খোলা হাওয়া-হরতাল তো হলো, বিভক্ত ঢাকা কি জোড়া লাগল? by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

বিএনপি যখন হরতালের পরিবর্তে রোডমার্চ কর্মসূচি দিল, আমরা তাকে সাধুবাদ জানিয়েছিলাম। রোডমার্চ শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি; এতে শুধু যেসব রাস্তা দিয়ে গাড়িবহর যায়, সেসব জায়গায় পথসভা-জনসভা হয়, সেসব রাস্তা আর জনপদ-শহর ছাড়া অন্যত্র জনজীবনের ওপর এর কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়ে না। রাজশাহীর দিকে রোডমার্চ গেলে ঢাকার সিএনজিচালককে একদিনের হারানো আয়ের জন্য হাপিত্যেশ করতে হয় না।


দৈনিক ভিত্তিতে খেটে খাওয়া মানুষকে কপাল চাপড়াতে হয় না; বরং রোডমার্চে যেসব পথসভা হয়, তাতে আইসক্রিম, চানাচুর, বোতলের পানি বিক্রি করে অনেকে দুই পয়সা আয় করেন। একটা উৎসব-উৎসব আবহে দলীয় সমর্থকেরা এক দিন-আধা দিন পার করতে পারেন। আমরা দেখেছি, রোডমার্চ কর্মসূচি বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীকে উজ্জীবিত করেছে, দলটি সাংগঠনিকভাবে শক্তি সঞ্চয় করেছে। এ রকম চনমনে ভাব সারা দেশের নেতাকর্মীদের মধ্যে জাগিয়ে দিতে পারলে আগামী নির্বাচনে দলটি জয় পেতে পারে।
আমাদের ধারণা ছিল দলটি রোডমার্চের কার্যকারিতা বুঝতে পেরে নতুন হিসাব-নিকাশ করবে। হয়তো সারা দেশে এর ব্যাপ্তি বাড়াবে এবং হরতালের মতো বিধ্বংসী কর্মসূচি থেকে দলটি ফিরে আসবে। গত কুড়ি বছর থেকে লাভ-ক্ষতির বিচারে হরতালের কোনো পরীক্ষিত ইতিবাচক ফল আমরা দেখিনি। হরতাল হলে শুধু শুধু জনগণের দুর্গতি বাড়ে, গরিব মানুষ অর্থকষ্টে পড়ে। তেমন কোনো নজির গত কুড়ি বছরে আমরা পাইনি, যেখানে হরতালের কারণে সরকার কোনো সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে। বিএনপি দুই দফা ক্ষমতায় ছিল; বিএনপির সময় আওয়ামী লীগ লাগাতার হরতালও দিয়েছে। কিন্তু বিএনপি কি আওয়ামী হরতালের ফলে কোনো ছাড় দিয়েছে? কখনো? আওয়ামী লীগ সরকারের গত মেয়াদে বিএনপি অনেক হরতাল করেছে। ফল কী হয়েছে? সব হরতাল শেষে সব বিরোধী দল দাবি করে, ‘জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন করে সরকারের প্রতি অনাস্থা জানিয়েছে’ এবং সরকারি দল বলে, ‘জনগণ হরতাল প্রত্যাখ্যান করেছে।’ এই পালন ও প্রত্যাখ্যানের বিপরীত দাবি এবং এর পৌনঃপুনিকতাই প্রমাণ করে ভয়ভীতি দেখানো ছাড়া হরতালের কোনো কার্যকারিতা নেই। এটি একটি ভোঁতা অস্ত্র, যা দিয়ে বড় একটা ঘা লাগানো গেলেও কাটার মতো ধার এর নেই এবং এই ঘা-টা পড়ে সরকার বা সরকারি দল নয়, জনগণের ওপরই। বিশেষ করে যারা দিন আনে দিন খায় তাদের ওপর। হরতাল তাই গরিব মানুষ, ক্ষুদে ব্যবসায়ী (এবং বড় ব্যবসায়ীও) এবং খেটে খাওয়া লোকজন পছন্দ করে না। হরতাল পছন্দ করে মাইনেতে চাকরি করা মধ্যবিত্ত, যারা একদিন কাজে ফাঁকি দিতে পারলে বিমলানন্দ পায়।
