মধ্যম আয়ের দেশ : স্বপ্ন না বাস্তবতা by আবুল কাসেম হায়দার

২০২১ সালে বাংলাদেশ একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বপ্ন দেখাটারও বাস্তবতা রয়েছে। কারণ ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিকভাবেও বাংলাদেশের পরিবর্তন ও উন্নতি ঘটছে বলে বিভিন্নভাবে প্রকাশিত হয়েছে। সত্তরের দশকে বাংলাদেশকে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হেনরি কিসিঞ্জার তলাবিহীন ঝুড়ি নামে আখ্যায়িত করেছিলেন। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি সামাজিক খাতে অগ্রগতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
যেমন_মেয়েদের শিক্ষার হার, শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা দক্ষতা এবং বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে মহিলাদের অংশগ্রহণ। অন্যদিকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলে ছাত্রছাত্রী ভর্তির ক্ষেত্রে লিঙ্গসমতা বেশ সাফল্য অর্জন করেছে। শিশুমৃত্যুর হার যেখানে ২০০৮ সালে নেমে এসেছে ৬৫ শতাংশে। সেটি ১৯৯০ সালে ছিল ১৪৪ শতাংশ। অন্যদিকে বিগত কয়েকটি সরকার সামাজিক নিরাপত্তাবলয় বৃদ্ধি করার কারণে বন্যা, দুর্যোগ ও সাইক্লোন থেকে জনগণের মৃত্যুহার বেশ হ্রাস পেয়েছে। এসব দুর্যোগের ফলে বিগত সময়ের মতো দুর্ভিক্ষ তেমন একটি দেখা যায়নি। অন্যদিকে বাংলাদশের ক্ষুদ্রঋণের দারুণ প্রসার ঘটেছে। এ ক্ষেত্রে নারীরা সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রয়েছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক-শিল্প খাতে নারীদের বিপুল পরিমাণ অংশগ্রহণ রপ্তানি ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখছে।
শুধু বাংলাদেশ সামাজিক ক্ষেত্রেই অগ্রগতি করেছে তা নয়, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।
ব্যক্তি খাতে উন্নয়ন : আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশমান ধারা। দীর্ঘ ৪০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির যে গতি-প্রকৃতি তা খুব বেশি দ্রুত না হলেও কিছুটা অগ্রসরমান। গত ৪০ বছরে আমাদের দেশে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, কৃষক সমাজ, যুবক ও মহিলা এবং বৃহত্তর অর্থে দরিদ্র জনগোষ্ঠী একটি বিরাট বিপ্লবের ভূমিকায় অবতীর্ণ রয়েছে। নানা রাজনৈতিক অস্থিরতা, বন্যা, দুর্যোগ, জলোচ্ছ্বাস ও সামাজিক অবক্ষয়ের মধ্যেও আমাদের দেশে একটি দূরদর্শী উদ্যোক্তা শ্রেণী জন্ম লাভ করেছে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা, সংস্কৃতি ও আন্তর্জাতিক নানা হস্তক্ষেপ এবং সুশীল সমাজের পক্ষপাতিত্বমূলক অংশগ্রহণ থাকা সত্ত্বেও বিরাট একটি জনগোষ্ঠী দেশ গড়ার কাজে এগিয়ে এসেছে। তাই বর্তমান সরকার ভিশন-২০২১ নাম দিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে, তা আমাদের জাতীয় চেতনারই বহিঃপ্রকাশ। বিগত দিনে জাতীয়ভাবে যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, সেগুলো পুরোপুরি কাজে না লাগলেও কিছু না কিছু কাজে লাগার ফলে আমাদের দেশ মধ্যম আয়ের দেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
