বাঘা তেঁতুল-ডিসেম্বর ১৯৭১ ডিসেম্বর ২০১১ by সৈয়দ আবুল মকসুদ

সেদিন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বরে সম্প্রচার মাধ্যমের একজন সাংবাদিক মুখের সামনে মাইক্রোফোন এগিয়ে ধরে বললেন, স্বাধীনতার এবার ৪০ বছর পূর্ণ হলো। একাত্তর দেখেছেন। এখনো দেখছেন। তখনকার অবস্থার সঙ্গে এখনকার অবস্থার তুলনা করে আপনার অনুভূতি বলুন।


বলতে হয় বলেই তাঁকে কিছু একটা বলেছিলাম। গণমাধ্যমের কাছে, গোলটেবিলে, সেমিনারে বা জনসভায় আমরা যা বলি তা সব সত্যি নয়। কিছুটা ভুল, কিছুটা বানিয়ে, কিছুটা অতিরঞ্জিত এবং বেশির ভাগই নির্জলা মিথ্যা বলে যাই। বিবেকের ধার ধারি না। সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্যের প্রশ্নই আসে না।
যিশুখ্রিষ্টের জন্মের পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলার সব ধর্ম-বর্ণ-জাতির জীবনে দুই হাজার এগারটি ডিসেম্বর এসেছে। এর মধ্যে মাত্র একটি ডিসেম্বর ছিল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। যে ডিসেম্বরে নির্ধারিত হয়েছে এ দেশের মানুষের ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ, সেই ডিসেম্বরটি ছিল ১৯৭১তম ডিসেম্বর। তারপর ৪০টি বছর পার হয়েছে। সেই ডিসেম্বরের সঙ্গে এই ডিসেম্বরের পার্থক্য কোথায়? সেদিনের বাংলাদেশের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের মিল ও অমিল কোথায়? প্রথম হলো দেশের শরীর বা ভূগোল। দেশের সেই শরীরটিই এখন নেই। বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন হচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকায়। সেখানে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে হাজার রকম কথা হবে। বাংলাদেশের প্রসঙ্গ আসবে। সে সবই কাগজপত্রের বিষয়। শুকনো কাগজপত্রের চেয়ে আমাদের চোখ ও ইন্দ্রিয়গুলো অনেক বেশি মূল্যবান।
পূর্ববর্তী ৪০০ বছরে বাংলার ভূ-প্রকৃতিতে যে পরিবর্তন হয়েছে, গত ৪০ বছরে হয়েছে তার চেয়ে বহু গুণ বেশি। সেই ডিসেম্বরের ৬ তারিখটির কথা আমার মনে আছে। হাড় কাঁপানো শীত বলতে যা বোঝায়, ছিল তা-ই। সে রকম শীত এখন আর পৌষ-মাঘ মাসেও পড়ে না। গেরিলাযুদ্ধ চলছিল দখলদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর। ৩ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয় ভারত-পাকিস্তান আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী চরম পর্যুদস্ত। আমাদের জয় ও পাকিস্তানের পতন অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু তার আগে তারা হিংস্রভাবে আরও কী করে তা নিয়ে মানুষের উদ্বেগ সীমাহীন। এর মধ্যে রেডিওতে ঘোষিত হলো: বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে ভারত। ওই মুহূর্তে তা আমাদের মধ্যে অশেষ আশার সঞ্চার করে। মুক্তিকামী মানুষের মধ্যে গভীর আনন্দের সৃষ্টি হয়। খুশিতে আমাদের কয়েকজন বন্ধু জামা খুলে সন্ধ্যাবেলা পদ্মা নদীর বরফের মতো ঠান্ডা পানিতে সাঁতার কাটতে থাকে। স্বাধীনতা অর্জনের আনন্দে সেদিন কোনো ত্যাগ ও শারীরিক কষ্টকেই কষ্ট মনে করেনি একশ্রেণীর তরুণ-তরুণী।