হরতালের অপকারিতা নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে। এ নিয়ে নতুন আর বলার কিছু নেই। আমরা শুধু ভাবি, একটি উন্নয়নকামী দেশ, যার চলার পথে এত প্রতিবন্ধকতা, তাকে কত ইস্যুতে যে হরতাল মোকাবিলা করতে হয়! এই দেশটার সরকারে যখন যে দল থাকে, তখনই শুধু তা বোঝে হরতাল অর্থনীতির কতটা ক্ষতি করে; দেশটার শিক্ষা, যোগাযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব ক্ষেত্রে কতটা নৈরাজ্য সৃষ্টি করে। একটা দিন দেশের সব স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ—এটি আপাতদৃষ্টিতে বিরাট কিছু না হলেও শেষ বিচারে বিরাট কিছুই বটে। একটা গোটা দিন অকারণে জাতির শিক্ষাজীবন থেকে হারিয়ে যায়। তবে এসব হিসাব-নিকাশের বাইরেও মূল কথাটি হলো, বাংলাদেশ কি চিরদিন সব রকমের বাতিল পন্থা আর আত্মঘাতী রাজনৈতিক কর্মসূচির জালে জড়িয়ে থাকবে? দেশটা কি সামনে এগোবে না? ‘হরতাল সাংবিধানিক অধিকার’—এ রকম অজুহাত দেখান হরতালের সমর্থকেরা। এরশাদের পতন হয়েছিল হরতালের আঘাতে, কাজেই হরতাল এখনো ভালো অস্ত্র—এ রকম যুক্তিও তাঁরা তুলে ধরেন। তবে সংবিধান ঘেঁটেও এর ‘অধিকার’ অংশে ‘জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার’ অধিকার ছাড়া হরতালের অধিকার সম্পর্কে কোনো ধারা-উপধারা আমাদের চোখে পড়েনি। আমাদের ভুল হয়ে থাকলে সংবিধান বিশেষজ্ঞরা মার্জনা করবেন। তার পরও তর্কের খাতিরে হরতালকে একটি অধিকার ধরে নিলেও এই অধিকার যদি একজনের আয়-উপার্জনের অধিকার ক্ষুণ্ন করে, তাহলে তা কতটা অধিকার আর কতটা অনধিকার হয়ে দাঁড়ায়, বিশেষজ্ঞদের কাছে এই প্রশ্নের একটি উত্তর আমরা আশা করি। হরতালপন্থী বিশেষজ্ঞরা হয়তো বলবেন, এ ছাড়া বিরোধী দলের হাতে কোনো বিকল্প নেই। একটা দেশে দেড় দশকের স্বৈরশাসনের পর দুই দশক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চলছে, অথচ সংসদের ভেতরে প্রতিবাদ জানানো ও প্রতিকার আদায়ের চর্চাকে এখনো আমরা প্রতিষ্ঠা না করে বিকল্প করেছি হরতালকে! সংসদে সব সমস্যা নিষ্পত্তির ধারাটি সৃষ্টি না করে রাজপথে হরতালে নিষ্পত্তি খোঁজার ঐতিহ্য আমরা চালিয়েই যাচ্ছি। হরতালপন্থীরা হয়তো বলবেন, সংসদে কথা বলতে দেওয়া হয় না। তা হয় না বটে এবং আমাদের প্রশ্ন সেখানেই। যদি কুড়ি বছর ধরে বিরোধী দলগুলো সংসদের আসন আঁকড়ে বসে থাকত, প্রতিটি জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে হইচই, চিৎকার করে হলেও আলোচনা-পর্যালোচনা এবং জবাবদিহির কিছু নজির সৃষ্টি করত, এত দিনে বিরোধী দলের কথা শোনাটা তাহলে একটা সংসদীয় রেওয়াজে দাঁড়িয়ে যেত, বিশেষ করে সরকারগুলো যখন দেখত, বিরোধী দল