বইয়ের মেলা প্রাণের মেলা-ছুটির দিনে মেলা ছাপানো ভিড় by আশীষ-উর-রহমান

যেমন বরাবর হয়, যা প্রত্যাশা থাকে তার ব্যতিক্রম কিছু হয়নি। গতকাল শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে শাহবাগ থেকে দোয়েল চত্বর যান-জনতায় আকীর্ণ। সকাল থেকেই বইমেলায় লোকসমাগম শুরু হয়। বিকেল থেকে উভয় প্রান্তের দুটি করে আর্চওয়ের সামনে চারটি করে সারি। মাঠে, পথে আক্ষরিক অর্থেই ‘তিল ঠাঁই আর নাহি রে’ অবস্থা।


তার ওপর বিকেল থেকে টিএসসির মোড় থেকে ফুটপাত এবং সন্ধ্যা নাগাদ পথের ওপর জুতা-স্যান্ডেল থেকে কাচের চুড়ি, মাথার টিপ আর নকল ভারতীয় বইয়ের পসরা। যাতায়াত করতে বড়ই অসুবিধা হয়েছে মেলায় আগত লোকজনের। এসব পসরা অপসারণে নিষ্ক্রিয় ছিলেন নিরাপত্তারক্ষীরা।
শিশু-কিশোর প্রতিযোগিতা
অমর একুশে উপলক্ষে বাংলা একাডেমী শিশু-কিশোরদের নিয়ে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে। এর অংশ হিসেবে গতকাল সকালে মেলা মঞ্চে ছিল বয়সভিত্তিক দুটি বিভাগে ‘ছড়া গান’ ও ‘ভাষার গান’ প্রতিযোগিতা। মোট ২৬৫ জন প্রতিযোগী এতে অংশ নেয়। ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রতিযোগিতার প্রাথমিক ফল প্রকাশ করা হবে। প্রতিযোগিতা শেষে এভারেস্ট বিজয়ী মুসা ইব্রাহীমের হিমালয় অভিযানের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।
যেমন বই লিখতে চান জাফর ইকবাল
নজরুল মঞ্চে আনিসুল হকের নতুন উপন্যাস যারা ভোর এনেছিলর মোড়ক উন্মোচন করে নন্দিত লেখক ও শিক্ষাবিদ মুহম্মদ জাফর ইকবাল বললেন, ‘এ রকম একটি বই আমি সব সময় লিখতে চাই। বইটির নাম থেকেই বোঝা যায়, দেশটা একসময় ছিল অন্ধকার। তাকে আলোকিত করতে অনেক কষ্ট ও আত্মত্যাগ করতে হয়েছে। যাঁরা তা করেছেন, তাঁদের নিয়েই এই বই। ইতিহাসভিত্তিক এমন একটি বই লিখতে প্রচুর পড়তে হয়, খাটতে হয়। আনিসুল হক সেই পরিশ্রম করেছেন।’
আনিসুল হক বলেন, ‘আমি সাধারণত বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করি না। মুহম্মদ জাফর ইকবাল আমার অত্যন্ত প্রিয় মানুষ। তাঁর হাতেই এর আগে মা উপন্যাসটির মোড়ক উন্মোচিত হয়েছিল, এবারও সেই প্রিয়জনের হাতেই যারা ভোর এনেছিল বইটির মোড়ক উন্মোচিত হওয়ায় আমি আনন্দিত।’
বইটির প্রথম কপি কিনেছেন মুহম্মদ জাফর ইকবালের স্ত্রী ইয়াসমিন হক।
প্রথমা প্রকাশন থেকে গতকালই মেলায় এসেছে উপন্যাসটি। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ কালপর্বের বাংলার রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের প্রেক্ষাপট নিয়ে এই উপন্যাস। এতে প্রধান চরিত্র হিসেবে আছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মওলানা ভাসানী, তাজউদ্দীন আহমদসহ অন্যান্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের চরিত্রও উঠে এসেছে তাঁর এই উপন্যাসে।
একাডেমী চাইলে প্রকাশকেরা আর্থিক সহযোগিতা দেবেন
এই যে ছুটির দিনে চলাচল-অসাধ্য হয়ে ওঠা মেলা আগামীবার থেকে সম্প্রসারণ করার যে উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে একাডেমী, তা নিয়ে অনেক প্রকাশক অনেক রকম মত দিয়েছেন। জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির নির্বাহী পরিচালক সময় প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী ফরিদ আহমেদ বললেন, সম্প্রসারণ করা হলে মেলা যেন খণ্ডিত না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। প্রকৃত প্রকাশকদের রেখে অন্যদের স্টল দেওয়া বন্ধ করতে হবে। মেলা আয়োজনে প্রকাশকদের কাছে আর্থিক সহায়তা চাওয়া হলে প্রকাশকেরা তা দিতে সম্মত। তবে মেলার এক মাস আগে এ নিয়ে আলোচনা না করে প্রতিবছর মার্চ-এপ্রিল থেকে সবাই মিলে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
