কল্পকথার গল্প-অকৃত্রিম বাঁশের বহুমুখী ব্যবহার by আলী হাবিব

বাঁশ না চেনার তো কোনো কারণ নেই। 'দোলনা হইতে মৃত্যু পর্যন্ত' শিক্ষা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। এই দোলনা তৈরিতে বাঁশ ব্যবহৃত হয়। মৃত্যুর পর দাফনের সময় বা দাহ করার সময়ও এই বাঁশ কাজে লাগে। সোজা হিসাবে জন্মের পর থেকে বাঁশ ছাড়া জীবন অচল। জীবনের বাঁকে বাঁকে বাঁশের বহুমুখী ব্যবহার। অর্থাৎ মর্তে আমরা যে জীবনটি অতিবাহিত করি, এই জীবনে বাঁশ ছাড়া আমাদের চলে না। বাঁশের বিকল্প নেই।


আমাদের যেমন বাঁশ লাগে, তেমনি বাঁশ দেওয়ার মানুষেরও আকাল নেই। অনেকেই বাঁশ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকে। তারা সুযোগ পেলে বাঁশ দেয়। বাঁশ না দিলে অনেকের মনের আশ মেটে না। এই যে বাঁশ দেওয়ার কথা বলা হলো, এটা অনেক ক্ষেত্রেই নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হয়। এ নিয়ে প্রচলিত একটি গল্প আগে বলে নেওয়া যাক। সে আমলে আজকের দিনের মতো ইন্টেরিয়র ডিজাইনের প্রচলন তো ছিল না। ছিল না আজকের দিনের মতো ডেকোরেটর। ইচ্ছে করলেই একটা মঞ্চ সাজানো যেত না। সে রকম সময়ে কোনো একটি স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। মঞ্চ তৈরি করতে হবে। বাঁশ অনিবার্য। কোথায় পাওয়া যাবে বাঁশ। গ্রামের এক ধনাঢ্য ব্যক্তির ছিল বেশ বড় বাঁশঝাড়। স্কুলের ছাত্রদের নিয়ে প্রধান শিক্ষক গেলেন তাঁর কাছে। বাঁশ তাঁকে দিতেই হবে। অনেক কথার পর ভদ্রলোক রাজি হলেন। বলে রাখা ভালো, সে আমলে গ্রামের স্কুলের জন্য শুধু বাঁশ নয়, আরো অনেক কিছু এভাবে সংগ্রহ করতে হতো। যা হোক, গ্রামের সেই ভদ্রলোকের বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ কেটে আনা হলো। তৈরি হলো মঞ্চ। ভদ্রলোককে এর বিনিময়ে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি করা হলো। নির্দিষ্ট দিনে তিনি এলেন। বিজয়ী ছাত্রছাত্রীদের হাতে পুরস্কার তুলে দিলেন। এরপর বক্তৃতার পালা। প্রধান শিক্ষক স্কুলের অন্যান্য শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীর পক্ষ থেকে ভদ্রলোককে ধন্যবাদ জানালেন। ভদ্রলোক নিজেও অভিভূত। সামান্য কয়েকটা বাঁশ দিয়েছেন তিনি। তার বিনিময়ে স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে তাঁকে প্রধান অতিথি করে আনা হয়েছে। এটা অনেক বড় সম্মান তাঁর কাছে। তাঁর বক্তৃতা করার পালা এলো। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, 'বাঁশ আমি দিয়েছি। আরো দেব। যত লাগে তত দেব। বাঁশ দিতে একেবারেই কার্পণ্য করব না। এখন যেমন দিয়েছি, সে রকম ভবিষ্যতেও বাঁশ আমি দিয়েই যাব।' কী সাংঘাতিক!
