জননী সাহসিকা-বাবার অভাব বুঝতে দেননি মা

চারদিকে ভীষণ গোলাগুলি হচ্ছে। বাবা আমার ছোট বোন নুসরাতকে কোলে নিয়ে সেই শব্দ শুনছেন কান পেতে। মা আমাদের সঙ্গে নিয়ে জড়সড় হয়ে বসে আছেন। এমন সময় বাসার বাবুর্চি এসে বললেন, “আর্মি চারদিক থেকে বাসা ঘিরে ফেলেছে।” এ কথা শুনে বাবা ছোট বোনকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে একে একে সব দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন।


তিনি স্পষ্ট বাংলায় বললেন, “আমি যাচ্ছি তোমাদের সঙ্গে, তোমরা আমার গায়ে হাত দেবে না।” মা-ও বাবার সঙ্গে সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে এলেন। উর্দুতে জিজ্ঞাসা করলেন বাবাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? এ কথা শুনে তেড়ে এলেন অস্ত্রধারী কয়েকজন। বন্দুকের বাঁট দিয়ে মায়ের বুক চেপে ধরলেন। প্রচণ্ড ব্যথা পেলেন তিনি।’ ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের ঠিক এক দিন আগে, ১৫ ডিসেম্বর বিকেলে পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসররদের বুদ্ধিজীবী চিকিৎসক ডা. ফজলে রাব্বীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা বলছিলেন তাঁর বড় মেয়ে নাসরীন সুলতানা।
নাসরীন সুলতানার মা জাহান আরা রাব্বীও ছিলেন চিকিৎসক। স্বামীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পরপরই তাঁর খোঁজ করতে এখানে-সেখানে টেলিফোন করেন তিনি। কিন্তু কোন ভাবে স্বামীর খবর উদ্ধার করতে পারলেন না।
‘বাবাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর মাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্যও চেষ্টা চালায় পাকিস্তানি হানাদাররা। এর কারণ আমার জেনেছি পরে।’ কথাগুলো বলে কিছুটা থেমে যান নাসরীন। আবার বলতে শুরু করেন, একাত্তরের দিনগুলির’ কথা, ‘আমাদের বাসা ৭৫ নম্বর সিদ্ধেশ্বরী “জলপাইগুড়ি হাউসে” বসবাসরত বাড়ির নিচতলায় ছিল এই গোপন চিকিৎসাকেন্দ্র। এ ঘটনা রাজাকার ও আলবদরদের মাধ্যমে পাকিস্তানি হানাদারদের কানে পৌঁছায়। আর তাই অন্যান্য বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে তুলে নিয়ে যায় বাবাকে।’
জাহান আরা রাব্বী ছিলেন শক্ত প্রকৃতির মানুষ। সন্তানদের তিনি বুঝতে দেননি মনের ভেতরের অবস্থা। ‘১৮ ডিসেম্বর বাসায় একটা ফোন এল। বাসার বড় মেয়ে হিসেবে আমি ফোনটা ধরলাম। ওপাশ থেকে বলা হলো, “বাসার বড় কাউকে ফোনটা দাও।” এরপর মা এসে ফোন ধরলেন। আমরা কিছুই বুঝতে পারলাম না। মা শুধু বললেন, “লাশটা কোথায় পাওয়া গেছে?” রায়েরবাজার বদ্ধভূমিতে পাওয়া গিয়েছিল বাবার লাশ।’ বলছিলেন নাসরীন।
স্বামী মারা যাওয়ার পর সন্তানদের পুরো দায়িত্ব একাই কাঁধে তুলে নিলেন জাহান আরা। ‘আমাদের পাশে মা এমনভাবে ছিলেন, বাবার অভাব কখনো বুঝতে দেননি। আমরা ঠিক ঠিকমতো পড়ছি কি না, তার খোঁজখবর মা সব সময়ই নিতেন। বাসায় রেডিও, টেপরেকর্ডারসহ নানা ধরনের আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে মা আমাদের মনের খোরাক জুগিয়েছেন, নিজে রবীন্দ্রসংগীতসহ আধুনিক গান যেমন শুনতেন, আমাদেরও শোনাতেন। মা নিজে যেটা করতে পারেননি, আমাদের ভাইবোনদের মাধ্যমে সেটি পূরণ করার চেষ্টা করতেন। বাবা মারা যাওয়ার পরও আমাদের কোনো কিছুতেই কমতি রাখেননি মা।’ আবেগাপ্লুত হয়ে কথাগুলো বলে গেলেন নাসরীন।
এরই মধ্যে ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিভাগে স্নাতকোত্তর পর্যায়ের লেখাপড়া শেষ করলেন বড় মেয়ে নাসরীন সুলতানা। ছেলে ওমর রাব্বী বিএ পাস করলেন আর ছোট মেয়ে নুসরাত রাব্বী চিকিৎসা শাস্ত্রে পড়াশোনা শেষ করে মা-বাবার মতো চিকিৎসক হলেন। এই দীর্ঘ সময়ে বাবাকে হারানো সন্তানদের পাশে জাহান আরা মায়ের মমতা দিয়ে দুঃখ ভুলিয়ে রাখতেন। অফিসে থাকার সময় তিনি খোঁজখবর নিতেন ছেলেমেয়েরা ঠিকমতো খেয়েছে কি না। তাঁর দেরি হলে সে কথা সন্তানদের জানিয়ে দিতেন। আর অফিস শেষে বাসায় ফিরেই সবার আগে খোঁজখবর করতেন সন্তানদের। ছুটির দিনে তিনি ছেলেমেয়েদের বেড়াতে নিয়ে যেতেন এখানে-সেখানে। বাসায় থাকলেও অবসরে সন্তানদের পাশে বন্ধুর মতো বসে নানা-নানির কথা, ছাত্রজীবনের মজার গল্প শোনাতেন। রাতে সবাই মিলে একসঙ্গে বসে খেতেন তিনি।
নাসরীন সুলতানা বলেন, ‘আমি অফিস থেকে ফিরে দেখতাম মা আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। তাঁর ডায়াবেটিস ছিল। আমি নিষেধ করতাম, মা, তুমি না খেয়ে থেকো না, শরীর খারাপ করবে। মা শুনতে চাইতেন না। আমাদের সঙ্গে বসে খেতে পারাই যেন তাঁর রাজ্যের তৃপ্তি!’
নানা শারীরিক অসুস্থতা তাঁকে ক্রমে কাবু করে ফেলছিল। নিজে চিকিৎসক হওয়ার কারণে শরীরের প্রকৃত অবস্থা বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। ২০০০ সালের এপ্রিলের শেষের দিকে জাহান আরার শরীরের অবস্থার অবনতি হলো।
‘এরপর ২৫ মে মা চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। আমাদের মাথার ওপর থেকে যেন ছাদ সরে গেল সেদিন থেকে। নিজেকে অসহায় মনে হলো। মা চলে যাওয়ার পরের দিনগুলো কেমন যেন একাকিত্ব আর শূন্যতার মধ্য দিয়ে কাটতে লাগল।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন নাসরীন।
তিনি বলেন, ‘মা কখনোই নিজেকে একজন নারী মনে না করে পুরুষের পাশাপাশি সমানতালে এগিয়ে যাওয়ার অদম্য প্রচেষ্টা নিয়ে সংগ্রাম করেছেন আজীবন। মা না থাকলে আমরা ভাইবোনেরা কেউই এত সহজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারতাম না।’
মোছাব্বের হোসেন

No comments

Powered by Blogger.