মধ্যম আয়ের মর্যাদার প্রেক্ষিত : বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশকে একটি উচ্চ প্রবৃদ্ধির অর্থনীতির দেশ হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়েছে। আমরা সাধারণত ধারণা করি, মাথাপিছু আয় এক হাজার ডলার হলে একটি দেশ মধ্যম আয়ের দেশ হতে পারে, তা নয়। মধ্যম আয়ের দেশ হতে হলে এর আরো ব্যাপক ভিত্তি প্রয়োজন। বাংলাদেশের অর্থনীতি যেভাবে অগ্রসরমান, তাতেই মাথাপিছু আয় এক হাজার ডলার ছাড়িয়ে যাওয়াটা কঠিন নয় এবং দেশের প্রবৃদ্ধি যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে সেটিও আশানুরূপ। কিন্তু সবচেয়ে যেটি বড় সমস্যা, সেটি হলো দারিদ্র্যের সমস্যা। এ সমস্যা বাংলাদেশের কাটিয়ে ওঠা খুবই কঠিন। দরিদ্রতার এই নাগপাশ থেকে আমাদের মুক্তি অর্জনের জন্য নতুন করে কৌশল ঠিক করতে হবে। এ জন্য বর্তমান প্রবৃদ্ধির হারকে ৩ থেকে ৪ শতাংশ বৃদ্ধি করার প্রয়োজন হবে। তাতে প্রবৃদ্ধি গিয়ে দাঁড়াবে ৮ শতাংশের ওপরে। কিন্তু ৮ শতাংশের ওপর এই প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। এটি হলো আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি : আমাদের প্রবৃদ্ধি অর্জনে প্রধান চালিকাশক্তি বলতে গেলে তিনটি। তৈরি পোশাক তথা বস্ত্র খাত, দ্বিতীয়টি জনশক্তি রপ্তানির মাধ্যমে প্রাপ্ত রেমিট্যান্স এবং তৃতীয়টি হচ্ছে প্রবৃদ্ধি বেগবান করার নানা রকম নীতি, সংস্কার। বিগত কয়েক দশক ধরে আমাদের দেশের তৈরি পোশাক খাত প্রবৃদ্ধি অর্জনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছে। ১৫ লাখ শ্রমিক ঘনশ্রম খাত হিসেবে তৈরি পোশাক-শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
দ্বিতীয় যে খাতটি আমাদের শক্তিচালিত তা হলো, প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স। কয়েক দশক ধরে উত্তরোত্তর এই রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু বর্তমানে এটি একটি বিরাট চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। বিভিন্ন মুসলিম-অমুসলিম দেশ থেকে লাখ লাখ শ্রমিক দেশে ফেরত আসছে, সে অনুযায়ী বিদেশে শ্রমিক যাওয়ার পরিমাণ আশানুরূপ নয়। জনশক্তি রপ্তানির এ অনিশ্চয়তা আগামী দিনের অগ্রযাত্রার একটি বড় রকমের বাধা হয়ে দাঁড়াবে। প্রবৃদ্ধির তৃতীয় ধাপটি হচ্ছে, আমাদের নীতিগত সংস্কারের খাত। এ খাতে নীতিগত সংস্কার শুরু হয়েছে ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর। আশির দশক থেকে এই সংস্কার কর্মসূচির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বাণিজ্য উদারীকরণ, ব্যাংকিং ও টেলিযোগাযোগ খাতের উল্লেখযোগ্য সংস্কার এবং আর্থিক দায়িত্বশীলতা। এ সব কিছু আমাদের বহুমুখী বেসরকারি খাতে উদ্যোগের বিকাশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে অবদান রেখেছে। বেসরকারি খাতের এই উন্নয়নের ফলে প্রবৃদ্ধি ও বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা অব্যবহৃত রয়েছে।
কম গুরুত্বপূর্ণ প্রবৃদ্ধি খাত : প্রবৃদ্ধির বিকাশের জন্য শিল্প খাত সবচেয়ে মুখ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। শিল্পের পর যে খাতটি ভূমিকা রাখে তা হচ্ছে সার্ভিস-বাণিজ্য। আমাদের দেশে বেসরকারি খাত পরিবহন, টেলিযোগাযোগ; পেশাগত সার্ভিসের ক্ষেত্রে রিয়েল এস্টেট, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থ-বাণিজ্যসহ ব্যাপক খাতে অবদান রেখে আসছে। দেশে শিল্প খাতের পর প্রবৃদ্ধি অর্জনের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি বিশেষ ভূমিকা রাখছে। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধি বেগবান করার ক্ষেত্রে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ অবদান রাখে। দেশে ক্ষুদ্রশিল্প, নির্মাণশিল্প, সেবা খাত_সব ধরনের ছোট ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ২০০০ সালের পরের দশকে এসব খাতে অগ্রগতি আরো পেতে থাকবে।
