মৃদুকন্ঠ-বিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কেন? by খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ

কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে ভিকটিম বা নির্যাতিত ব্যক্তি বিচার চান, অবলোকনকারীরা বিচার চান। সাধারণ নাগরিকরাও বিচার চান। এটাই সভ্য জগতের স্বাভাবিক রীতি। কারণ, হত্যার বিপরীতে হত্যা সংঘটিত হলে হত্যা প্রক্রিয়াটি যুগ যুগ ধরে চলতে থাকে। যেমনটা আদিম সমাজে, এমনকি মধ্যযুগেও প্রত্যক্ষ করা যায়।


আইয়ামে জাহেলিয়াত বা অন্ধকার যুগে আরবে গোত্রে গোত্রে হত্যা-সহিংসতা চলমান থাকত বংশ পরম্পরায়। একটি গোত্র গোত্রস্থ কোনো ব্যক্তির হত্যার প্রতিশোধ নিত অন্য গোত্রের কাউকে হত্যা করে। আবার তারাও আক্রান্ত হতো হত্যাকারী হিসেবে। পারস্পরিক হত্যাচক্রের বূ্যহ ভেদ করে বেরিয়ে আসতে পারত না কেউই, পাছে কেউ দুর্বল ভাবে তাদের। বংশ পরম্পরায় সহিংসতার হত্যাযজ্ঞে মৃত্যুবরণ করত অসংখ্য মানুষ। শঙ্কা ছড়িয়ে থাকত গোটা সমাজে। অশান্তি বিরাজ করত সর্বত্র। এই বর্বরতার অবসান ঘটেছিল ইসলামের আবির্ভাবে। ইসলাম ধর্মে ঘোষিত হলো 'কিসাস'-এর বিধান। কিসাসের বিধান অনুযায়ী, কোনো হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলে, তার বিচার হবে। বিচারে প্রকৃত খুনিকে শনাক্ত করে শুধু খুনিকেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যাবে। কিসাস যেহেতু বিচার, সেহেতু খুনির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার মধ্য দিয়ে সহিংসতার পরিসমাপ্তি ঘটত। আগের মতো বংশ পরম্পরায় হত্যা চলতে থাকত না। এখানেই বিচার এবং প্রতিশোধের পার্থক্য।
খুনের বদলে খুন হলো প্রতিশোধ, যা একটি সহিংস প্রক্রিয়া। অন্ধকার যুগের মানব বিধ্বংসী প্রক্রিয়া। চলমান হিংসা ও হিংস্রতা। এরই বিপরীতে সভ্যতার অবদান হলো, হত্যার বিপরীতে বিচার। বিচার প্রতিশোধ নয়, প্রতিকার। প্রতিহিংসা নয়, যৌক্তিক প্রতিফল। বিচারের লক্ষ্য নিষ্পত্তি। চলমান হিংস্রতা থেকে মুক্তি। সমাজকে সংহত করতে বিচার।
সাম্প্রতিক দুটি বিচার প্রক্রিয়ার বিরোধিতা অবলোকন করে কথাগুলোর অবতারণা। বিলম্বিত বিচার দুটি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা নৃশংসতম দুটি হত্যাযজ্ঞের পরিপ্রেক্ষিতে। একটি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর ছত্রছায়ায় এ দেশীয় কিছু মানুষের অমানবিক কার্যকলাপ_হত্যা, লুণ্ঠন, অগি্নসংযোগ এবং শারীরিক অত্যাচারসহ আরো অনেক লোমহর্ষক কু-কর্ম। অন্য হত্যাযজ্ঞটি ঘটানো হয়েছিল ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট অপরাহ্নে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে। প্রকাশ্য জনসভায় গ্রেনেড চার্জ করে হত্যা করা হয়েছিল ২৪ জন মানুষকে। গুরুতর আহত হয়েছিল কয়েক শ মানুষ। শেখ হাসিনা অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলেন। প্রবীণ নেতারা মানববর্ম রচনা করেছিলেন শেখ হাসিনাকে ঘিরে। কিন্তু নিজেরা ক্ষতবিক্ষত হয়েছিলেন গ্রেনেডের স্প্লিন্টারে। অস্ত্রোপচার করে অনেক স্প্লিন্টার বের করা হয়েছে। তবু আজও তাঁদের অনেকে কিছু স্প্লিন্টার বহন করে বেঁচে আছেন ঘটনার জীবন্ত সাক্ষী হয়ে।
মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী সহিংসতার বিচারের উদ্যোগ নেওয়া মাত্রই একটি মহল উচ্চকণ্ঠ প্রতিবাদ জানাল। বিদ্রূপের সুরে বলল, 'হাড়গোড়ের আবার বিচার কিসের।' কেউ কেউ বললেন, '৪০ বছর পর বিচার হয় নাকি?' অভিযুক্তরা সব সাধু সেজে গেলেন। পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে তাঁদের বিব্রত করা হচ্ছে বলে তাঁরা প্রতিবাদ জানালেন। বিচার প্রতিহত করার হুমকিও দিলেন অনেকে।