তা দেবেন ভালো কথা। কিন্তু বাঁশ দেওয়ার এই প্রকাশ্য ঘোষণা কি ভালো শোনায়? বাঁশদান করা আর বাঁশ দেওয়া কি এক হলো? বাঁশ দেওয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। বাঁশ যাকে দেওয়া হয়, তিনিই জানেন বাঁশ কাকে বলে, কত প্রকার ও কী কী! স্বাভাবিকভাবেই কেউ বাঁশ দিতে চাইলে সাবধান হয়ে যাওয়াটাই সমীচীন। বাঁশ শুধু দিলেই হবে না। বাঁশ কে, কিভাবে দিচ্ছে, সেটাও সম্যক জানা থাকা চাই। বাঁশের বহুমুখী ব্যবহার যেমন আছে, তেমনি আছে দেওয়ার কৌশল।
বাঁশের বহুমুখী ব্যবহার আর বাঁশ দেওয়ার কৌশল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে জেনে নেওয়া যাক, বাঁশ জিনিসটা কী? বিজ্ঞান বলছে বাঁশ হচ্ছে একটি ঘাসজাতীয় উদ্ভিদ। মাটি ভেদ করে যখন ওঠে তখন এটাকে তো উদ্ভিদই বলতে হবে। নানা জাতের বাঁশ হয়। জাতভেদে এর ব্যবহার। ঘাস হলেও বাঁশের একটা বড় গুণ হচ্ছে এই উদ্ভিদটি খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়। এমনও দেখা গেছে, কোনো কোনো জাতের বাঁশ ২৪ ঘণ্টায় ১০০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বাড়ে। বাঁশের এই বাড়বাড়ন্ত নিয়ে গবেষণা করবেন উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা। আমরা আপাতত বাঁশের ব্যবহার নিয়ে কথা বলি। কোন কোন কাজে বাঁশ ব্যবহৃত হয়? একটা সময় ছিল যখন বাঁশ ছাড়া কোনো ঘরের চিন্তা করা যেত না। সে সময়ে আজকের দিনের মতো মাল্টিস্টোরিড ছিল না। বিশেষ করে, গ্রামাঞ্চলে যে বেড়ার ঘর ছিল, তার জন্য বাঁশ ব্যবহৃত হতো। এমনকি মাটির ঘরের শক্ত খুঁটি তৈরিতেও ব্যবহার করা হতো বাঁশ। আর এটা তো আমরা সবাই জানি, খুঁটি শক্ত না হলে টিকিয়ে রাখা যেমন মুশকিল, তেমনি টিকে থাকাও মুশকিল। অর্থাৎ টিকে থাকা ও টিকিয়ে রাখার জন্য বাঁশ অপরিহার্য। টিকে থাকার জন্য অন্যকে বাঁশ দেওয়াটাও কী অপরিহার্য? এ প্রশ্নের জবাব না হয় পরে জানা যাবে। আপাতত বাঁশের ব্যবহার নিয়েই কথা বলা যাক। ঘরের খুঁটির পাশাপাশি একসময়ে বাঁশ দিয়ে চমৎকার সিলিং তৈরি হতো। সেই সিলিং তৈরির জন্য বিশেষ বিশেষ কারিগর থাকতেন। গ্রামে কি আজকাল ধানের গোলা দেখতে পাওয়া যায়? একসময় গোলা ছিল একটি অসামান্য শিল্প। গোলা তৈরিতেও ব্যবহৃত হতো বাঁশ। বাড়ি কিংবা ক্ষেতের সীমানা বেড়া দিতেও বাঁশ লাগত। জাল ছাড়া মাছ ধরার নানাবিধ সরঞ্জাম তৈরি হতো বাঁশ দিয়ে। গরু, ঘোড়া কিংবা মহিষের গাড়ি তৈরি করতেও বাঁশ ব্যবহৃত হয়। আর ছিল বাঁশের লাঠি। একটু পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যাবে, লাঠি ছাড়া জোতদারি চলত না। লাঠিয়াল পুষতে হতো জোতদারদের। সেই লাঠি তৈরি করা হতো বাঁশ দিয়ে। বাংলার ঐতিহ্য লাঠিখেলা। এই লাঠিখেলার প্রধান যে বস্তুটি, সেই লাঠিও তৈরি করতে হতো বাঁশ দিয়ে। বাঁশ নিয়ে এত যে কথা হচ্ছে, সবই কি নেতিবাচক হয়ে যাচ্ছে? তাহলে একটা ইতিবাচক কথা বলা যাক। প্রেমের প্রতীক হয়ে আছেন যিনি, সেই কৃষ্ণকেও কিন্তু বাঁশনির্ভর হতে হয়েছে। সে আমলে আজকের দিনের মতো এসএমএস ছিল না। ছিল না ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, ই-মেইলের সুযোগ। টুইটারে টুইট করার সুযোগ ছিল না। মাথার ওপর তারাভরা আকাশ ছিল। সেই আকাশে চাঁদ উঠে এলে কৃষ্ণের বুকে প্রেমের জোয়ার আসত। কেমন করে ডাকবেন তিনি রাধাকে? বাঁশ সহায়। 