বিভক্তি নয়, সমন্বিত ব্যবস্থাতেই সমাধান-ঢাকা সিটি করপোরেশন by আবু সাঈদ খান

ঢাকার চারশ' বছর পুরনো ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে এখানকার অধিবাসীরা গর্বিত। কিন্তু দীর্ঘ সময়ে ঢাকা যে পরিকল্পিত নগর হিসেবে গড়ে ওঠেনি সে সত্যও সকলের জানা। অপরিকল্পিত ও জনবহুল নগরীটি এখন হাজারো সমস্যায় জর্জরিত। সমস্যাকীর্ণ নাগরিকরা তাই ক্ষুব্ধ এবং আতঙ্কিতও বটে।


যানজট, অপ্রতুল ও বেহাল রাস্তা, বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাস সংকট, পয়ঃনিষ্কাশনের অব্যবস্থাপনা, জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপ, গৃহায়ন সমস্যা, নিরাপত্তাহীনতা, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিসহ নানা সমস্যা নাগরিক জীবন থেকে স্বস্তি-শান্তি শুষে নিচ্ছে। অনেকে অতিষ্ঠ হয়ে বলছে, 'না, এভাবে আর বসবাস করা চলে না। পালিয়ে যেতে পারলে বাঁচি।' কেউ কেউ বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে। কিন্তু সবার সে সুযোগ নেই। তাছাড়া সবাই দেশের মাটি ছেড়ে যেতে চায় না। বাস্তবে তা সম্ভবও নয়। আর দেশের অন্য কোনো শহর বা লোকালয়ে গিয়ে বসতি গড়বে_ সে সুযোগ কোথায়? দেশে এমন আর কোনো শহর গড়ে ওঠেনি_ যেখানে নাগরিক সুবিধা ঢাকার সঙ্গে তুলনীয়।
ঢাকায় হাজারো সমস্যা আছে, তেমনি সব রকম নাগরিক সুযোগ-সুবিধাও আছে। ঢাকায় সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি সেবা প্রতিষ্ঠান, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রীয় দফতর অবস্থিত। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ঢাকায় থাকতে হচ্ছে। এ নগরকে ঘিরেই কলকারখানা গড়ে উঠেছে। তাই সবাইকে এখানে চাকরি ও উচ্চশিক্ষার জন্য আসতে হচ্ছে, আসতে হচ্ছে চিকিৎসাসেবা পেতেও। আর যারা ঢাকায় ঢুকে পড়েছে, তাদের ফিরে যাওয়ার বিকল্প জায়গা নেই। তাই বাধ্য হয়ে হাজারো সমস্যার সঙ্গে বসবাস করছে তারা। দেশের নীতিনির্ধারকরা ঢাকার এই সমস্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। তারা এর সমাধানও খুঁজছেন। কিন্তু সঠিক কর্মপরিকল্পনার দেখা মিলছে না। বরং সমস্যা সমাধানে এমন উদ্যোগ আসছে, যা সমাধানের বদলে সমস্যাকে ঘনীভূত করে তুলছে।
অতি সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ রাজধানীকে দু'ভাগ করে উত্তর ঢাকা সিটি করপোরেশন ও দক্ষিণ ঢাকা সিটি করপোরেশন করার প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এতে নগরবাসীর কতটুকু লাভ? ঢাকা সিটি করপোরেশনে আগে মেয়র একজন ছিলেন, এখন দু'জন হবেন। মেয়রের কার্যালয় দুটি হবে। সরকারি দফতরের ভবন ও জনবল দ্বিগুণ হবে, যানজটের নগরীতে গাড়ির সংখ্যা কিছুটা হলেও বাড়বে, খরচও হবে দ্বিগুণ।
কিন্তু এ বিভক্তি কি যানজট কমাবে? বিদ্যুৎ-পানি-গ্যাস সংকট দূর করবে? জননিরাপত্তা নিশ্চিত করবে? নগর বিভক্ত হলেও সমস্যা সমাধানের কোনো পরিকল্পনা এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে না। ফলে কোনো সংকটই দূর হবে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংকট নিরসনের জন্য যথার্থ উদ্যোগ নেবেন। আমার মনে হয়, সেটিই সর্বাগ্রে নেওয়া প্রয়োজন। তারও চেয়ে বড় প্রশ্ন, এই দুই খণ্ড নগরের মধ্যে সমন্বয় কীভাবে হবে? তা কার নিয়ন্ত্রণে থাকবে? বিকেন্দ্রীকরণের প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই আছে। তবে খণ্ডিতকরণের দরকার নেই। খণ্ডিতকরণ ও বিকেন্দ্রীকরণ এক নয়। বিকেন্দ্রীকরণ হওয়া দরকার প্রশাসন ও সেবা সুযোগকে আরও মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনে। একই শহরে দুটি মেয়র ভবন হলে তার মাধ্যমে জনগণের কাছে সেবা সহজলভ্য হয় না, বরং কাউন্সিলর অফিস করে সেখানে সেবার সুযোগ ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হলে সেটি হতো অনেক বেশি যৌক্তিক।
