মা-বাবা, ভাইবোন এবং অন্যান্য ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন মিলে যে ভুবন, সেই ভুবনের প্রতি আমার ছিল দুর্নিবার আকর্ষণ। যেখানেই থাকি না কেন, ফিরে যেতাম তাদেরই সানি্নধ্যে। এই স্ব-আরোপিত শৃঙ্খলটি আমার জন্য অত্যন্ত আনন্দদায়ক ছিল। আর যে স্কুল-কলেজে পড়েছি, সেখানেও মোটামুটি একটা এমন পরিস্থিতি ছিল যে প্রথাসিদ্ধ নিয়ম মেনে চলায় আমি ছিলাম অভ্যস্ত। সেখান থেকে বের হয়ে এসে এই যে বিস্তীর্ণ একটি ক্ষেত্রে আমি দাঁড়ালাম, এখানেই প্রথম আমার বোধোদয় হলো_অন্তর্মুখী হওয়া বলে একটি বিষয় আছে। বর্তমানে যাকে নিজস্ব জায়গা কিংবা পারসোনাল স্পেস বলা হয়ে থাকে। প্রতিটি মানুষই যেন একটি দ্বীপ। এখানে কেউ কারো প্রতি নজর না দেওয়াটাই কাম্য। এখানে আমার নিজস্ব জীবন আমারই। আমি না চাইলে কারো সাধ্য নেই আমার ধারে-কাছে আসার। অথচ আমি তো সবার সানি্নধ্যেই বড় হয়ে উঠেছি। সবার সব রকম কথা শুনেছি। কেননা তাঁরা চেয়েছেন যে আমি শুনি। প্রত্যুত্তরে আমার কথাও আমি বলেছি, তাতে কোনো বাধা ছিল না। অর্থাৎ মানুষের প্রতি মানুষের এই যে সহজাত আগ্রহ, এটা পারিবারিক কিংবা সমাজবদ্ধ অঙ্গনের বাইরে এসে হঠাৎ যেন কোথায় হারিয়ে গেল। এত মানুষের মধ্যেও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে একাকিত্ব আমায় পেয়ে বসল। এটা এক ধরনের বিষণ্নতা নিয়ে এসেছিল আমার তখনকার জীবনে। একে তো সদ্য বাবাকে হারিয়েছি, তার পর আবার মায়ের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে ক্যান্সারের ঝড়-ঝাপটা। অতএব, ইউনিভার্সিটির বিচিত্র ও বর্ণময় পরিবেশ আমাকে সম্মোহিত করতে পারেনি। তবুও ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি যখন হয়েছি, চালিয়ে যেতেই হবে। আমিও চালিয়ে যেতে লাগলাম, কিন্তু ছুটির দিন ব্যস্ততা বেড়ে যায় পড়ার দিনের চেয়ে। আমাদের বাড়ি, ধূপখোলার মাঠ, মাঠসংলগ্ন আমবাগান, আমার পাড়া_এসব ছেড়ে বেরোতেই ইচ্ছা করে না। আমাদের ব্যাচে সমাজবিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীরা তিন বছর তিনটি ভবনে ক্লাস করেছি। শুরু করেছিলাম বিখ্যাত আমতলাসংলগ্ন আর্টস ফ্যাকাল্টির পুরনো ভবনে। এ ভবনটি এখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অন্তর্গত। বস্তুতপক্ষে তখন যেটা মধুদার ক্যান্টিন ছিল, সেটা এখন ওই হাসপাতালের ইমার্জেন্সি বিভাগ। এই সেই আমতলা, যেখানে সমবেত হয়েছিলেন ভাষাসৈনিকরা এবং সম্মিলিতভাবে এগিয়ে গিয়েছিলেন পাকিস্তান সরকার কর্তৃক আরোপিত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার জন্য। এখানে আমাদের অনার্স ও সাবসিডিয়ারি উভয় ক্লাস হতো যত দূর মনে পড়ে। এই ভবনে ইংরেজি সাবসিডিয়ারি ক্লাসগুলো এখনো স্পষ্ট মনে আছে। বোধ হয় সেই সময় আমার ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি দুর্বলতাই এর প্রধান কারণ। মনে পড়ে, প্রয়াত অধ্যাপক আবু হেনাকে। তিনি আমাদের শেকসপিয়ারের 'ওথেলো' নাটকটি পড়াতেন। এখনো সেই স্মৃতি আমার মনে স্পষ্ট। ওই ভবনের দরজাগুলো ছিল ভীষণ উঁচু। হেনা স্যার ক্লাসে ঢুকেই দরজা দুটো বন্ধ করে দিতেন। তারপর ক্লাসঘরের সব আলো জ্বেলে দিতেন। অতঃপর আমাদের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে আস্তে আস্তে প্রায় নিঃশব্দে ল্যাকটার্নের কাছে এসে মৃদুস্বরে ইংরেজিতে বলতেন, 'মঞ্চের পর্দা সরে গেছে, আলো জ্বলে উঠেছে, ক্রোধোন্মত্ত ওথেলোর প্রবেশ। সে একটি জীবনের আলো নিভিয়ে দেওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছে। 'ঝযধষষ ও ঢ়ঁঃ ড়ঁঃ ঃযব ষরমযঃ ধহফ ঃযবহ ঢ়ঁঃ ড়ঁঃ ঃযব ষরমযঃ!' আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওথেলোর সঙ্গে, ডেসডিমোনার সঙ্গে এক অনির্বচনীয় সম্মোহনের দোলাচলে শেকসপিয়ারের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যেতাম। শহীদ অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা আমার বড় প্রিয় মানুষ ছিলেন। তিনি আমাদের পড়াতেন টমাস হার্ডির 'টেস অব দ্য ডি-আরবারভিল'। ভিক্টোরিও যুগে লেখা এই উপন্যাস আমাকে বাবার কথা মনে করিয়ে দিত। তাঁর কাছে ওই যুগের ইংরেজি সাহিত্যের অনেক গল্প শুনেছি এর আগে। 'টেস' উপন্যাসটিতে অনেক কিছু আছে, যা আমাদের গ্রামীণ সমাজে নিত্যই দেখা যায়। টমাস হার্ডিকে আপন ভাবার এ-ও একটি কারণ ছিল। তবে সব ছাড়িয়ে জ্যোতির্ময় স্যারের সেই মিষ্টি হাসিটি এবং প্রচণ্ড আবেগ দিয়ে উপন্যাসটি পড়ানোর যে সুখস্মৃতি আমার আছে, তা আমি জীবনে কোনো দিন ভুলব না।

(চলবে...)

No comments

Powered by Blogger.