বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখে by রউফুল আলম

ত কয়েক দশক ধরে গোটা পৃথিবীতে টেকসই অর্থনীতির যে মূলনীতি প্রণয়ন ও প্রয়োগের মাধ্যমে বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা চলছে, সে যাত্রায় আমাদের দেশও অংশগ্রহণ করেছে। রসদ হিসেবে কী কী দরকার বা পর্যাপ্ত সবকিছু নিয়ে শুরু করেছে কি-না তা বিশদ এবং অনুপুঙ্খ আলোচনার বিষয়।


তবে টেকসই অর্থনীতির অন্যতম শর্ত বলে বিবেচ্য টেকসই গণতন্ত্র। অবশ্য বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী ও পুঁজিবাদী অংশ যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য পৃথিবীকে ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত করতেও এতটুকু দ্বিধান্বিত নয়, তা আদৌ রুপোর কাঠি নাকি যূপকাষ্ঠ সেটি বিতর্কের বিষয়। পেশিশক্তির নগ্নতা, অপলাপ, ক্ষমতার স্বেচ্ছাচারী ব্যবহার আজ বিশ্ব মানবতার পথে দুরতিক্রমণীয় অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। তবে এও সত্য, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা একটি সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরের অন্তঃসম্পর্ক স্থাপন, আধুনিকায়ন, স্বনিয়ন্ত্রণ ও সুনিয়ন্ত্রণের জন্য আবশ্যক। বাংলাদেশ অবশ্য এই গণতন্ত্রের পথে একটানা প্রায় কুড়ি বছর পার করতে চলেছে। ইতিমধ্যে দেশের আর্থ-সামাজিক ও অবকাঠামোগত অনেক পরিবর্তনই এসেছে। উন্নয়নশীল এই দেশে প্রযুক্তির ব্যবহার, যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রসার ও অগ্রগতি, সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি ও প্রজন্মের শিক্ষামুখী স্বতঃস্ফূর্ততা, গণমানুষের কর্ম ও উৎপাদনমুখী প্রয়াস অবশ্যই উল্লেখযোগ্য এবং ইতিবাচক। পাশাপাশি নেতিবাচক দিকগুলোর মধ্যে আইনের ওপর মানুষের অনাস্থা, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, কালো টাকা ও পেশিশক্তির প্রতাপ, শ্রেণীবৈষম্য ও শ্রেণীর অবমূল্যায়ন, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার অভাব, বেকারত্ব, দুর্নীতি ইত্যাদি ক্রমে বেড়েই চলেছে। নেতিবাচক এই দিকগুলোর সঙ্গে টেকসই গণতন্ত্রের সম্পর্ক নিবিড়। পথে ছিল অন্তরায়। তদুপরি সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক দিক ছিল যে, মানুষ সব সময় গণতন্ত্রকে স্বাগত জানিয়েছে, সমর্থন করেছে, এমনকি এর প্রতিষ্ঠার জন্য রাজপথে নেমেছে, রক্ত দিয়েছে। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো মানুষের সেই ভালোবাসা ও ত্যাগকে যথোপযুক্ত মর্যাদা দিতে সক্ষম হয়নি। গণতন্ত্রচর্চার যে কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান জাতীয় সংসদ, সেটিকে কার্যকর ও প্রাণবন্ত করতেও তারা সক্ষম হয়নি। সংসদ কিংবা সংসদীয় কমিটি তথা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে বিরোধী দলের ভূমিকা ছিল প্রতিবারই নগণ্য। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। পরিণামে সামাজিক যে মেলবন্ধন তাতে ভাঙন শুরু হয়েছে_ বেড়েছে সহিংসতা, অসহিষ্ণুতা, যা মূল্যবোধের অবক্ষয়ে তারকের ভূমিকা রাখছে। একে অন্যের বিশ্বাসকে গুরুত্ব দিচ্ছে না, ব্যক্তিগত বিশ্বাসকেই সর্বত্র প্রাধান্য দিতে চাইছে। পারস্পরিক সমালোচনাগুলো হচ্ছে প্রতিহিংসার বিষোদ্গার কিংবা উদ্দেশ্যমূলক আক্রমণ। দেশের আমলা, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী প্রতিটি অংশ আজ বিভক্ত, দেশ ও জাতির বৃহৎ স্বার্থে একত্র হতে পারছে না। আমাদের গণতন্ত্র আজ বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য দাতা সংস্থানির্ভর, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আজ তার শিক্ষক আর দেশের কিছু বিত্তবান অযোগ্য লোক তার ধারক। আমরা সাধারণরা শুধু বলে যাই, লিখে যাই, সেগুলো তাদের কর্ণকুহুরে প্রবেশ করে না, তাদের বোধোদয় হয় না। তাহলে আমাদের টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ কত দূর? আমাদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিরা কি দেখছেন না, একুশ শতকের পৃথিবীর প্রতিটি দেশ কীভাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত; অথচ আমরা কি সেই যাত্রায় তাল রাখতে পারছি? আমাদের সীমান্তবর্তী দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের জল ও স্থলভাগের সীমানাসহ অনেক বিষয় আজও অমীমাংসিত। তাদের ক্রমাগত শক্তি সঞ্চয়ের সঙ্গে ভারসাম্য না থাকলে আমাদের নিরাপত্তা যে হুমকির সম্মুখীন_ সেটি নিশ্চয় অনুধাবনীয়। আমাদের অনেক দেরি হয়ে গেছে; তবুও আমরা স্বপ্ন দেখি, আশায় বাঁধি বুক। প্রজন্মের প্রতিটি মানুষের উচিত নিজ নিজ অবস্থান থেকে মেধা, বিবেক ও একাগ্রতার সঠিক সমন্বয়ের মাধ্যমে ছোট পরিসরে হলেও সমাজ ও রাষ্ট্রীয় স্বার্থে কাজ করা। কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা যারা নিয়ন্ত্রণ করছেন, দয়া করে আপনারা বৃহৎ স্বার্থে একই অবস্থানে আসুন, জাতীয় সম্পদ থেকে লোভ সংযত করুন, সংসদকে প্রাণবন্ত করুন, সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করুন এবং দয়া করে বহির্শক্তিকে যথাসম্ভব দূরে রাখুন।
সুইডেনের স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ে জৈব রসায়নে গবেষণারত
redoxrouf@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.