নির্মাতা ও মানুষ by মিলন কান্তি দে

ভাবতে কষ্ট হয়, কী দুর্ভাগা আমরা! জাতীয় শোকের মাস আগস্টেই একে একে হারালাম সৃজনশীল প্রতিভাসম্পন্ন কিছু উজ্জ্বল মানুষকে, যারা দেশ ও মাটিকে সমৃদ্ধ করেছেন, এই ভূখণ্ডকে আন্তর্জাতিক বলয়ে উদ্ভাসিত করেছেন শৈল্পিক চিন্তা-চেতনায়।
তারেক মাসুদ, মিশুক মুনীর, ড. মৃদুল কান্তি চক্রবর্তী এবং সর্বশেষ আখতারুজ্জামান_ এই অমূল্য প্রাণগুলো যেভাবে দপ করে নিভে গেল, তা যেন অনেকটা মেঘনাদ বধ মহাকাব্যের প্রথম স্বর্গের ওই পঙ্ক্তিটির মতোই 'একে একে নিবিছে দেউটি'। আখতারুজ্জামান আমাদের সবার প্রিয় আখতার ভাই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন, জীবনের এ চরম সত্যটি মেনে নিতেও মনপ্রাণ হাহাকার করে ওঠে। কারণ আখতারুজ্জামানের মতো কীর্তিধন্য মানুষ ছিলেন ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থের ঊধর্ে্ব। আমৃত্যু উল্কার বেগে ছুটে বেড়িয়েছেন কঠোর শিল্প সাধনার চারণভূমিতে। তাই অমোঘ মৃত্যু তাদের ছিনিয়ে নিলেও মহাকালের পাতায়, সংখ্যাতীত মানুষের হৃদয়ে তারা চিরঞ্জীব, অবিনশ্বর। ওবায়দুল হক, ফজলুল হক, এসএম পারভেজ, আজিজ মিসির প্রমুখ বরেণ্য ব্যক্তির নিরলস প্রচেষ্টায় এ দেশে চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার একটি ধারা গড়ে ওঠে। স্বাধীনতার পর সত্তর দশকে এ ধারাটি আরও বেগবান, আরও সমকালীন হয়ে ওঠে গোলাম সারওয়ার (এখন সমকাল সম্পাদক) এবং আহমদ জামান চৌধুরীর (খোকাভাই) মতো সৃষ্টিশীল ও দক্ষ চিত্রসাংবাদিকের নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষায়। প্রয়াত আখতারুজ্জামান ছিলেন এই ঘরানারই একজন। তারেক মাসুদের মতো তিনিও ছিলেন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত আরেক হতভাগ্য চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব আলমগীর কবীরের প্রিয় ছাত্র। আখতার অবশ্য চিত্রসাংবাদিক হিসেবে তার ক্যারিয়ার শুরু করেন ১৯৬৬ সালে, সাপ্তাহিক চিত্রাকাশের মাধ্যমে। ১৯৭৩ থেকে '৮৬ সাল পর্যন্ত তার কর্মস্থল ছিল সাপ্তাহিক চিত্রালী। চলচ্চিত্র সংক্রান্ত সংবাদ পরিবেশনে তিনি নানা মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন এবং মুক্তিপ্রাপ্ত নতুন ছবির পর্যালোচনা ও সমালোচনা লিখতে গিয়ে এমন কিছু সিনেমাটিক শব্দ প্রয়োগ করতেন, যার ফলে রচনাটি অনেকের মধ্যে চিন্তার খোরাক জোগাত। তিনি রিপোর্ট লিখতেন সাপ্তাহিক কাগজের গতানুগতিকতার আদলে নয়, রীতিমতো জাতীয় দৈনিকের আঙ্গিকে। চিত্রালীতে থাকাকালেই চিত্রসাংবাদিক হিসেবে চলচ্চিত্র অঙ্গনে তিনি বিপুল খ্যাতির অধিকারী হন। এরপর তিনি দৈনিক বাংলার বাণী এবং নির্বাহী সম্পাদক হয়ে যোগ দেন সাপ্তাহিক সিনেমায়। তিনি দৈনিক যুগান্তর, পিপল, নেশন এবং দৈনিক সংবাদেও কাজ করেন। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতির। একজন সফল চিত্রসাংবাদিক থেকে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রকার তার এ সাফল্যের মূলে ছিল কঠোর শ্রম, অধ্যয়ন, অনুশীলন এবং ব্যতিক্রমী কিছু করার একাগ্রতা। এতসব গুণ ছিল বলেই বিশাল চলচ্চিত্র মোগল সাম্রাজ্যে তিনি স্বকীয়তা নিয়ে বিচরণ করতে পেরেছিলেন। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির রাঘববোয়ালদের মতো তার বিত্তবৈভব-জৌলুস কোনোটিই ছিল না। ছবি বানাতে গিয়ে অর্থ সংকটের মধ্যে পড়েও অসাধু প্রযোজকের কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। সেলিনা হোসেনের উপন্যাস নিয়ে তিনি 'পোকা-মাকড়ের ঘর বসতি' ছবি তৈরি করেন। ছবিটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পায়। তিনি পান শ্রেষ্ঠ পরিচালকের স্বীকৃতি। কিন্তু ভালো প্রযোজকের অভাবে ওই ছবির কাজ অনেক দিন বন্ধ ছিল। আখতার ভাইয়ের সঙ্গে যারা কাজ করেছেন এবং তাকে যারা এক-আধটু চেনেন, জানেন_ সবাই একবাক্যে স্বীকার করবেন, এমন কিছু গুণাগুণে উজ্জ্বল ছিল তার ব্যক্তি চরিত্র, যা সহজেই সবাইকে মুগ্ধ করার মতো। যেমন তিনি ছিলেন সলজ্জ স্বভাবের, অত্যন্ত বিনয়ী, বিনম্র, মৃদুভাষী এবং সবসময় ঠোঁটে লেগে থাকত মৃদু হাসি। তিনি ছিলেন অজাত শত্রু। তার সঙ্গে কারও কলহ-বিবাদ হয়েছে এবং তিনি কাউকে কখনও রূঢ় কথা বলেছেন_ এমনটি শোনা যায়নি কখনও। সংস্কৃতি বিষয়ক এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, 'বড় শিল্পী অনেক আছেন; কিন্তু বড় মানুষের বড় অভাব। আর মহৎ শিল্পী হতে হলে অন্তরকেও বড় করতে হয়।'
আপাদমস্তক চলচ্চিত্রের মানুষ হলেও আখতার ভাই ছিলেন অসম্ভব যাত্রানুরাগী। ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পের ব্যাপক প্রচারণা প্রয়োজন, এটি তিনি গুরুত্বের সঙ্গে উপলব্ধি করতেন। এ দেশে যাত্রার ওপর পৃথক বিভাগ চালু করে প্রথমে সাপ্তাহিক চিত্রালী, পরে পূর্বাণী। চিত্রালীর পর তিনি যেসব পত্রিকায় কাজ করেছেন, প্রত্যেকটিতে গুরুত্বের সঙ্গে যাত্রার লেখা ছাপিয়েছেন। ১৯৯৭ সালে মুম্বাই থেকে পরিচালক অনুপ সিংহ এসেছিলেন ঢাকায়। উদ্দেশ্য ঋতি্বক ঘটকের ওপর প্রামাণ্য চলচ্চিত্র তৈরি করা। এ ইউনিটের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আখতারুজ্জামান। তিনি ওই ছবিতে যাত্রাপালার একটি দৃশ্য সংযোজন করেছিলেন। যাত্রাওয়ালাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা নিয়ে কয়েকটি টিভি নাটক আমরা দেখেছি; কিন্তু চলচ্চিত্রের মাধ্যমে এ ধারাটি প্রথম শুরু করেন তিনি। সেই ছবিটির নাম 'প্রিন্সেস টিনা খান'। তাকে নিয়ে আরও কত ঘটনা, কত স্মৃতি। আমরা হারালাম একজন স্রষ্টাকে, একজন বড় মনের মানুষকে। তাকে জানাই সশ্রদ্ধ প্রণতি।

মিলন কান্তি দে : যাত্রাব্যক্তিত্ব
 

No comments

Powered by Blogger.