মেলার ক্রান্তিকাল চলছে
মেলায় বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিনিধির। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রকাশনায় ক্রান্তিকাল চলছে। পুরোনো বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর একচেটিয়া প্রভাব কমছে। নতুন একদল প্রকাশক উঠে এসেছে। নতুনেরা মানের দিকে ভালো এবং সংখ্যার দিক থেকেও প্রচুর বই প্রকাশ করছে। একাডেমী এই নতুন প্রজন্মের প্রকাশকদের যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে। তারা নেতৃত্বেও উঠে আসছে। এ কারণে পুরোনো প্রকাশকদের একটি অংশ, যারা এত দিন প্রভাব বিস্তার করে ছিল, তাদের প্রভাব কমে আসছে। এই অংশটিই চায় না, মেলার পরিসর বাড়ানো হোক বা নতুনেরা উঠে আসুক।’
মহাপরিচালক বলেন, ‘এক মাস ধরে রাস্তা বন্ধ করে মেলা করতে হবে, এটা কোনো সভ্য দেশে হয় না। এটা সভ্যতা ও সংস্কৃতির পরিপন্থী।’ তিনি আরও বলেন, ‘যারা রাস্তায় স্টল নিয়েছে, তাদের অনেকেই অন্যের কাছে সেই স্টল বিক্রি করে দিয়েছে। তাতে এমন ধরনের বই বা পণ্য বিক্রি হচ্ছে, যা মেলার নীতিমালার পরিপন্থী। এই দুর্বৃত্তদের একাডেমী দমন করতে পারে না।’ আজ শনিবার বিকেল সাড়ে চারটায় তিনি একাডেমীর প্রশাসনিক ভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক মতবিনিময় করবেন।
মোড়ক উন্মোচন ও নতুন বই
নজরুল মঞ্চে গতকাল কুড়িটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে। আর ২৪৫টি নতুন বইয়ের নাম জমা পড়েছে তথ্যকেন্দ্রে। এবারের মেলায় এটিই সর্বোচ্চ সংখ্যা। প্রথমা থেকে এসেছে আবুল মোমেনের প্রবন্ধ রবীন্দ্রনাথ: মুসলিমমানস ও বাংলাদেশের অভিযাত্রা। আনিসুল হকের নতুন উপন্যাস যারা ভোর এনেছিল প্রথম দিনে আসা কপিগুলো সন্ধ্যার আগেই শেষ।
অন্য উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে: অক্ষর থেকে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক রক্তাক্ত বাংলাদেশ, সুবর্ণ থেকে মুনতাসীর মামুনের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মুক্তিযুদ্ধে ১৩ নং সেক্টর, গদ্য-পদ্য থেকে আহমদ রফিকের শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ, শুদ্ধস্বর থেকে শামসুজ্জামান খানের ভ্রমণবিষয়ক দূরে দূরান্তে এবং পিয়াস মজিদের প্রবন্ধ করুণ মাল্যবান ও অন্যান্য প্রবন্ধ, হাতেখড়ি থেকে মাহমুদ শামসুল হকের গবেষণাগ্রন্থ নদী, উৎস থেকে প্রশান্ত মৃধার গল্প যুধিষ্ঠিরের সঙ্গী, অন্যপ্রকাশ থেকে দন্ত্যস রওশনের ভ্রমণবিষয়ক বই অরণ্যে তারুণ্যে, সূচীপত্র থেকে মাহমুদ হাফিজের শিশুতোষ গল্প অদ্ভুত সব বদভূত, অনিন্দ্য থেকে সারওয়ার-উল-ইসলামের আয়রে আমার ছড়া, অ্যাডর্ন থেকে সুমনকুমার দাশ সম্পাদিত অগ্রন্থিত রাধারমণ। এ ছাড়া শুদ্ধস্বর থেকে এসেছে আবদুশ শাকুরের সংগীতবিষয়ক সাংগীতিক সাক্ষরতা, অন্যপ্রকাশ থেকে নাসরীন জাহানের উপন্যাস কবচ কুণ্ডল এবং সুলেখা থেকে মহাদেব সাহার কবিতা কোন মোহে কোনবা বিরহে।
আজ শনিবার মেলা খুলবে বেলা ১১টায়। আলোচনা হবে একুশের সাহিত্য নিয়ে। বিকেলে যথারীতি মঞ্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান তো থাকছেই।

No comments

Powered by Blogger.