আওয়ামী লীগ এখন এক পিচ্ছিল ঢালুতে-রাজনীতি by এম আবদুল হাফিজ

ওয়ামী জনপ্রিয়তা হ্রাসের অনেক কারণ উপরে উঠে এলেও তার অতিরিক্ত কিছু প্রচ্ছন্ন কারণও এই জনপ্রিয়তা হ্রাসে প্রভাব রেখেছে। আমার ধারণায় তা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের জাতীয় পরিচিতি বোধ যা এই ভূখণ্ডের ইতিহাসের ধারাবাহিকতার মধ্যে নিহিত তা প্রকাশের আকুতি।


যেভাবে দেশ চলছে আমাকে অনেকে প্রশ্ন করে, আগামীতে আমরা আমাদের বিশ্বাস ও ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে থেকে ভবিষ্যতে বাঁচতে পারব তো? যে কারণেই হোক আমাদের কর্তাব্যক্তিরা জনগণের মনস্তত্ত্বে সেই স্পর্শকাতর স্থানটি শনাক্ত করতে পারছেন না

নতুন বছর এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের ক্ষমতাসীন হওয়ার তিন বছর পূর্তি প্রায় হাত ধরাধরি করেই এসেছে। সরকারের একটি নির্মোহ মূল্যায়ন করার এটি মোক্ষম সময়। তাই নগরে, জনপদে, মিডিয়ায়, সুশীল সমাজে ও বিদগ্ধ মহলে একই কৌতূহল, একই প্রশ্ন এবং একই বিশ্লেষণ যে জনমতের মাপকাঠিতে মহাজোটের প্রধান চালিকাশক্তি আওয়ামী লীগের অবস্থান এখন কোথায়? দলটি বিগত নির্বাচনের প্রাক্কালে তার পক্ষে যে উন্মাদনা ও গণজোয়ার সৃষ্টি করতে পেরেছিল সেগুলোর কতটুকু অবশিষ্ট আছে? আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট দিনবদলের শপথ, অসংখ্য প্রতিশ্রুতি ও কিরা-কসম খেয়ে ভোটারদের মোহাবিষ্ট করে ক্ষমতায় এসেছিল ঠিকই, কিন্তু শপথ ভঙ্গ ও অপূর্ণ প্রতিশ্রুতির দায়ভারে তাদের প্রাক্-নির্বাচন ভাবমূর্তি ভীষণভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। তাই সরকারের কর্তা ব্যক্তিদের চাপাবাজিতে তার সাফল্য কিছু থাকলেও ব্যর্থতাই প্রকট হয়ে উপরে উঠে এসেছে।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সাংগঠনিক সংশ্লিষ্টতার কারণে গণমানুষের কাছে কিছুদিন আগে পর্যন্ত দলটির একটি প্রচণ্ড আবেদন ছিল, যা তার (দলটির) বহু ব্যর্থতার জন্য এখন অনেকটাই ফিকে হয়ে এসেছে। সাধারণ জনগণ পূর্বেও একাধিকবার একাধিক সরকারের কাছে প্রতারিত হওয়ায় এখন ঘরপোড়া গরুর মতো আওয়ামী লীগসহ এ দেশের রাজনীতিকদের সম্বন্ধে সন্দিগ্ধ হয়ে উঠেছে এবং একটি সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। সব সরকারই এদেরকে কমবেশি ঠকিয়ে এবং শোষণ করেই ঝাঁকে ঝাঁকে ইয়াবাসেবী, ভোগবাদী ও ধনিকের উদ্ভব ঘটিয়েছে এবং সম্ভাবনাময় দেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছে। কোনো প্রতিকার করতে না পারলেও জনগণ এদের হাড়ে হাড়ে চেনে। আশ্চর্য নয় যে, আওয়ামীরাও ওই একই কাতারের লোক এবং সাধারণ মানুষরা আভিধানিক অর্থেই এদের উপরে ত্যক্তবিরক্ত। তাই জনগণকে আর প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরিতে দলে টানা বা ভোটের খেলায় পটানো যাবে না।
