ঢাকার বিভক্তি-ইতিহাস-পরিপন্থী এবং একটি জাতীয় ট্র্যাজেডি by সিরাজুল ইসলাম

ঢাকা মহানগর ব্যবস্থাপনা আরও উন্নত হোক, আরও গতিশীল হোক—এ কামনা শুধু ঢাকাবাসীরই নয়, এ কামনা সমগ্র জাতির। ঢাকা জাতির প্রাণকেন্দ্র। বিগত কয়েক দশকের প্রশাসনিক অদক্ষতা ও দুর্নীতির কারণে এখন ঢাকা মানে একটি স্থবিরতা, একটি অব্যবস্থা, একটি যন্ত্রণা।
এ নিয়ে গণপ্রতিনিধিত্বকারী সরকার ভাববে, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে, এটা জনগণের স্বাভাবিক প্রত্যাশা। জনগণের প্রত্যাশা অনুসারে কাজ না করলে সরকারকে বিদায় নিতে হবে, এটা গণতান্ত্রিক বিধান। আপনি ব্যর্থ অথচ ক্ষমতার লাগাম ধরে থাকবেন, এটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় চলে না।
অতএব, ঢাকা নগরের দুঃসহ যন্ত্রণা থেকে নগরবাসীকে তথা দেশকে উদ্ধার করার জন্য প্রধানমন্ত্রী যে সক্রিয় চিন্তাভাবনা করছেন তাতে আমরা প্রীত। কিন্তু ঢাকার সমস্যা সমাধানের উপায় হিসেবে তিনি ইতিমধ্যেই যে ব্যবস্থা নিয়েছেন, অর্থাৎ ঢাকার প্রশাসনকে দ্বিখণ্ডিত করার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে তা চার মিনিটের মধ্যে সংসদ থেকে পাস করিয়ে নিয়ে আইনে পরিণত করে নিয়েছেন, তাতে মনে হচ্ছে যে তিনি এ বিভাজনের উপকারিতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিশ্চিত, এমন নিশ্চিত যে হাতে টাকা থাকলে তিনি ঢাকাকে দুই কেন, চার ভাগ করতেন। ভাগ-বিয়োগে এত উপহার পাওয়া গেলে শুধু চার ভাগ কেন, শত ভাগ করায় বাধা কোথায়?
আমাদের দেশের রাজনীতিতে ভাগ-বিয়োগের একটি ঐতিহ্য আছে। একটি বৃহৎ সমস্যাকে সামলাতে গিয়ে প্রয়োজনে ভাগ-বাটোয়ারার আশ্রয় নেওয়া হয়। বখরদারি ভাগের কথা বলছি না, বলছি জায়গাজমি ভাগের কথা। বিশ শতকের গোড়ায় উপদেষ্টাদের পাল্লায় পড়ে বাংলা ভাগ করা হলো জনগণের ‘উপকারের’ জন্য। নেতারা সব সময়ই জনগণের উপকারের জন্য নিবেদিত। বঙ্গবিভাগ সৃষ্ট সমস্যার মুখে বঙ্গ-ভাগ রহিত হলো। বিশ শতকের মাঝামাঝি আবার ভাগের জিকির উঠল। বাংলা ভাগ হলো কিন্তু ভাগের কল্পিত সুখ এল না, এল নতুন জাতের ঔপনিবেশিক শাসন। ‘এক সাগর রক্ত’ দিয়ে নির্মিত হলো বাংলাদেশ। একে আর ভাগ করার উপায় নেই বিধায় শুরু হলো অভ্যন্তরীণ ভাগের পালা। শত বছরের জেলা ভাঙা হলো, মহকুমা ভাঙা হলো, ভাঙা হলো থানা পর্যন্ত। বিলুপ্ত করে মহকুমাকে করা হলো জেলা, আর জেলাকে উপজেলা। কিন্তু সুখ আর আসেনি। গ্রামে উপজেলাকে অনেকে ব্যঙ্গ করে বলে ‘উপজ্বালা’।
অনেক দিন পর ঢাকাকে দিয়ে শুরু হলো করপোরেশন ভাঙার পালা। এতে ঈপ্সিত ফল পেলে অন্যান্য বড় শহরও ভাঙা হতে পারে। ছোট দেশের বড় শহর থাকাটা বেমানানই বটে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে সব ভাগ-বিভাগের নেপথ্যে থাকে কিছু অঘোষিত বিলিবণ্টন, ফন্দি-ফিকির চিন্তা। বিলিবণ্টন প্রক্রিয়া শেষ হয়ে গেলে শুরু হয় নতুন ফন্দি-ফিকির, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, অত্যাচার। এসব বিষয়ে প্রাচীন ধর্মগ্রন্থে বেশ ভালো উপমা আছে। হিব্রু কিতাবে আছে, রাজা একজন অন্যের ধনের লোপাটকারী। কারণ সরকার উৎপাদন করে না। রাজা মানেই একজন শোষক। বখরা না পেলে সে অত্যাচারের আশ্রয় নেয়, যে জন্য হজরত মুসাকে তাঁর সাগরেদসমেত ফেরাও রাজ্য ছেড়ে পালাতে হয়েছিল। এ পরিস্থিতিতে হিব্রুদের ভগবান আদেশ দিলেন, তারা যেন কখনো রাজ্য নির্মাণ না করে। তারা যেন রাষ্ট্রের বদলে স্বাধীন গ্রামীণ সমাজ প্রতিষ্ঠা করে। এর পরও ইহুদিরা যখন রাজ্য স্থাপনের উদ্যোগ নিল, তাদের ঈশ্বর এ উদ্যোগের বিরোধিতা করেন। ঈশ্বর নির্দেশ দেন, ‘জেনে রেখো বাপুরা, রাজার কোনো নিজস্ব উৎপাদন নেই। তার মতলব হলো নানা কলাকৌশলে প্রজাদের উদ্বৃত্ত উৎপাদন হরণ করা। তোমরা যদি রাজ্য গঠন করার পরিণতিতে রাজার অত্যাচারের শিকার হও, আমি তখন তোমাদের ডাকে সাড়া দেব না’ (১ স্যামুয়েল ৮: ১৭)।