খাদ্যনিরাপত্তা : আমাদের প্রবৃদ্ধি বাড়ার পেছনে কৃষির অবদান সবচেয়ে বেশি। কিন্তু জিডিপির অংশের দিক থেকে কৃষির অবদান ক্রমে যেন হ্রাস পাচ্ছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে মৎস্য ও বনসম্পদসহ কৃষি জিডিপি ছিল ১৬.০৩ শতাংশ। যদিও গ্রামীণ গৃহভিত্তিক আয় অবকাঠামোতে ২০০৯ সালে কৃষির অবদান ছিল ৩৯.৮ শতাংশ। আশি থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত হিমায়িত মৎস্য রপ্তানি ছিল প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ। কিন্তু গত দুই দশকে এ ক্ষেত্রের অবদান কমতে থাকে, তাই দেখা যাচ্ছে ডেইরি, বনসম্পদ_এসব কৃষি খাত কেমন যেন অবহেলিত হয়ে পড়ছে। খাদ্যনিরাপত্তার প্রধান উপায় হলো, খাদ্যনিরাপত্তা বৃদ্ধি করা। স্বাধীনতা-উত্তর দেশের জনসংখ্যা যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং খাদ্য উৎপাদনও তার চেয়ে কয়েক গুণ বেড়েছে।
প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখা : আমাদের প্রবৃদ্ধির ধারা বেগবান করতে নতুন কৌশল ও নীতি গ্রহণ করতে হবে। প্রবৃদ্ধির এই কৌশলকে আরো বেগবান করার প্রয়োজন হবে। তৈরি পোশাক-শিল্প খাতকে প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে পুরো বস্ত্র খাতকে চালিকাশক্তি হিসেবে টার্গেট করতে হবে। দ্বিতীয় প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি রেমিট্যান্স বৃদ্ধির নতুন কৌশল অবলম্বন করতে হবে। ইতিমধ্যে বিদেশে শ্রমিক পাঠানো কমে যাচ্ছে। ২০০৮ সালে বিদেশে শ্রমিক গেছে ৯ লাখ ৮০ হাজার, ২০১০ সালে তিন লাখ ৪০ হাজার। তাই এই খাত বিকাশের জন্য কৌশলগত রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রবৃদ্ধির আরো সহায়ক কৌশল হলো, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য নতুন করে চিন্তাভাবনা ও মহাপরিকল্পনা এবং অর্থ বরাদ্দের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য কর্মসূচি আরো বহুমুখী ও বেগবান করতে হবে। কারণ বিগত দিনে প্রবৃদ্ধি বাড়ার পেছনে জনসংখ্যা হ্রাসই একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার জন্য পাঁচটি ঝুঁকি মোকাবিলা করতে হবে। প্রথমটি হচ্ছে_রাজনৈতিক অস্থিরতা, দ্বিতীয়টি সর্বময় দুর্নীতি, তৃতীয়টি সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে দক্ষতার অভাব, চতুর্থ হচ্ছে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতসহ অবকাঠামোগত ঘাটতি, পঞ্চম হচ্ছে মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়। এসব চ্যালেঞ্জ আমাদের সবার সামনে পরিষ্কার। এ চ্যালেঞ্জগুলো কিভাবে মোকাবিলা করবেন তা-ও আমাদর জানা আছে। তাই আমাদের সব ঝুঁকি মোকাবিলা করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
কারণ উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ও সম্ভাবনাময় জীবনের সুফল আমরাই তো ভোগ করব। এ দায়িত্ব আমাদের সবার। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সরকারি ও বিরোধী দলকে দেশ গড়ার উদ্দেশ্যে ঐকমত্যে পেঁৗছাতে হবে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা পরিহার করে সবাইকে সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য এগিয়ে যেতে হবে।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ও সাবেক সহসভাপতি, এফবিসিসিআই

No comments

Powered by Blogger.