২১ আগস্টের মর্মন্তুদ ঘটনার বিলম্বিত পুনঃতদন্তে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে এল। তদন্তকারীরা দীর্ঘদিন নিবিড় তদন্ত চালিয়ে গুরুতর অভিযোগ আনলেন। শর্ষের মধ্যেই ভূত। সামরিক-বেসামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তাই নাকি জড়িত। ছোটখাটো নয়, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। চারদলীয় জোট সরকারের সমান্তরাল ক্ষমতাকেন্দ্র হাওয়া ভবনের কথা উঠে এল। অভিযোগ এল, খোদ তারেক রহমান ছত্রছায়া দিয়েছেন এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডে। অভিযুক্ত হিসেবে তাঁর নামেও চার্জশিট দাখিল হয়েছে। যেন ভিমরুলের চাকে ঘা লেগেছে। বিএনপি নেতারা তেড়ে এলেন। তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ জানালেন। হরতালও ডাকলেন। প্রতিরোধের ঘোষণা দিলেন।
কিন্তু কেন? তারেক রহমানকে তো শাস্তি দেওয়া হয়নি, আঘাত করা হয়নি। এমনকি অপরাধীও সাব্যস্ত করা হয়নি। শুধু অভিযোগ আনা হয়েছে, বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছে। কোনো নাগরিক কি বিচারের ঊধর্ে্ব থাকতে পারেন? মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী কেউই তো বিচারের ঊধর্ে্ব নন। তারেক রহমান কিভাবে বিচারের ঊধর্ে্ব থাকবেন?
এটা কোনো রাজনৈতিক মামলা নয়; এটা জঘন্যতম অপরাধের মামলা, শান্তি সমাবেশে ২৪ জন নিরস্ত্র মানুষকে গ্রেনেড চার্জ করে হত্যা করার মামলা। আরো অনেক মানুষকে আজীবনের জন্য পঙ্গু করে দেওয়ার অপরাধে মামলা, বিনা প্ররোচনায় মানুষকে মরণাঘাত করার মামলা। এমন মামলায় কোনো অভিযুক্তকে অব্যাহতি প্রদানের আবেদন কি যৌক্তিক? দোষী না হলে তো তিনি বিচারেই খালাস পাবেন। বিচারের আগেই দায়মুক্তি কেন?
বলা হতে পারে, তারেক রহমান বিরোধীদলীয় নেত্রীর পুত্র বিধায় এই সরকারের আমলে সুবিচার পাবেন না। কথাটা কি অতি সরলীকৃত সমীকরণ নয়? বিচারেরও তো নিজস্ব 'চেকস অ্যান্ড ব্যালান্সেস' রয়েছে। নিবিড় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। যুক্তি-প্রমাণ পেশ করুন। নিম্ন আদালতের রায় মনঃপূত না হলে উচ্চ আদালতে আপিল করুন। উচ্চ আদালতের রায়ে সংক্ষুব্ধ হলে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করুন। ফুলকোর্টে বিচারের ব্যবস্থা রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টে মামলা গড়াতে গড়াতে অনেক সময় গড়িয়ে যাবে। চাহে তো বিএনপিও ততদিনে ক্ষমতায় এসে যেতে পারে। নিজেদের আমলে তো সুবিচার পাবেন। আর যদি ক্ষমতায় আসতে না পারেন এবং সুপ্রিম কোর্টেও দণ্ডিত হন, তাহলে তো দণ্ড মেনে নেওয়াই সংগত আচরণ। তাও যদি অসংগত মনে করেন, তাহলে তখনো আন্দোলনের পথ খোলা থাকবে।
রাষ্ট্রের বিচারিক স্তম্ভের ওপর আস্থাহীনতা মারাত্মক অবস্থা সৃষ্টি করে, তা আমরা দেখতেই পাচ্ছি। কে এর জন্য দায়ী? এযাবৎকালে বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি (দুটি দলই সেনা ছাউনিতে জন্ম নিয়েছিল) অধিককাল ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। অতএব তাদের দায়ভারই অধিক। আওয়ামী লীগও হয়তো ভারসাম্য সৃষ্টির প্রয়াস পেয়েছে। পারস্পরিক দোষারোপ পরিত্যাগ করে বিচারিক স্তম্ভটি শক্তিশালী করলে সবার জন্যই সুফল বয়ে আনবে।