রাষ্ট্র যতই খারাপ হোক, এখন রাজ্যহীন মানুষ হিসেবে থাকা যে আরও খারাপ! অতএব ‘খানা খেতে হবে একসঙ্গে’। ঢাকা বিভাগের মজার দিক হলো, দুই মাস আগেও ঢাকাকে দ্বিখণ্ডিত করার প্রয়োজন নিয়ে কোনো রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, নগরবিদ, শহরবাসী কোনো ইস্যু তৈরি করেননি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজেও না। এরই মধ্যে কী এমন ঘটে গেল যে তিনি ঢাকাকে ভাগ করার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন এবং ৪০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী ঢাকাকে তিনি চার মিনিটের মধ্যে দ্বিখণ্ডিত করে ছাড়লেন? এ হেন সিদ্ধান্ত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রজ্ঞা প্রমাণ করে না, প্রমাণ করে তাঁর ক্ষমতার অসীমতা। তিনি যা চান তাই করতে পারেন। তাহলে আমাদের এমন দুরবস্থা কেন? রাজার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে হিব্রুরা দেশ ছেড়ে বিদেশ-বিভুঁইয়ে জীবন কাটাল, মুসা নবী সব অনুসারীকে নিয় নিরাপদে চলে গেলেন। কিন্তু আমরা যাব কোথায়?
ঢাকা মহানগর ভাগের যৌক্তিকতা তুলে ধরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সংসদে আমাদের জ্ঞান দিলেন যে, প্রয়োজনে এমনতর ভাগ-বিভাগের ঘটন পৃথিবীর অনেক শহরের বেলায়ই ঘটেছে। তাঁর মতে, এমন ঘটনা ঘটেছে অনেক অতিকায় শহরে, যেমন লন্ডন, ম্যানিলা, সিডনি, মেলবোর্ন ইত্যাদি। আমার নিবেদন, আপনি ব্যাপারটি খতিয়ে দেখুন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এ তথ্য সত্যি না মিথ্যা। আপনার উল্লিখিত প্রতিটি শহরের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট রয়েছে। দেখুন, আপনার দাবি সত্যি কি না। দেখুন, আপনার উল্লিখিত প্রতিটি শহরের জন্য নির্বাচিত মেয়র ও কাউন্সিল রয়েছে কি না। আমি নিজে ওয়েবসাইট দেখেছি। ওসব শহরে এমন ঘটনা কোথাও ঘটেনি। শুধু লন্ডনের বেলায় আপনার কথা শতকরা এক ভাগ সত্য। লন্ডন নগরের জন্য দুজন মেয়র আছেন। একজন গ্রেটার লন্ডনের মেয়র, আরেকজন লন্ডনের মেয়র, যার উপাধি ‘লর্ড মেয়র অব লন্ডন’। আসলে তিনি মাত্র এক বর্গমাইলব্যাপী প্রাচীন ওয়েস্টমিনস্টার বারা-এর আলংকরিক কর্তা। পদটি ঐতিহাসিক। তাই রেখে দেওয়া হয়েছে। এখানে অবস্থিত রাজপরিবার ও পার্লামেন্ট স্থাপনাসহ সরকারের সব বড় প্রতিষ্ঠান। ওয়েস্টমিনস্টার শহরের বয়স সাড়ে ৩০০ বছর। সারা লন্ডন অর্থাৎ গ্রেটার লন্ডনের জন্য রয়েছেন জনপ্রতিনিধিত্বশীল নির্বাচিত মেয়র ও কাউন্সিল। পরিতাপের বিষয়, ব্রিটিশ সরকার যেখানে সাড়ে ৩০০ বছরের ঐতিহ্য রক্ষার জন্য এক বর্গমাইলব্যাপী ওয়েস্টমিনস্টার সিটিকে একটি জাদুঘরের মতো সংরক্ষণ করছে, সেখানে বাংলাদেশ সরকার ৪০০ বছরের ঢাকাকে চার মিনিটের মধ্যে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলেছে। এ ব্যাপারে সদস্যদের ‘বলার কিছু ছিল না’। হায় গণতন্ত্র!