হরতাল, জ্বালা-পোড়াও কর্মসূচি দিচ্ছে না। এই লেগে থাকার জন্য যে একগুঁয়েমি দরকার, তা বিরোধী দলগুলো দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে, যেহেতু এ জন্য পরিশ্রম ও নিষ্ঠা প্রয়োজন; বরং বিকল্পটাই অতি সহজ। একটা হরতাল ডেকে বসো। ভাঙচুর করো। আগুন জ্বালাও। ব্যস্ এই সহজ সমাধান বিরোধী দলগুলো বেছে নিয়েছে, যেহেতু প্রকৃত রাজনীতিবিদদের সংখ্যা এখন কমছে। অবশ্য এর আরেকটি কারণ হয়তো এই যে, এখন সাংসদদের এক বড় অংশ ব্যবসায়ী। তাঁরা সংসদে সময় নষ্ট না করে ব্যবসা করলে লাভ বেশি। হরতালে বিরোধী দলের অনেক নেতার কল-কারখানা চালু থাকে। চালু থাকে গত কুড়ি বছর ধরেই।
আর যে বলা হয়, হরতালেই এরশাদের পতন হয়েছিল: এরশাদকে তো আমরা স্বৈরশাসক বলি, যিনি নিজেই নিজেকে ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন। গত কুড়ি বছরের সরকারগুলো তো তা নয়—এগুলো তো জনগণের ভোটে নির্বাচিত। যেখানে সংসদে গিয়ে অন্তত চেষ্টা করা যায় প্রতিবাদ জানানোর, তা না করে হরতাল করাটা কি গণতন্ত্রের জন্য উত্তম চর্চা? আর নির্বাচিত একটি সরকারকে জোর খাটিয়ে ঠেলে ফেলে দেওয়াটা কি কাঙ্ক্ষিত? আর যদি একবার একটি নির্বাচিত সরকারকে এভাবে ফেলে দেওয়া যায়, ওই সরকার যখন যাবে বিরোধী দলে, সেও কি ওই অস্ত্র প্রয়োগে প্রথম দিন থেকেই উঠেপড়ে লাগবে না?
কোনো হরতালই তাই সমর্থনযোগ্য নয়; বরং যেসব ইস্যু নিয়ে হরতাল হয়, সেগুলো সমর্থনযোগ্য হলে অবশ্যই সবাই মিলে সেসব ইস্যুতে জনমত সৃষ্টিতে নেমে পড়বেন, এটিই প্রত্যাশিত। একটি নির্বাচিত সরকারকে হটাতে হবে নির্বাচনের মাধ্যমেই। ইস্যুগুলো নিয়ে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি হলে নির্বাচনে সরকারি দল হারবে—এটিই স্বাভাবিক এবং গণতন্ত্রের এটিই নিয়ম। এর ব্যত্যয় ঘটলে ক্ষতিটা হয় গণতন্ত্রের। তা ছাড়া হরতালে দেশ অচল করে দিলেও শেষ পর্যন্ত সরকার কী পড়ে? নাকি সরকারের অবস্থান আরও কঠোর হয়? হরতাল যদি একটি সার্বজনীন সমাধান হতো, প্রতিদিনই তো তাহলে বিশ্বজুড়ে হরতাল হতো।
৪ ডিসেম্বর বিএনপি হরতাল দিল ঢাকা বিভক্তির বিরুদ্ধে। গায়ের জোরে ঢাকা ভাগ করে সরকার আগামী নির্বাচনে নিজেদের অবস্থান অনেকটা দুর্বল করে ফেলল। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এমনকি বিভক্ত দুই ঢাকার মেয়র নির্বাচনে সব দল অংশ নিলে আওয়ামী-সমর্থিত প্রার্থীরা জয় পাবেন কি না, তাতেও বিস্তর সন্দেহ রয়েছে। ফলে সরকারের খারাপ কাজের তালিকায় এটিও জায়গা করে নিল। বিএনপির নেতারা বললেন, তাঁরা ক্ষমতায় গেলে বিভক্ত ঢাকাকে আবার জোড়া দেবেন। ফলে মানুষ একটি সমাধান পেল। কিন্তু হঠাৎ এই হরতাল ডাকায় মনে হলো বিএনপি যেন চটজলদি একটা সমাধান চাইছে, যেন হরতাল ডাকলেই সরকার ভয় পেয়ে সিদ্ধান্ত