ক্ষমতার মার খেয়ে বিরোধী দল (যে দলই হোক) সব সময়ই বিচার বিভাগের কাছে কিছুটা হলেও স্বস্তি অর্জন করেছে। নিজ স্বার্থেই সব দল বিচার বিভাগকে সক্ষমতা অর্জনে সহায়তা করতে পারে। না করলে কী হতে পারে, তাও বিশ্লেষণ করে দেখা যায়। যখন যে দল ক্ষমতায় আসে, সেই দল যদি বিচার বিভাগকে দলীয়করণ করার প্রক্রিয়া বজায় রাখে, তাহলে ক্ষমতায় থাকাকালে লাভবান হলেও বিরোধী দলে যাওয়ার পর ব্যাকল্যাশটা টের পাবে। কারণ, ক্ষমতার বিরাগভাজন হতে কে চায়? বরং কেউ যদি দলীয়করণ না করেন এবং বিচার বিভাগকে পেশাগতভাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করেন, তাহলে বিপদে উপকৃতই হবেন।
অনেকে এ ধরনের কথাবার্তাকে নীতিকথা বলে উড়িয়ে দিতে চান। নীতিকথা হলেও কথা যে সত্য, তা তো এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন সবাই। সব সময়ই দুর্বলের আশ্রয় বিচার বিভাগ। প্রশাসনিক ক্ষমতার মত্ততা থেকে আশ্রয় মিলতে পারে এখানেই।
এখন অন্যদিক থেকে তাকিয়ে দেখা যাক। বিএনপি দীর্ঘদিন সামরিক-বেসামরিক আদলে ক্ষমতায় ছিল। তাদের আগ্রহ না থাকা সত্ত্বেও পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের আমলে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে। মুশতাক-জিয়া বেআইনি ক্ষমতা দখলদার হিসেবে ঘোষিত হয়েছেন। পঞ্চম সংশোধনীর আওতায় সামরিক ফরমান অবশেষে বাতিল হয়েছে। বিএনপি ঠেকাতে পারেনি। বিচার বিভাগকে নিষ্ক্রিয় করে রাখতে পারেনি। কারণ, বিচার বিভাগের নিজস্ব 'চেকস অ্যান্ড ব্যালান্সেস' রয়েছে, যা সম্পূর্ণ বিনষ্ট করা যায় না। প্রশাসনিক ক্ষমতায় বলীয়ান হয়ে হস্তক্ষেপ করার প্রচেষ্টা চলতে থাকলে 'চেকস অ্যান্ড ব্যালান্সেস' প্রক্রিয়া সক্রিয় হয়ে ওঠে।
চারদলীয় জোট সরকারের আমলে হাওয়া ভবন কতটা ক্ষমতাধর ছিল, তা মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে যাওয়ার কথা নয়। সাংবিধানিক ক্ষমতা ছিল সরকারের। অসাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করত হাওয়া ভবন। আইনি ভিত্তি ছিল না। কিন্তু বাস্তবতা অস্বীকার করা যাবে কি?
সাংবিধানিক ক্ষমতাও অনেক সময় ক্ষমতাসীনকে বেপরোয়া করে তোলে। অসাংবিধানিক বেআইনি ক্ষমতা ক্ষমতাধরকে কতখানি বেপরোয়া করে তুলতে পারে, তা ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়। হাওয়া ভবনের বেআইনি এবং অনৈতিক ক্ষমতার ছত্রছায়ায় কত কী ঘটেছিল, তা ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে।
তারেক রহমান সেই সময়কার প্রধানমন্ত্রীর পুত্র ছিলেন। রাজতন্ত্রেও রাজা হওয়ার আগ পর্যন্ত রাজপুত্রের ক্ষমতা থাকে না। গণতন্ত্রে তো প্রশ্নই ওঠে না। তবু যদি অভিযোগ ওঠে, তাহলে তা নিবিড় পরীক্ষার দাবি রাখে। অভিযোগ উঠেছে, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় প্রশাসনিক সহায়তা প্রদানের আশ্বাস দিয়েছিলেন হাওয়া ভবনের সভা থেকে জনাব তারেক রহমান। অনেকে অভিযোগ করেছেন, ওইদিন গ্রেনেড মেরে শেখ হাসিনাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার চক্রান্ত নাকি হাওয়া ভবনেই হয়েছিল। গুরুতর অভিযোগ। প্রতিহিংসাপরায়ণ না হয়ে বরং বিচারিক প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হওয়াই উচিত। অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত না হলে তিনি মুক্তি পাবেন। বদনাম মুছে যাবে, সম্মান ফিরে পাবেন। আর অভিযোগ প্রমাণিত হলে বিচারের মাধ্যমে প্রতিহিংসার দুষ্টচক্র রোধ করা যাবে। কাজেই বিচারেই কল্যাণ।
বিচার মানবজাতিকে চক্রায়িত হত্যাযজ্ঞের বিষবাষ্প থেকে রক্ষা করেছে। বিচারের প্রতিবাদ নয়, বিচার প্রতিরোধ নয়, বরং প্রতিহিংসা প্রতিরোধ করতে হবে। প্রতিহিংসার ধ্বংসলীলা থেকে জাতিকে রক্ষা করতে হবে। এ লক্ষ্য অর্জনে বিচারই একমাত্র পথ।

লেখক : সাবেক ডেপুটি গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.