'তরলা বাঁশেরও বাঁশি ছিদ্র গোটা ছয়'! সেই বাঁশিতে বেজে উঠলেই রাধা বুঝতেন 'ইটস টাইম টু লাভ'। মুখে যতই বলুন 'বাঁশি শুনে আর কাজ নাই, সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি'_সে বাঁশির আহ্বান উপেক্ষা করার মতো মনের জোর তো ছিল না তাঁর। প্রেমজ্বরে ভেসে যেত মনের জোর। রাধা ছুটতেন যমুনার দিকে। বাদ দিন রাধাকৃষ্ণের কথা। চণ্ডীদাস যে রজকিনীর জন্য পুকুরের ঘাটে বসে থাকতেন, তাঁর অজুহাত কী ছিল? বড়শি। পুকুরে বড়শি ফেলে তিনি অপেক্ষায় থাকতেন কখন রজকিনী আসবেন সে ঘাটে। সেই বড়শি তৈরিতেও ব্যবহৃত হয় বাঁশ। এই চণ্ডীদাস-রজকিনী ও রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা_এ থেকে এটাই প্রমাণ হয়, প্রেমের নেপথ্যে বাঁশ একটা ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।
বাঁশের এই প্রেমজ ব্যবহারের বিষয়টি সবারই জানা। অন্য বিষয়ে যাওয়া যাক। একসময়ে গৃহস্থালির নানা কাজে ব্যবহৃত হতো বাঁশ। আজকাল সেসব অনেক কমে গেছে। কিন্তু বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ উঠে এসেছে আমাদের ড্রইং রুমে। বাঁশ দিয়ে তৈরি হচ্ছে চমৎকার সব শোপিস। বাঁশের অ্যাশট্রে, বাঁশের ফুলদানি, বাঁশের সোফা, বাঁশের মোড়া থেকে শুরু করে ঘর সাজানোর আরো অনেক উপকরণ আজকাল পাওয়া যায়। শুধু দেশেই নয়, বিদেশের বাজারেও এসব বাঁশজাত দ্রব্য ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। গলার মালা থেকে হাতের চুড়ি_বাঁশ দিয়ে মেয়েদের নানা রকম গয়নাও তৈরি হচ্ছে। বাঁশ ব্যবহৃত হচ্ছে ওষুধে। বাঁশ দিয়ে কাগজ তৈরির কথা তো আমাদের জানাই আছে। বাঁশির পাশাপাশি বাদ্যযন্ত্রে বাঁশের ব্যবহার আছে। পানি বিশুদ্ধকরণেও বাঁশের ব্যবহার শুরু হয়েছে। বিশেষ করে সমুদ্রের পানির লবণাক্ততা দূর করতে বাঁশের ফিল্টারের নাকি জুড়ি নেই। আজকের দিনে আমরা যে নানা রকমের কলম দেখতে পাই, এই কলমের আদিপিতাও তো বাঁশ। কাজেই বাঁশকে নিছকই বাঁশ ভাবার কোনো কারণ নেই। মহানগরী ঢাকার যানচলাচল নিয়ন্ত্রণে ডিএমপির পুলিশ বিভাগ বাঁশ ব্যবহারের নতুন এক কৌশল আবিষ্কার করেছে।
এবার বাঁশবিষয়ক ভিন্ন গল্পে যাওয়া যাক। বাঁশ থেকেই আদি মানবের আবির্ভাব_আন্দামান এলাকায় একসময় এমন গল্প চালু ছিল। ফিলিপিনসের লোকগল্পে আছে, একসময় সমুদ্র ও আকাশের মধ্যে বেশ বড় একটা যুদ্ধ হয়েছিল। সেই যুদ্ধের পর বাঁশের ভেতর থেকে মানুষের সৃষ্টি। মালয়েশিয়ার লোককাহিনীতে আছে, এক পুরুষ একটা বাঁশবাগানে ঘুমিয়ে ছিল। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সে স্বপ্ন দেখছিল এক সুন্দরী নারীর। ঘুম থেকে জেগে সে একটা বাঁশ ভাঙতেই সেখান থেকে বেরিয়ে আসে অপরূপ সুন্দরী এক নারী।
সুতরাং বাঁশ নিয়ে ভীত হওয়ার কোনো কারণ নেই। তবে 'বাঁশ দেওয়া' থেকে সাবধানে থাকতে হবে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে জাতিকে নানাভাবে বাঁশ দেওয়া হয়েছে। বাঁশের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে জাতি। আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। কিছু দিন আগেও তেমনি এক বাঁশ সরানো হয়েছে। আসলেই সরানো গেছে বাঁশ। নাকি বাঁশ এখনো ঘুরছে পেছনে। কাজেই এই বাঁশ থেকে মুক্তির জন্য বাঁশের মূলোৎপাটন করতে হবে। আমাদের বিশ্বাস, সেটাও সম্ভব।
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.