পরবর্তী নির্বাচনে জিতে আবার ক্ষমতার মসনদে উঠবার জন্য বিভিন্ন দল যখন বিকারগ্রস্ত এবং সে জন্য মাত্র আর দু'বছর সময় প্রস্তুতির জন্য বাকি_ এটাই আওয়ামী লীগের শাসনের একটি নির্মোহ মূল্যায়নের জন্য মোক্ষম সময়। কিন্তু কাজটি বিশাল এবং ব্যাপক। মহাজোট সরকারের ব্যর্থতা ও অপকর্মের এত অধিক ডাইমেনশন যে স্থির করা কঠিন কোনটা উল্লেখ করতে কোনটা বাদ যায়। প্রতিদিনই সেগুলো রাজধানীসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কিছু প্রকাশ্যে ও বেশিরভাগই লোকচক্ষুর অন্তরালে এবং তাদের অজ্ঞাতসারে ঘটে চলেছে। তাই এই মূল্যায়নের সর্বোত্তম এবং সহজ পদ্ধতি হবে প্রতিদিন জাতীয় সংবাদপত্রগুলোর শুধু হেডলাইনে চোখ বুলিয়ে যাওয়া। লক্ষণীয়, সংবাদপত্রগুলো সঙ্গত কারণে আমাদের ও দেশের দুর্গতি নিয়ে বিশদ বর্ণনা থেকে বিরত থাকে। সেদিন দেখলাম মহাজোটের আমলে কেমন ছিল আমাদের জীবন তার মাত্র এক শব্দে ব্যাখ্যা দিয়ে আর কথা বাড়ায়নি সংবাদপত্রটি। শুধু বলেছে 'দুর্বিষহ'।
এই দুর্বিষহ জীবনই আমজনতাকে উপহার দিয়েছে আওয়ামী নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। আশ্চর্য নয় যে, আওয়ামী লীগের এককালের জনপ্রিয়তায়ও ধস নেমেছে। দ্রব্যমূল্য থেকে শুরু করে সরকারের অভ্যন্তরে দুর্নীতি, সামাজিক বৈষম্য, দারিদ্র্যের বিস্তৃতি, মাদকাসক্তির বিস্তার, ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে সরকারের নতজানু অবস্থান, দেশব্যাপী ইয়াবাসেবী ভোগবাদীদের উদ্ভব_ এসবই এই সরকারের বদৌলতে আমরা পেয়েছি।
প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিরা তাদের পদাধিকারের বদৌলতে যেসব সাফল্যের ঢাক পিটিয়ে যাচ্ছেন, তার অধিকাংশই নিরতিকার এবং নৈর্ব্যক্তিক। দৃষ্টান্তস্বরূপ যুদ্ধাপরাধের বিচারে (যা দেশবাসীসহ আমিও সমর্থন করি) হয়তো আমাদের অন্তর্জ্বালা প্রশমিত হবে কিন্তু তাতেই কি ছাত্রলীগের তাণ্ডবসহ দেশের নষ্ট শক্তিগুলো অন্তর্হিত হবে? বিনষ্ট হবে গুপ্তহত্যার সংস্কৃতি, যাকে এক সংবাদপত্র বিগত বছরের ট্র্যাজেডি বলে আখ্যায়িত করেছে। তাতে কি প্রতিহত হবে সীমান্তে বিএসএফের ফেলানীসহ নিরপরাধ বাংলাদেশিদের হত্যা বা দেশের অভ্যন্তরে হত্যা, গুম, অপহরণ এবং এ ধরনের নিরাপত্তাহীনতা? তাতেই নিবৃত্ত হবে অর্ধাহারী বা অনাহারীদের জঠরের জ্বালা? তাতে কি এই বিশৃঙ্খল বেসামাল দেশে ফিরবে আইন-শৃঙ্খলা বা আইনের শাসন? বন্ধ হবে দেশব্যাপী নারী নির্যাতনসহ সাতক্ষীরা ছাত্রলীগের 'জুয়েল'দের লোলুপদৃষ্টির শিকার, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক নৃত্যশিল্পীর শ্লীলতাহানি? পরিহাসের বিষয়, সংখ্যালঘুদের নামে রাজনীতি করে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনগুলো।
