কৃষি উপকরণ সহায়তা-কিষানীদের আরও কার্ড দিন by জিয়াউল হক মুক্তা

বাংলাদেশের আর্থসামাজিক গঠনরূপে যে পরিবর্তন এসেছে এবং যার ফলে কৃষিতে নারীর চিরায়ত ও ব্যাপক অংশগ্রহণের পাশাপাশি মালিকানা সূত্রে, বর্গাচাষ ও জমির ইজারা গ্রহণের মাধ্যমে এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ার ব্যবস্থাপক হিসেবে নারীর 'কৃষক' হয়ে ওঠা সম্পর্কে নীতিনির্ধারকরা সচেতন বলে মনে হয় না মহাজোট সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পরপরই যে ক'টি কৃষিবান্ধব পদক্ষেপ নিয়েছে তার অন্যতম হচ্ছে কৃষকদের জন্য 'উপকরণ সহায়তা কার্ড' প্রবর্তন।
সরকার মোট এক কোটি তিরাশি লাখ কৃষককে এ কর্মসূচির আওতায় আনার পরিকল্পনা করে। তাদের মধ্যে এক কোটি সাঁইত্রিশ লাখ কৃষককে এ কার্ড দেওয়া হয়। সরকারের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গ সম্প্রতি জানিয়েছেন, বাকি কার্ডগুলো যাচাই-বাছাইসাপেক্ষে খুব শিগগিরই প্রদান করা হবে। আশা করা যায় যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় বর্গাচাষি ও নারীকৃষকদের অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি তারা ভুলে যাবেন না। বাংলাদেশে ব্যাপক মাত্রার অনুপস্থিত ভূমি-মালিকানা ও কৃষিতে নারীর ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণের প্রেক্ষাপটে 'গ্রামীণ জীবনযাত্রার স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের জন্য প্রচারাভিযান' ও কৃষক-ক্ষেতমজুর সংগঠনগুলো শুরু থেকেই বর্গাচাষি ও নারীকৃষকদের এ কর্মসূচির আওতায় আনার দাবি জানিয়ে আসছে।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১১ অনুসারে কৃষি খাত থেকে অর্জিত হচ্ছে দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ১৯.৯৫ শতাংশ; অন্যদিকে কর্মসংস্থান জরিপ পরিবীক্ষণ প্রতিবেদন ২০০৯ অনুসারে ১৫ বছরের বেশি বয়সী ও কর্মে নিয়োজিত পাঁচ কোটি দশ লাখ শ্রমশক্তির ৪৩.৫৩ শতাংশ জড়িত আছেন কৃষি, মৎস্য ও বন খাতে; সংখ্যাবিচারে যা দুই কোটি বাইশ লাখ। খাতওয়ারি নারী-পুরুষের সুনির্দিষ্ট সংখ্যা এ প্রতিবেদনে না থাকলেও বলা হয়েছে, কৃষি ও সেবা খাতে নারীর অংশগ্রহণ পুরুষের চেয়ে বেশি। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরিচালিত অনেক বেসরকারি গবেষণা থেকেও কৃষিতে নারীর বর্ধিত অংশগ্রহণের সত্যতা জানা যায়। উপরন্তু বাংলাদেশের সরকারি পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিগত দশকে শতাংশের হিসাবে কৃষি, মৎস্য ও বনজ খাতে পুরুষের অংশগ্রহণ কমছে আর নারীর অংশগ্রহণ কমেছে শিল্প খাতে। কৃষিশুমারি ২০০৮ অনুসারে দেশের দুই কোটি ছিয়াশি লাখ সত্তর হাজার পরিবারের মধ্যে উননব্বই লাখ সাতাশ হাজার পরিবার কৃষিতে নিয়োজিত। আর বাংলাদেশের কৃষিতে যে পরিবারের নারী-পুরুষ উভয়ে শ্রম দেন তা সর্বজনবিদিত।
উলি্লখিত পরিসংখ্যানগুলোর সারকথা হলো কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। এর সঙ্গে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পর্যবেক্ষণ লব্ধ অভিজ্ঞতা মিলিয়ে বলা যায়, নারীর অংশগ্রহণ কেবল পরিবার-সদস্য বা মজুরি-শ্রমিক হিসেবেই যে বেড়েছে তা নয়; এছাড়াও প্রথমত মালিকানা সূত্রে, দ্বিতীয়ত বর্গাচাষ ও জমির ইজারা গ্রহণের মাধ্যমে এবং তৃতীয়ত উৎপাদন প্রক্রিয়ার ব্যবস্থাপক হয়ে পরিপূর্ণ কৃষক হিসেবে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে ব্যাপকভাবে। এটা বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবন ও কৃষি ক্ষেত্রের সাম্প্রতিকতম রূপান্তর। নতুনতর গবেষণা এ পর্যবেক্ষণের সত্যতা প্রমাণ করবে অনিবার্যভাবে।
