শেকড়ের ডাক-নদীর দুর্গতি, তিস্তার পানিবণ্টন ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ by ফরহাদ মাহমুদ

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে ভারত সফর করেছিলেন। তার পর থেকেই বাংলাদেশের মানুষ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের অপেক্ষা করছিল। একই সঙ্গে মানুষ আশা করে আসছিল, এই সফরে তিস্তার পানিবণ্টনসহ দুই দেশের মধ্যে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতা ও চুক্তি হবে। ৬ সেপ্টেম্বর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী সেই বহু কাঙ্ক্ষিত সফরে ঢাকায় এসেছিলেন।


তাঁর সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী পাঁচটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদেরও আসার কথা ছিল। চারটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা এলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আসেননি। না আসার কারণ, শেষ মুহূর্তে তিনি তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিতে আপত্তি জানিয়েছেন। দুই দেশের শীর্ষ পর্যায়ে দীর্ঘ আলোচনার পর এই চুক্তিটির খসড়া তৈরি করা হয়েছিল। শেষ মুহূর্তে এভাবে চুক্তিটি সই না হওয়া অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীও তা স্বীকার করেছেন। ভারতকে ট্রানজিট দেওয়ার ব্যাপারেও কোনো চুক্তি সই হয়নি। কিন্তু সত্য হলো, ট্রানজিট দেওয়া বা না দেওয়ার কারণে বাংলাদেশের অস্তিত্বের সংকট দেখা দেবে না, কিন্তু তিস্তার পানিপ্রবাহের ওপর বাংলাদেশের অস্তিত্ব অনেক বেশি নির্ভরশীল।
বাংলাদেশ নামের বদ্বীপ অঞ্চলটি মূলত নদীবাহিত পলির মাধ্যমে গঠিত। সেই অর্থে বাংলাদেশ নদীরই দান। মানবদেহের শিরা-উপশিরার মতোই এর সারা দেহেও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে প্রচুর নদী ও শাখা নদী। এগুলোই দেশটিকে জীবন দিয়েছে, বাঁচিয়ে রেখেছে। এর সবুজ-শ্যামল শস্যের মাঠ, তরুপল্লবে ঘেরা গ্রামীণ জনপদ_সবই সম্ভব হয়েছে এসব নদীর কারণে। এসব নদীর ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে এর প্রাকৃতিক ভারসাম্য, এর উদ্ভিদ ও প্রাণিজগৎ। এই ভারসাম্য বিঘি্নত হলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে_এটাই সত্য এবং বর্তমানে হচ্ছেও তাই। দেশের উত্তরাঞ্চলে মরুকরণ-প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। পানির স্তর ক্রমেই নিচে নামছে। অনেক এলাকায় শুষ্ক মৌসুমে গভীর নলকূপেও পানি ওঠে না। নদীগুলোতে প্রবাহ না থাকায় সাগরের নোনা জল ক্রমেই বেশি করে দেশটির অভ্যন্তরে ঢুকছে। ফলে চাষাবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং উপকূলীয় জনজীবন ক্রমেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। জলবায়ু উদ্বাস্তুর সংখ্যা দিন দিনই বাড়ছে। অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্যের দাবিদার সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মাইকেল মধুসূদন দত্তের প্রিয় নদ কপোতাক্ষ এখন মৃতপ্রায়। আর সে কারণে সাতক্ষীরা ও খুলনা জেলায় ১০ লাখেরও বেশি মানুষ এখনো জলাবদ্ধতায় দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে। সেখানে মাসাধিককাল ধরেই চলছে এ অবস্থা। নদীগুলোতে প্রবাহ না থাকায় বেশি করে পলি জমছে এবং ভরাট হচ্ছে। ফলে বর্ষায় উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানি নদীগুলো ধারণ করতে পারে না, তাই প্লাবিত হয় বিস্তীর্ণ অঞ্চল। এ বছরও আমনের বীজতলার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
