কিডনি নিয়ে ব্যবসা-অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে

বাংলাদেশে নিষ্ঠুরতম অপরাধের তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন হচ্ছে কিডনি ও লিভারসহ মানবদেহের অতি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ নিয়ে ব্যবসা। কিছু দিন ধরেই পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে অনেক লেখালেখি হচ্ছে। গতকাল শনিবারের (১০ সেপ্টেম্বর) কালের কণ্ঠেও প্রধান শিরোনামসহ দুটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। পুলিশেরই বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারা দেশে কিডনি ও লিভার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ৫৮টি চক্রের সন্ধান পাওয়া গেছে।


এদের প্রধান শিকার দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের দারিদ্র্যপীড়িত জনগোষ্ঠী। এ ব্যাপারে গ্রেপ্তার করা কয়েকজন পুলিশকে এসব তথ্য দিয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে আরো খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। একজন কিডনি ব্যবসায়ী পুলিশকে জানিয়েছে, গত আট বছর ধরে সে এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। আমাদের প্রশ্ন, অর্ধশতাধিক চক্র রাজধানীসহ সারা দেশে দীর্ঘদিন এমন জঘন্য অপরাধ করে এলেও এত দিন কেন তা পুলিশের নজরে এল না?
চিকিৎসাবিজ্ঞান ক্রমেই এগোচ্ছে। সারা দুনিয়ায়ই এখন কিডনি, লিভারসহ বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। কিন্তু তা করা হয় সুনির্দিষ্ট আইন ও নীতিমালার ভিত্তিতে। বাংলাদেশেও ১৯৮৮ সাল থেকে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কেনাবেচা বা বলপ্রয়োগের আশঙ্কা থাকায় ১৯৯৯ সালেই কিডনি প্রতিস্থাপন আইন করা হয়। কিন্তু সেই আইনকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রায় এক দশক ধরে দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের কিডনি কেনাবেচার কাজটি চলে আসছে। সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে দেশে আটটি প্রতিস্থাপন কেন্দ্রের চিকিৎসকরাও জেনে হোক আর না জেনেই হোক, সেই সব কিডনি প্রতিস্থাপন করছেন। অনেকে কিডনি দাতা ও গ্রহীতাকে বিদেশে নিয়েও কিডনি প্রতিস্থাপন করিয়ে আসছেন। তাই কিডনি প্রতিস্থাপন কেন্দ্রগুলোতে আইন ও নিয়ম-কানুন যথাযথ মানা হয়েছিল কি না_সে বিষয়টিও তদন্ত করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়েছে, অতি জঘন্য এই ব্যবসায় বেশ কিছু এনজিওকর্মীরা নানাভাবে সহায়তা করে আসছিল। এর কারণ অভাবে পড়ে অনেক দরিদ্র পরিবার এনজিও থেকে ঋণ নেয়, কিন্তু কিছু দিন পর সুদে-আসলে অনেক বেশি হয়ে যাওয়া সেই ঋণ আর শোধ করতে পারে না এবং পালিয়ে বেড়ায়। এনজিওকর্মীরা তখন ঋণগ্রস্ত পরিবারগুলোকে নানাভাবে চাপ সৃষ্টি এবং কিডনি বিক্রিতে বাধ্য করে। গ্রেপ্তারকৃত কিডনি ব্যবসায়ীরা এনজিওকর্মীদের সহায়তার কথা পুলিশের কাছেও স্বীকার করেছে। তাই দারিদ্র্য দূর করার কথা বলে গ্রামাঞ্চলে ঋণের ফাঁদ পাতা এনজিওগুলোর ব্যাপারেও রাষ্ট্রের নতুন করে চিন্তা-ভাবনা করা প্রয়োজন।
সারা দুনিয়ায় কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য দুই ধরনের দাতা পাওয়া যায়। একটি হচ্ছে, আগে থেকে দান করে যাওয়া 'ক্লিনিক্যালি ডেড' ব্যক্তির কিডনি এবং স্বেচ্ছায় দান করা জীবিত ব্যক্তির কিডনি। বাংলাদেশে প্রথমটির প্রচলন এখনো হয়নি। ১৯৯৯ সালের কিডনি প্রতিস্থাপন আইন অনুযায়ী কেবল নিকটাত্মীয়রাই কিডনি দান করতে পারেন। কেনাবেচার তো প্রশ্নই নেই। তার পরও এই ব্যবসা কিভাবে চলছে, তা আমাদের বোধগম্য নয়। চিকিৎসকদের মতে, সম্পূর্ণ সুস্থ একজন মানুষের একটি কিডনি বা লিভারের অংশবিশেষ দান করলে এবং পরবর্তীকালে নিয়ম-কানুন মেনে চললে তেমন সমস্যা হয় না। কিন্তু কিডনি ব্যবসার নামে যেভাবে কিডনি নেওয়া হচ্ছে, তা এক ধরনের হত্যারই শামিল। কারণ গ্রামের সেই দরিদ্র মানুষটির পক্ষে কিডনি দানপরবর্তী নিয়ম-কানুন মেনে চলা কিংবা কোনো জটিলতা দেখা দিলে যথাযথ চিকিৎসা পাওয়া একেবারেই অনিশ্চিত। কাজেই মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেনাবেচার এই অমানবিক ও নিষ্ঠুরতম প্রক্রিয়া কঠোরভাবে দমন করতে হবে। এর সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.