ঢাকাকে ভাগ করার চিন্তা কোনো ক্ষমতাধরের মাথায় আসতেই পারে। কিন্তু চিন্তাটি কতটুকু গ্রহণযোগ্য, এর ওপর জনমত সংগ্রহ করা কি সরকারের গণতান্ত্রিক দায়িত্ব ছিল না? জনমত একটি নির্দমনীয় শক্তি। এ শক্তির কাছে রাজন্য শক্তি নস্যি। বাংলাদেশ তো জনমতেরই ফল। জনমত যে সব সময়ই জয়ী হয় এ মর্মে দু-একটি ঐতিহাসিক উপমা দেওয়া যাক। ঢাকা একটি প্রাচীন জনপদ। মোগলরা এ দেশ দখল করে ঢাকার নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম রাখে জাহাঙ্গীরনগর। তখন মোগল বাদশা ছিলেন জাহাঙ্গীর। জাহাঙ্গীর হয়তো খুশি হয়েছিলেন ঢাকার নাম বদলানোর জন্য, কিন্তু জনগণ হয়নি। জনগণের মন থেকে ঢাকাকে মুছে ফেলা যায়নি কখনো। তারা ঢাকাকে ঢাকাই বলেছে বরাবর, জাহাঙ্গীরনগর বলেনি। যদিও সরকারি সকল নথিপত্রে জাহাঙ্গীরনগর ছিল সরকারি নাম। এমনিতর, চট্টগ্রামের নাম রাখা হয়েছিল ইসলামাবাদ, বরিশালের নাম দেওয়া হলো বুজুর্গওয়েমদপুর, শ্রীহট্টের নাম জালালাবাদ, ইত্যাদি। কিন্তু এসব নাম সমকালীন লোকেরা বর্জন করেছে। মানুষ ঐতিহ্য ভালোবাসে প্রায় অসচেতনভাবেই। ঐতিহ্য ভাঙা সুকঠিন ব্যাপার। মানুষ একক ঢাকাকে দেখতে অভ্যস্ত।
সার্ভিসের দিক থেকে ঢাকাকে কার্যত দ্বিখণ্ডিত করা অসম্ভব কয়েকটি কারণে। যেকোনো মেট্রোপলিটন শহরের কয়েকটি অপরিহার্য সার্ভিস আছে, যা ভাগ করা দুরূহ বা অসম্ভব। যেমন যাতায়াত ব্যবস্থা। ১ নম্বর ঢাকার সড়ক ২ নম্বরে গিয়ে কি থেমে যাবে নাকি চলমান থাকবে? যদি চলমান থাকে তবে এর পরিকল্পনা ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ কীভাবে করবেন? আরও নাজুক পরিস্থিতি অ্যাম্বুলেন্স ও ফায়ার সার্ভিসের জন্য। একই কথা প্রযোজ্য মেট্রোপলিটন পুলিশ সার্ভিসের বেলায়। আরও নাজুক পরিস্থিতি শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে। বিভিন্ন ধরনের ইমারজেন্সি মোকাবিলার জন্য উভয় ভাগের পিতারা মিলিত হবেন আশা করি। কে নেতৃত্ব দেবেন এর? সমস্যাটি প্রকট হবে, যদি দুই ভাগের পিতারা দুই দলের হন। এখন ক্রমশই পাবলিক-প্রাইভেট সেক্টর মিলিত হচ্ছে নানা প্রকল্প নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনায়। শহর দুই ভাগ হলে এদের সমন্বয় কীভাবে হবে? আমার বক্তব্য শেষ করতে চাই একটি লোকপ্রবাদ দিয়ে, ‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না।’
সিরাজুল ইসলাম: ইতিহাসবিদ।

No comments

Powered by Blogger.