শুধু যে প্রাকৃতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা-ই নয়, এই ভূখণ্ডে সভ্যতারও বিকাশ ঘটেছে নদীকে কেন্দ্র করেই। আমরা যে অভিন্ন ঐতিহ্যের দাবি করি, তা-ও গড়ে উঠেছে এসব নদীকে ভিত্তি করে। আমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতির বিরাট অংশ দখল করে আছে এসব নদী। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলাইদহ, শাহজাদপুর, পতিসরে ঘুরে বেড়াতেন যে বোটে করে, সে বোট এখন আর এসব নদীতে চলতে পারবে না। পদ্মায় আর স্টিমার চলে না। ভাটিয়ালি গানের সেই চিলমারী বন্দর এখন মৃত। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ঋতি্বক ঘটকের নির্মিত চলচ্চিত্র 'তিতাস একটি নদীর নাম'-এর সঙ্গে আজকের বাস্তবের তিতাস নদীর কোনো মিল নেই। জীবনানন্দের রূপসী বাংলার চেহারাটা আজ বড় বেশি ম্লান হয়ে গেছে। 'কে যায় রে ভাটির গান গাইয়া'_শচীন দেব বর্মণের কণ্ঠে শোনা সে গানের আবেদনও ক্রমে হারিয়ে ফেলছে বাংলাদেশ। কারণ একটাই, আমাদের নদীগুলো মরে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে আমাদের বহু নদী মরে গেছে। বাকিগুলোও মরি মরি করছে। কিন্তু আমাদের নদীগুলোর এ অবস্থা কেন? এর প্রধান কারণ, উজানে থাকা ভারতীয় অংশে বহুসংখ্যক ড্যাম ও ব্যারাজ তৈরি করে শুষ্ক মৌসুমে নদীগুলোর পানি প্রত্যাহার করে নেওয়া। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, অত্যন্ত ব্যয়বহুল বলে দীর্ঘদিন ধরে নদী খননের কাজটি না করা। অথচ ব্রিটিশ-ভারতেও নিয়মিত নদী খননের জন্য একটি বিশাল ড্রেজার-বহর ছিল, এখন আমাদের কাছে ড্রেজার নেই বললেই চলে। বঙ্গবন্ধুর সরকার যে চারটি ড্রেজার কিনেছিল, সেগুলোর কার্যকর জীবনকাল অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে জরুরি প্রয়োজনে এগুলো কোনো রকমে জোড়াতালি দিয়ে চালানো হচ্ছে। নিয়মিত নদী খননে এগুলো বড় কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে বলে মনে হয় না। শেখ হাসিনার বর্তমান সরকার কয়েকটি ড্রেজার কেনার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করলেও সেগুলো এখনো আমাদের হাতে এসে পেঁৗছায়নি। এর মধ্যখানে আর কোনো সরকারই ড্রেজার কেনার উদ্যোগ নেয়নি। এ ছাড়া অদূরদর্শী উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কারণেও অনেক নদী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে। এগুলোর উৎস ভারতে বা তৃতীয় কোনো দেশে। অভিন্ন নদীগুলোর উৎসে বা উজানে পানি প্রত্যাহার করে নিলে ভাটিতে থাকা বাংলাদেশ বঞ্চিত হয়। আর তার প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের প্রকৃতি, অর্থনীতি ও সরাসরি মানুষের জীবনযাত্রার ওপর। আমরা এখনো স্পষ্ট করে জানি না, কোন কোন বিবেচনা থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিতে অসম্মতি জানিয়েছেন। এটা খুবই স্বাভাবিক যে তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে অবশ্যই সেখানকার মানুষের স্বার্থ আগে দেখবেন। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে ভাটিতে থাকা বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের তিনি ক্ষতি করবেন। তাদের তিলে তিলে মেরে ফেলার দিকে এগিয়ে দেবেন। আমরা যখন দুটি প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সুসম্পর্কের কথা বলি, সৎ প্রতিবেশীসুলভ আচরণের কথা বলি, তখন তার মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহযোগিতা, সহমর্মিতা, মানবিক বিবেচনা, আন্তর্জাতিক রীতিনীতির প্রসঙ্গ স্বাভাবিকভাবেই এসে যায়। তিস্তা চুক্তি না হওয়াকে এর কোনোটার সঙ্গেই আমরা মেলাতে পারছি না। সে ক্ষেত্রে সৎ প্রতিবেশীসুলভ আচরণই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। ভারতের কাছ থেকে এই আচরণ আমাদের প্রত্যাশিত নয়। আমরা চাই, প্রতিবেশী হিসেবে দুটি দেশ আজকের সব দুর্বলতা কাটিয়ে সত্যিকার অর্থেই দুটি বন্ধুরাষ্ট্রে পরিণত হোক। পরস্পরের সুখ-দুঃখ বিবেচনায় নিয়েই শুরু হোক নতুন করে পথ চলা।
সব শেষে আবারও বলছি, নদী না বাঁচলে এই দেশও বাঁচবে না। আমরা আশা করি, ভাটিতে থাকা বাংলাদেশের স্বার্থে ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলো সুবিবেচনার পরিচয় দেবে। কেবল প্রবাহ বাধাগ্রস্ত না করেই নয়, নদী খননেও তারা সহযোগিতার হাত বাড়াতে পারে। কিছু পরিমাণে এটি করা তাদের দায়িত্বের মধ্যেও পড়ে। ইতিমধ্যে সীমিত পরিসরে হলেও তারা সে ইচ্ছা প্রদর্শনও করেছে। কিন্তু কেবল ভারতের চুক্তি আর সহযোগিতার দিকে তাকিয়ে বসে থাকলে আমাদের চলবে না, পাশাপাশি আমাদের নদী রক্ষা এবং কৃত্রিম জলাধার তৈরি করে আপৎকালীন পানিসম্পদের চাহিদা মেটানোর প্রয়োজনীয় উদ্যোগও নিতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.