যে এক কোটি সাঁইত্রিশ লাখ উপকরণ সহায়তা কার্ড প্রদান করা হয়েছে, তার মধ্যে কয়টি নারীরা পেয়েছেন সে তথ্য কোথাও থেকে জানা যায়নি। তবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সরকারের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিরা যেভাবে বিষয়টিতে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন তা থেকে মনে হয় না, বিষয়টির প্রতি তারা সংবেদনশীল। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক গঠনরূপে যে পরিবর্তন এসেছে এবং যার ফলে কৃষিতে নারীর চিরায়ত ও ব্যাপক অংশগ্রহণের পাশাপাশি মালিকানা সূত্রে, বর্গাচাষ ও জমির ইজারা গ্রহণের মাধ্যমে এবং উৎপাদন প্রক্রিয়ার ব্যবস্থাপক হিসেবে নারীর 'কৃষক' হয়ে ওঠা সম্পর্কে নীতিনির্ধারকরা সচেতন বলে মনে হয় না ।
কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার বহালবাড়িয়া ইউনিয়নের খাদিমপুর গ্রামের ৬০ বছর বয়সী কৃষক আম্বিয়া খাতুন একজন কৃষিমজুর হিসেবে কয়েক দশক আগে মাঠের কাজ শুরু করেছিলেন; ক্রমে তিনি লিজ নেওয়া জমিতে কৃষি কাজ করে এবং গৃহে শাকসবজি ও পশুপাখি পালন করে জমির মালিক হন; কৃষিতে কায়িক শ্রম প্রদান, বীজতলা তৈরি থেকে শুরু করে কম্পোস্ট সার তৈরিসহ তিনি নিজের তিন বিঘা জমির পুরো উৎপাদন প্রক্রিয়ার ব্যবস্থাপক হিসেবে সরাসরি ভূমিকা রাখেন। ২০১১ সালের ৩ মার্চ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গ্রামীণ জীবনযাত্রার স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের জন্য প্রচারাভিযান আয়োজিত 'নারীকৃষক শুনানি'তে এবং ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে আম্বিয়া খাতুন তার বক্তব্যে বলেন, 'শুনেছি সরকার কৃষকদের কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড দিয়েছে। এ কার্ড পেলে নাকি সেচ খরচের জন্য টাকা পাওয়া যায়। কিন্তু আমি কোনো কার্ড পাইনি। কিষানী হিসেবে আমি একটা কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড চাই। তাহলে আমার কাজ করতে অনেক সুবিধা হবে।' তার এ ন্যায্য-সরল দাবির প্রতি প্রধানমন্ত্রী কী জবাব দেবেন? পুরুষকৃষকরা কার্ড পেলে নারীকৃষকরা পাবেন না কেন? নরসিংদীর পলাশ উপজেলার জিনারদি ইউনিয়নের গাবতলী গ্রামের ৪৫ বছর বয়সী দেলোয়ারা বেগমও কুষ্টিয়ার আম্বিয়া খাতুনের মতো দিনমজুর থেকে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে কৃষক হয়েছেন। তিনি বলেন, 'আগে লোকজন মেয়েদের জমিতে কাজ করাকে ভালো চোখে দেখত না। তারপরও বিভিন্ন সমালোচনা সহ্য করে কিছু জমি বর্গা নিয়ে কৃষি কাজ শুরু করি। আমি সাহস করে মাঠের কাজে নামি এবং রোজগারের টাকা সংসারের কাজে লাগাই। পরে আমাকে অনুসরণ করে এলাকার অন্য গরিব নারীরাও জমিতে কাজ শুরু করেন। এখন আমরা অনেক নারী একসঙ্গে মাঠে কাজ করি এবং কেউ কিছু বলতে এলে একসঙ্গে জবাব দিতে পারি। আমি কিছু জমি বর্গা নিয়ে ধান, কচু ও সবজি আবাদ করি। আমি সরকারের কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড পাইনি।' মানিকগঞ্জ সদরের পাঞ্জনখাড়ার ৫০ বছর বয়সী কৃষক সাহিদা বলেন, 'ছেলেকে সঙ্গে করে নিজের কিছু জমি আর কিছু জমি বর্গা নিয়ে কৃষি কাজ শুরু করি। যা আয় হয় ঋণ শোধ করতে গিয়ে কিছুই থাকে না। ২০১০ সালে আমি তামাকের চাষ করি। ভেবেছিলাম তামাক বিক্রির টাকায় ঋণ শোধ করব। কিন্তু শিলাবৃষ্টিতে সব তামাক নষ্ট হয়ে যায়। ঋণ আর পরিশোধ করা হয়নি। ঋণের বোঝা আরও ভারি হতে থাকে। স্থানীয় চেয়ারম্যানের কাছ থেকেও কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পাইনি। এখন আমি দিনমজুরি করছি।'
বাংলাদেশের কৃষিতে নারী তার চিরায়ত ভূমিকা ছাপিয়ে নতুন ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব রূপকল্প ২০২১ ঘোষণা করেছেন; দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার অঙ্গীকার করেছেন। অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ঘোষণা করা হয়েছে; নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নকে সরকারের অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদনের নতুন শক্তি নারীকৃষককে উপকরণ সহায়তা কার্ড প্রদান না করে কি সরকারের এতসব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গীকার পূরণ সম্ভব?

জিয়াউল হক মুক্তা : কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.