কেমন ছিল ৪০ বছর আগের বাংলার নদনদী? এখন যাঁদের বয়স ৪৫-৫০-এর নিচে তাঁরা জানেন না একাত্তরের অগ্রহায়ণে পদ্মাই যে শুধু টইটম্বুর ছিল তা-ই নয়, কালীগঙ্গা-ধলেশ্বরীতে চলত বড় বড় লঞ্চ। ইছামতীতে চলত বড় বড় নৌকা। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে সেদিন দেখলাম তরা ব্রিজের নিচে মানুষজন হাঁটাহাঁটি করছে। কোথাও কোথাও নদীর পেটে ফসলের চাষ হচ্ছে। একাত্তরের ডিসেম্বরে ওখানে ছোট নৌকায় পার হওয়া কঠিন ছিল। নদী ছিল খরস্রোতা।
সেই ডিসেম্বরে বাংলার মানুষের চোখে ছিল স্বপ্ন—এই ডিসেম্বরে দুঃস্বপ্ন। স্বপ্ন ছিল টিক্কা-ফরমান-নিয়াজিদের জালেমি দুঃশাসন দূর হবে। পাকিস্তানি সেনারা মাথা নিচু করে ফিরে যাবে। পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের এ দেশীয় দালাল-সহযোগীদের ঠাঁই হবে কারাগারে। তাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হবে তীক্ষ্ন ছুরি। যারা খুন-ধর্ষণ প্রভৃতির সঙ্গে যুক্ত, তাদের হবে সর্বোচ্চ শাস্তি। প্রতিষ্ঠিত হবে শান্তি, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন। দেশে আর কোনো ২২ পরিবারকে মাথা তুলতে দেওয়া হবে না। ইসলামকে নিয়ে আর ব্যবসা-বাণিজ্য হবে না। ধর্ম থাকবে ধর্মের মর্যাদা নিয়ে ধর্মের জায়গায়, পাবে না ধর্মান্ধতা প্রশ্রয়। বাংলাদেশ একটি নামমাত্র স্বাধীন রাষ্ট্র হবে না, হবে আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র।
সেদিন যুবসমাজের মধ্যে বিলাসিতার লেশমাত্র ছিল না। অধিকাংশেরই জামা ছিল একটি। ভাগ্যবান অনেকের ছিল দুটি। প্যান্টের প্রয়োজন বোধ করেনি অনেকেই, পাজামাতেই চলে যেত। আজকের মতো ভোগবাদ ও বিলাসিতা সেই ডিসেম্বরে থাকলে পাকিস্তানি দখলদারদের পরাভূত করা সম্ভব হতো না। আজ যার সঙ্গেই করমর্দন করি, সে-ই নিজের পরিচয় দেয়: আমি ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’ অমুক। সেদিন একজন সর্বোচ্চ সাহসী মানুষও বলেননি, তিনি একজন বীর। আজ ভোগবাদী মুক্তবাজার অর্থনীতির মধ্যে বীরত্ব জিনিসটিও বেচাকেনা হচ্ছে অতি চড়া দামে। প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা টেলিভিশনে দেখছি নিলামে বিক্রি হচ্ছে দেশপ্রেম। এত দিন ছিল কে কত বেশি দেশপ্রেমিক তা প্রচার করা। এখন দেখা দিয়েছে বিপরীত প্রবণতা। কে দেশপ্রেমিক নয়, সেটা প্রমাণ করা। তাই ৪০তম ডিসেম্বরে তারই এলাকায় আকাশ-বাতাস মুখরিত হয় স্লোগানে: ‘কাদের সিদ্দিকী রাজাকার, এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়’।
সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি পূরণযোগ্য। জাতির মানবিক মূল্যবোধ নষ্ট হয়ে গেলে সবই শেষ হয়ে যায়। ক্যালেন্ডারের মাসগুলোর যদি মানুষের মতো ভাষা থাকত, তা হলে ডিসেম্বর মাসটি চিৎকার করে বলত: হে বাংলার মানুষ, অধঃপতন শুধু তোমাদের হয়নি, আমারও হয়েছে। কী ছিলাম ৪০ বছর আগে, আজ কী হয়েছি। তোমাদের মতো আমিও নষ্ট হয়ে গেছি।
সৈয়দ আবুল মকসুুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।

No comments

Powered by Blogger.