জলবায়ু পরিবর্তন : বাংলাদেশ কি আগামী নব্বই বছরে সত্যিই বিলুপ্ত হয়ে যাবে? by শাহনেওয়াজ বিপ্লব

আর কত দিন বাঁচবে বাংলাদেশ? কত দিন টিকে থাকবে পৃথিবীর মানচিত্রে পলিমাটির ছোট্ট সবুজ বাংলাদেশ? বাঙালির আয়ু নিয়ে, বাংলাদেশের মানুষের আয়ু নিয়ে যেখানে আমাদের মাথা ব্যথা নেই; সেখানে দেশের আয়ু নিয়ে ভাবনাকে বরং বাড়াবাড়িই মনে হতে পারে।


কিন্তু বাংলাদেশের ভৌগোলিক বেঁচে থাকা নিয়ে বিজ্ঞানীরা যে ভবিষ্যদ্বাণী করছেন, তা এক কথায় আঁতকে ওঠার মতো। জাতিসংঘের মতে, শিল্পোন্নত দেশের কারখানা থেকে উৎপাদিত হওয়া গ্রিনহাউস গ্যাস বায়ুমণ্ডলে মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। এতে বাড়ছে হিংস্র ঘূর্ণিঝড়, উঁচু হচ্ছে সমুদ্রের পানির স্তর। এ পানির স্তর যদি উঁচু হতেই থাকে, দুর্ভাগা বাংলাদেশই হবে প্রথম শিকার। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের অর্ধেক তলিয়ে যাবে সমুদ্রে। আর ২১০০ সালের মধ্যে হয়তো ডুবে যাবে সমগ্র বাংলাদেশ, কোটি কোটি মানুষ প্রাণ হারাবে, উদ্বাস্তু হবে বাংলাদেশিরা।
বিজ্ঞানীদের এসব সাবধানবাণী ও আশঙ্কা থেকে আঁচ করা যায়, কত বড় সংকটের দিকে এগোচ্ছে বাংলাদেশ। অথচ এ নিয়ে একটুও আগ্রহ নেই সারা দেশে, কোথাও এতটুকু হাহাকার নেই। বরং খবরটা চেপে রাখার চেষ্টা চারদিকে। বাইশ শতকে বাংলাদেশ নামের কোনো দেশ থাকবে না, বাঙালি হয়ে উঠবে ইহুদিদের মতো উদ্বাস্তু। দেশ থেকে দেশে দেশান্তরী হবে তারা_এ রকম একটি ভয়াবহ চিত্র বিজ্ঞানীরা তুলে ধরার পরও বাংলাদেশকে বাঁচানোর জন্য যেন কেউ নেই। সংবাদপত্রগুলো ঠিক সে রকম সরব নয়। সরকারেরও এ বিষয়ে বিশেষ ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। জনগণও ব্যস্ত দৈনন্দিন জীবনযাপন নিয়ে অথচ কত বড় মহাপ্রলয় আর অনিশ্চয়তা যে বাংলাদেশের কপালে লেখা হয়ে গেছে, সে বিষয়ে কারো যেন কিছু করার নেই। পৃথিবীর মানচিত্র থেকে বাংলাদেশের বিলুপ্তির জন্য কেয়ামত পর্যন্ত অপেক্ষা করার আর দরকার নেই_এ রকম আশঙ্কা আর বিজ্ঞানীদের ভবিষ্যদ্বাণীর পরও বাংলাদেশের বিলুপ্তির আশঙ্কাকে বাংলাদেশ সরকারও যেন স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছে।
গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়ার ফলে বাংলাদেশ যে ভয়াবহ ক্ষতির শিকার হচ্ছে_এ বিষয়ে বাংলাদেশের নিজের কোনো দোষ নেই; বরং সবচেয়ে বেশি দোষ শিল্পোন্নত দেশগুলোর। তাই জাতিসংঘ জলবায়ু তহবিল বাংলাদেশকে একটি বড় তহবিল দিচ্ছে ক্ষতিপূরণ হিসেবে। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে দেখা যাচ্ছে, আমাদের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় এই তহবিলকে উৎসবের উপলক্ষ হিসেবে নিয়েছে। তহবিলের এ টাকাকে নয়ছয় করে বিলি-বণ্টনের একটি তালিকার কথা ইতিমধ্যে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
বিবিসি বলছে, সাগরের পানি ২০৫০ সালের মধ্যে এক মিটার বাড়লে বাংলাদেশের তিন কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হবে। তলিয়ে যাবে বহু ফসলি জমি, সমুদ্র গ্রাস করে নেবে বিস্তীর্ণ সমভূমি। এ ছাড়া অন্য যেসব প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে সেগুলো হচ্ছে : ১. ছয় ঋতু ক্রমেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। গ্রীষ্ম আর বর্ষা দীর্ঘায়িত হবে। শরৎ ও বসন্ত একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ২. আষাঢ় ও শ্রাবণের বর্ষাকাল প্রলম্বিত হয়ে বন্যাকাল নেমে আসবে। ৩. জলবায়ুর পরিবর্তনে বৃষ্টির স্বভাবেও পরিবর্তন আসবে। ফলে ফসল উৎপাদন অনিয়মিত হয়ে পড়বে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ফসল উৎপাদন কমে যাবে ৩২ শতাংশ পর্যন্ত। ৪. সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও খুলনার সমুদ্র উপকূল প্রথম ক্ষতির শিকার হবে। ৫. যদি পানির স্তর এক মিটার বাড়ে তবে সুন্দরবনের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। ৬. বাংলাদেশের মৎস্যশিল্প ভয়াবহ বিপন্ন হবে। ৭. ভূমি হারানো উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা বাড়বে, যা দেশের আর্থসামাজিক কাঠামোয় এক বিরাট পরিবর্তন আনবে। ৮. সমুদ্রসীমা বিস্তৃত হলে সুপেয় পানির সংকট দেখা দেবে।
কিন্তু এসব বিষয়ে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের কোনো জনসচেতনমূলক ভাবনার কথা আজও জানা যায়নি। দুর্যোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনার কোনো প্রস্তুতি তাদের নেই। দুর্যোগ মোকাবিলার কৌশল নির্ধারণে কিছু এনজিওকে পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব দিয়েই বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় তাদের দায়িত্ব শেষ করেছে।
অথচ ছোট দ্বীপদেশ মালদ্বীপও আমাদের মতো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান শিকার হবে এবং তারা শুধু তাদের দেশের পরিবেশ রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে না বরং সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে ফিজির পার্শ্ববর্তী একটি দ্বীপ কিনছে।
মানুষ নানাভাবে ভাগ্যাহত হতে পারে জীবনে। তবে যার দেশ নেই, সে-ই সবচেয়ে ভাগ্যাহত। উদ্বাস্তু শিকড়হীন, পরভূমে ভ্রাম্যমাণ। প্রতিটি মানুষের চাওয়া তার নিজের দেশ, যে দেশের জন্য বাঙালি ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে, অজস্র অশ্রুর বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছে।
তাই এখনই সময়, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে সচেতন হওয়ার। যদি বাংলাদেশের ভৌগোলিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা এ মুহূর্তেই সচেতন না হই; তবে বড় নির্মমতা অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। হয়তো বঙ্গোপসাগরের নিচে মৃত ঝিনুকের মতো চিরকালের জন্য তলিয়ে যাবে বাংলাদেশ নামের দেশটি।

লেখক : তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ
ভিয়েনা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়
অস্ট্রিয়া।

No comments

Powered by Blogger.