দেশ ও সমাজের ক্রমাবনতি না ঠেকিয়ে বা সেদিকে নজর না দিয়ে বিরোধীদের কোণঠাসা করে ক্ষমতা পাকাপাকিভাবে কুক্ষিগত করতে ক্ষমতাসীনরা এখন ব্যস্ত। সংবিধান সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংশোধন করে ধর্মনিরপেক্ষতাকে চণ্ড রূপ দিয়ে আল্লাহর ওপর বিশ্বাসকে সংবিধানের একটি ধারা হিসেবে বাদ দিয়ে ও উচ্চ আদালতের ওপর প্রভাব খাটিয়ে সরকার এখন ক্ষমতার প্রলম্বন ও প্রত্যাবর্তনে ব্যতিব্যস্ত।
আওয়ামী জনপ্রিয়তা হ্রাসের অনেক কারণ বোঝা যায় এবং সেগুলো নিয়ে সভা-সেমিনারে বিতর্কও হয়। এমনকি স্বয়ং সরকার সেগুলো নিয়ে উদ্বিগ্ন। দেশের রিজার্ভ নাকি একটি উদ্বেগজনক পর্যায়ে নেমে এসেছে। চতুর্মুখী সংকটে সরকারের মন্ত্রীরাও এখন বেসামাল। জ্বালানি তেল, পরিবহন খরচ, বাড়ি ভাড়া ও সর্বোপরি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির শিকার নিম্ন আয়ের মানুষ এবং পেনশনভোগীদের মধ্যে মুদ্রাস্ফীতির কারণে অস্বস্তিকর পরিবেশ বিরাজ করছে। তাদের সমস্যার কোনো সমাধান সরকারের কাছে না থাকলেও তাদের জন্য রয়েছে এন্তার নীতিবাক্য। যেমন বাণিজ্যমন্ত্রীর তরফ থেকে 'দাম বেশি, কম খান' অথবা অর্থমন্ত্রীর হুঙ্কার 'রাবিশ, বোগাস স্টুপিড, বাজারে একদিন কম যান'। ইত্যাকার কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা। প্রধানমন্ত্রীর বহু নিন্দিত ও সমালোচিত ঢাকা বিভক্তি রাজনীতির রেশ ধরে তার একগুঁয়ে দম্ভোক্তি 'টাকা থাকলে ঢাকা চার ভাগ করতাম'। তিনি তো এও বলতে পারতেন, হতদরিদ্রদের এত দুঃখ, টাকা থাকলে তা তাদের কল্যাণে ব্যয় করতাম। আওয়ামী জনপ্রিয়তা হ্রাসের অনেক কারণ উপরে উঠে এলেও তার অতিরিক্ত কিছু প্রচ্ছন্ন কারণও এই জনপ্রিয়তা হ্রাসে প্রভাব রেখেছে। আমার ধারণায় তা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের জাতীয় পরিচিতি বোধ যা এই ভূখণ্ডের ইতিহাসের ধারাবাহিকতার মধ্যে নিহিত তা প্রকাশের আকুতি। যেভাবে দেশ চলছে আমাকে অনেকে প্রশ্ন করে, আগামীতে আমরা আমাদের বিশ্বাস ও ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে থেকে ভবিষ্যতে বাঁচতে পারব তো? যে কারণেই হোক আমাদের কর্তাব্যক্তিরা জনগণের মনস্তত্ত্বে সেই স্পর্শকাতর স্থানটি শনাক্ত করতে পারছেন না।
অনেক রাজনৈতিক বিবর্তনের পর নব্বইয়ের দশক নাগাদ শুধু 'স্বাধীনতার চেতনা'র আবেদন যাকে পুঁজি করে আওয়ামী লীগ রাজনীতি করেছে, তা কিছুটা ম্লান হয়ে এসেছে।
আওয়ামী লীগের ইনিয়ে-বিনিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার একাধিক ব্যাখ্যা দিয়ে তাকে গ্রহণযোগ্য করার প্রচেষ্টাও গ্রাহ্য করেনি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ। এখন কি তা গ্রহণযোগ্য হবে। আওয়ামী লীগের ক্রমঅবনতিশীল জনপ্রিয়তা তা বলে না।

ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.