পাল্টাবে। কিন্তু বিএনপির হরতালে সরকার তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবে না, তা দলটির নেতারাও তো জানেন। তাহলে কেন এই হরতাল? এদিকে বিএনপির নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, প্রয়োজনে লাগাতার হরতাল হবে। কী সাংঘাতিক কথা! একদিকে বিএনপি বলছে, দেশের অর্থনীতি দেউলিয়া হয়েছে, সবকিছু ভেঙে পড়ছে, ইত্যাদি। অন্যদিকে দিচ্ছে লাগাতার হরতালের হুমকি। ধরে নিলাম, লাগাতার হরতালে—যার অভিঘাতে অর্থনীতি প্রকৃতই দেউলিয়া হবে, সরকারের পতন হলো, এবং বিএনপি জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে ক্ষমতায় এল। তাহলে কোন বাংলাদেশের দায়িত্ব তারা নেবে? এক বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত বাংলাদেশের? তাও যদি দলটির থাকত পরিষ্কার ভাবমূর্তি এবং দুর্নীতির প্রতি জিরো টলারেন্স। অথচ দলটিকে এখনো তাড়িয়ে বেড়ায় হাওয়া ভবনের কেচ্ছাকাহিনি। তার পরও ‘বিএনপি কোনো দুর্নীতি করেনি, সবই আওয়ামী-প্রোপাগান্ডা’—এসব বলে না হয় দলটি ঝাঁপিয়ে পড়ল অর্থনীতি মেরামতে। কিন্তু হরতালে আগেভাগে ক্ষমতা হারিয়ে আওয়ামী লীগ যদি তখন লাগাতার হরতালের কর্মসূচি দেয়, তখন বিএনপি (ও জামায়াত) সরকার ‘হরতাল দেশের জন্য ক্ষতিকর’, ‘হরতাল দেশ বিক্রির ষড়যন্ত্র’—এসব আওয়াজ তুলে দমনপীড়নে নামলেও লাভ হবে না। দেশটা সেই যে ডুবতে থাকবে, তা থেকে আর উদ্ধার পাবে না।
ঢাকা বিভক্তিতে আমাদের যত আপত্তি থাকুক, যত হতাশ এবং বিরক্ত আমরা হই না কেন, বিএনপির জন্য এটি একটি রাজনৈতিক সুসংবাদ হয়েই এসেছে। দলটি ইতিমধ্যে ‘বিভক্ত ঢাকা এক হবে’ ঘোষণা দিয়ে প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু ৪ ডিসেম্বরের হরতাল প্রমাণ করল, ইস্যু যা-ই হোক, যতটা সুবিধা দলটাকে তা দিক, সহিংসতা আর দেশধ্বংসী কর্মসূচির বৃত্ত থেকে দলটি বেরোতে পারল না। হরতাল আর রোডমার্চ এক নয়; রোডমার্চ যেখানে নতুন একটি চিন্তা, হরতাল সেখানে মরচে পড়া সেকেলে একটি কর্মসূচি। হরতালের সংস্কৃতি থেকে আমরা কী বেরোতে পারি না? নাকি আওয়ামী লীগ যে বলছে, হরতালের পেছনে রয়েছে অন্য এক উদ্দেশ্য, যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানো—কথাটা একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়? যদি তা-ই হয় এবং আগামীতে লাগাতার হরতালের একটি ইস্যু যদি হয় ‘যুদ্ধপরাধের অভিযোগে আটক নেতাদের নিঃশর্ত মুক্তি’, তাহলে আমরা কি খুব অবাক হব?
বাংলাদেশে শীতকালটা রাজনীতিবিদদের জন্য অতিপছন্দের। গায়ে শীতের রোদ মেখে কর্মসূচিতে অংশ নিলে ক্লান্তি লাগে না। এই শীতে তাহলে এ রকম কিছু হরতাল, (লাগাতার ও অলাগাতার) আমরা দেখতেই পারি। নাকি?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.