১৯টি মন্ত্রণালয়ের ৫২টি সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা একটি বড় সমস্যা। সিটি করপোরেশনের হাতে নেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা। সিটি করপোরেশনের অর্থায়ন থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রেই সরকারনির্ভর প্রতিষ্ঠান। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোয় এ সংকট নিরসনে সিটি বা মেট্রোপলিটন সরকার করা হয়েছে। ঢাকার সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফ, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন সিটি মেয়রের প্রস্তাব করেছিলেন। বর্তমান মেয়র সাদেক হোসেন খোকাও এ দাবি সমর্থন করছেন। সিটি গভর্নমেন্ট করে এটিকে স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হলে সমস্যা সমাধানের পথ খুলে যেত। সে উদ্যোগ না নিয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দ্বিখণ্ডিত করা আসলে হীন রাজনৈতিক বিবেচনাপ্রসূত।
জনমনে এ ধারণা প্রবল যে দলীয় প্রার্থী জিতবে কি-না তা চিন্তা করে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বাধা সৃষ্টি করছে ক্ষমতাসীন দল। সে কারণে ৫ বছরের জন্য নির্বাচিত পরিষদ ১০ বছর ছুঁয়েছে। নির্বাচন না করে করপোরেশনকে সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনার সহজ পথ হলো_ দুই সিটি করপোরেশন করে দুই প্রশাসক নিয়োগ। সেই সঙ্গে শুরু হবে নতুন নতুন ভবন নির্মাণের ঠিকাদারি, এতে কিছু লোকের ভাগ্য ফিরবে। আর নগরবাসী যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই থাকবে।
লন্ডন, নিউইয়র্ক, টোকিও, দিলি্ল, কলকাতার মতো বৃহৎ নগরী যদি একই সিটি করপোরেশনের অধীনে পরিচালিত হয়, তবে ঢাকায় কেন সেটা সম্ভব নয়? কেউ কেউ বলছেন, ভবিষ্যতের ক্রমবর্ধমান কলেবর চিন্তা করে এটি করা হচ্ছে। এর মানে অজগর সাপের মতো ঢাকা আশপাশের গ্রাম, জলাশয়, বনভূমি গ্রাস করে বিস্তৃত করতে থাকবে। ঢাকা ২০-৩০ বছরে দুই-তিনগুণ হয়ে যাবে, তাই তারা দুই সিটি করপোরেশন করে রাখলেন। ভাবা দরকার, এভাবে ঢাকাকে যথেচ্ছ বাড়তে দেওয়া ঠিক কি-না? আমরা কি এক নগরের দেশ হয়ে থাকব, না আরও নগর গড়ে তুলে ঢাকার ওপর চাপ কমাব? ঢাকার বাইরে আরও বড় নগরী গড়ে তোলা উচিত নয় কি?
ঢাকার পর বড় শহর চট্টগ্রাম। সেটিকে বাণিজ্যিক রাজধানী বলা হলেও সেখানকার ব্যবসায়ীদের প্রতিনিয়ত ঢাকায় ছুটতে হচ্ছে। ঢাকায় রাখতে হচ্ছে তাদের হেড অফিস বা লিয়াজোঁ অফিস। সে ক্ষেত্রে সরকারের বাণিজ্যিক দফতরগুলো চট্টগ্রামে স্থানান্তরে বাধা কোথায়? একইভাবে সরকারের বিভিন্ন প্রধান দফতরগুলো বিভিন্ন জেলায় স্থানান্তরিত হতে পারে। বিভাগীয় শহরগুলো একেকটি বৈশিষ্ট্য ও মর্যাদায় ভূষিত হতে পারে। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, চট্টগ্রাম পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্যিক নগর, সিলেটকে আইটি নগর, খুলনাকে শিল্পনগরী, রাজশাহীকে সাংস্কৃতিক নগরী হিসেবে গড়ে তোলা যায়। আমি এগুলো উদাহরণ হিসেবে বলছি, কোন শহরকে কোনভাবে গড়ে তুলতে হবে তা নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্তের বিষয়। তবে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। পাশাপাশি, বিভাগীয় ও জেলা শহরের গুরুত্ব বাড়াতে হবে, আর গ্রামে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে যেতে হবে_ যাতে নগরবাসী চাকরি শেষে নিজ নিজ গ্রামে ফিরে যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্টরাও মেয়াদ শেষে নিজ নিজ শহরে ফিরে যান, আমাদের দেশে কেউ একবার ঢাকায় ঢুকে পড়লে তিনি আর ফেরার চিন্তা করেন না। এমন অনেকে আছেন যারা ঢাকার বাইরে চাকরি করেন কিন্তু তাদের পরিবারও ঢাকায় থাকে। কারণ ঢাকার বাইরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নেই। তাদের ঢাকার বাইরে রাখতে হলে নাগরিক সুযোগ-সুবিধার বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, কোনো সরকারই বিকেন্দ্রীকরণের নীতি গ্রহণ করছে না। সবকিছুকেই কেন্দ্রমুখী করার প্রবণতা প্রকট। স্বাধীনতার ৪০ বছরে নির্বাচিত জেলা পরিষদ গঠিত হলো না। উপজেলা পরিষদকে পঙ্গু করে রাখা হয়েছে। নির্বাচিত পরিষদ কাজ করতে পারছে না। আসলে বিকেন্দ্রীকরণের জন্য একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন। আর রাজধানীর সমস্যা সমাধানেও সেই দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা কি নগর সরকার, পৌর সরকার, উপজেলা সরকারের কথা ভাবব, না কেন্দ্রনির্ভর ব্যবস্থা চালু রাখব? আমরা এক শহরের দেশ রাখব, না আরেক ডজন বড় শহর গড়ব, গ্রামকে বাসের জন্য আকর্ষণীয় করব, নাকি গ্রাম থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখব_ এসব প্রশ্নের জবাব না খুঁজলে ঢাকার সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান হবে না।
নতুন কোনো শহর গড়ে তুললে তা জনগণকে সম্পৃক্ত করে গড়ে তুুলতে হবে, তা কোনোক্রমেই ওপর থেকে চাপিয়ে দিয়ে নয়। ঢাকা দু'ভাগে ভাগ করার ক্ষেত্রে জনগণের বা জনপ্রতিনিধিদের কোনো সম্পৃক্ততা আছে কি?
না, নগরবাসীর পক্ষ থেকে এমন দাবি ওঠেনি। এ নিয়ে কোনো আলোচনাও হয়নি। হঠাৎ করে শাসক দল এই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে চাইছে। শুনতে চাইছে না অধিবাসীদের মতামত। অথচ স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইনে (২০০৯) নতুন সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ৩/(৪)/ছ ধারায় জনমতের বিষয়টির উল্লেখ রয়েছে। তাই জনমত গ্রহণ না করে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দ্বিখণ্ডিত করে দুটি সিটি করপোরেশন করা হলে তা হবে আইনের লঙ্ঘন, জনমতের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন।
বলা আবশ্যক, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনেক সমর্থক ও বিরোধী দলের সমর্থকরা একযোগে সিটি করপোরেশন দুই ভাগ করার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন। ৪ জন ডেপুটি মেয়রের পদ সৃষ্টি করে বিকেন্দ্রীকরণ প্রস্তাবও করেছেন তারা। এ প্রস্তাব বিবেচিত হতে পারে। তবে সেবা সংস্থাগুলোর কাজের সমন্বয়, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতার বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। আর তা করতে নগর সরকারের বিষয়ও ভাবতে হবে।

আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
 

No comments

Powered by Blogger.