যুগের বাণী-একজন সংসদ সদস্য বনাম একজন বিচারপতি by মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী

যেটি লিখছি, সেটি কলাম নামে পরিচিত; যার শিরোনাম অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংক্ষিপ্ত হতে হয়, নইলে যথার্থ শিরোনামটি হতো_'জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা বনাম সাম্প্রতিক অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি; যার বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের সংবিধান থেকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করার সুপারিশ-সংক্রান্ত রায়।'


১৯৯৬ সালে সংবিধান (ত্রয়োদশ সংশোধন) আইন দ্বারা বাংলাদেশের সংবিধানের চতুর্থ ভাগে 'নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার' উপশিরোনামযুক্ত '২ক পরিচ্ছেদ' সনি্নবেশিত হয় এবং পরিচ্ছেদটিতে ৫৮খ থেকে ৫৮ঙ_এই চারটি অনুচ্ছেদ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পৃথিবীতে যে কয়টি রাষ্ট্রে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু আছে, সেগুলোর মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশেই এই অদ্ভুত ব্যবস্থাটি চালু করা হয়। সেটা করার কী বাধ্যকর পরিস্থিতি তৎকালে উদ্ভব হয়েছিল, সেটা স্মরণে আনা জরুরি। তৎকালীন বিএনপি সরকারের আমলে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি একতরফা নির্বাচন হয়েছিল। সেটা আপত্তিকর ছিল বিধায় বিএনপি সরকারকে ক্ষমতায় রেখে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া অসম্ভব_এই দাবির পক্ষে আন্দোলন এমন জোরদার হয় যে সেটাকে সামলাতে 'নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা' উদ্ভাবন করতে হয়।
পরবর্তীকালে এই ব্যবস্থাটি যে ত্রুটিপূর্ণ এবং তাতে বিস্তর ফাঁকফোকর আছে, সেটা ধরা পড়ে ২০০৭ সালে জাতীয় সংসদের নির্বাচন উপলক্ষে। অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিদের মধ্যে সর্বশেষ প্রধান বিচারপতিকে রাষ্ট্রপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার প্রথম শর্ত ছিল। বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির একদা সদস্য ছিলেন এমন একজন বিচারপতি যেন তিনি সর্বশেষ প্রধান বিচারপতি হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা হতে পারেন, সে জন্য সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা দুই বছর বাড়িয়ে দেওয়া হয়। অতঃপর যখন ওই অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি নির্দলীয় নন_এমন আপত্তি জোরদার হয়, তখন বিএনপির নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাটির আর এক ফোকরের সুযোগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিজেকে নিজে নিয়োগ দেন। পরে আন্দোলনের জোয়ারে রাষ্ট্রপতি প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ইয়াজউদ্দিন ওই কাজটি কেন করেছিলেন তার কারণটি সম্প্রতি উইকিলিকস কর্তৃক প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে। ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারিতে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির মতো আরেকটি একতরফা নির্বাচন করার কথা বিএনপির নেতা ভেবেছিলেন। ঢাকা থেকে ওয়াশিংটনে পাঠানো যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত কর্তৃক গোপন তারবার্তায় এটা উল্লেখ করা হয়েছিল।
সম্ভবত উপরোক্ত যৌক্তিক কারণের প্রেক্ষাপটে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ফুল বেঞ্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাটি সংবিধান থেকে বিলুপ্ত করার সিদ্ধান্ত দেন। এটা তৎকালীন প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের আদৌ একক সিদ্ধান্ত ছিল না। ইংল্যান্ডের খ্যাতনামা বিচারপতি লর্ড ডেনিং তাঁর লেখা 'দি চেঞ্জিং ল' (পরিবর্তমান আইন) বইটির মুখবন্ধের একটি অংশের অনূদিত উদ্ধৃতি এই : 'লোকজনের ধারণা আইনগুলো স্পষ্ট এবং সেগুলো সংসদ কর্তৃক কেবল পরিবর্তন করা যায়। সত্যটি হচ্ছে, আইনগুলো প্রায়ই অস্পষ্ট থাকে এবং এগুলো ক্রমাগত পরিবর্তিত কিংবা হয়তো আমার বলা উচিত, বিচারপতিগণ কর্তৃক পূর্ণতর করা হয়। তত্ত্বীয় মতে, বিচারপতিরা আইন প্রণয়ন করেন না, তাঁরা সেগুলোর অর্থ পরিষ্কার করেন। কিন্তু কেউ জানেন না, আইনটি কী হতে পারে, যে পর্যন্ত না বিচারপতিরা তার অর্থ পরিষ্কার করেন। অতএব বলা যায়, তাঁরা এটা প্রণয়নই করেন।'
গত মে মাসে এ রায়টি দেওয়া হয়, অথচ সংবাদপত্রের প্রতিবেদন পড়ে জানা গেল, তার প্রায় দুই বছর আগে ২০০৯ সালের জুলাই মাসে তৎকালীন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি খায়রুল হককে তাঁর স্ত্রীর বিদেশে চিকিৎসার জন্য ১০ লাখ ৩৭ হাজার টাকা প্রধানমন্ত্রীর রিলিফ ফান্ড থেকে দেওয়া হয়। বেগম হক ফুসফুসের ফোকরে গুরুতর রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং তাঁর চিকিৎসক ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী (পরবর্তীকালে বিএনপির শাসনামলে রাষ্ট্রপতি) পরামর্শ দেন, লন্ডনস্থ ব্রম্পটন হাসপাতাল কিংবা ব্যাংককের বুমরানগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক গঠিত মেডিক্যাল বোর্ড একই পরামর্শ দেয়। এ-সংক্রান্ত বিধি অনুযায়ী বিচারপতি হক চিকিৎসার খরচের জন্য তৎকালীন প্রধান বিচারপতির কাছে চিঠি দেন এবং চিঠিটি বিধিমতো আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এরপর আইন মন্ত্রণালয়ের বিধিমতো উদ্যোগে প্রধানমন্ত্রীর সাহায্য তহবিল থেকে এ অর্থ প্রদান করা হয়।
উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রীর সাহায্য তহবিল থেকে চিকিৎসার জন্য একই প্রক্রিয়ায় আরো তিনজন প্রধান বিচারপতিকে ও সুপ্রিম কোর্টের তিনজন বিচারপতিকে চিকিৎসার জন্য অর্থ দেওয়া হয়েছে এবং প্রথম দুজনের প্রাপ্ত অর্থের পরিমাণ যথাক্রমে ২১ লাখ ১৫ হাজার ও ১৫ লাখ ৭০ হাজার টাকা। ওপরের ঘটনাগুলোর প্রেক্ষাপটে কি বলা যায়, একজন বিচারপতি সঠিক সিদ্ধান্ত না দিয়ে পক্ষপাতদুষ্ট রায় দিতে পারেন? প্রিয় পাঠক, আপনি যদি একজন যুক্তিবাদী মানুষ হন এবং কেন হবেন না, যেহেতু যুক্তিবাদীতাই সুশৃঙ্খল সমাজ গড়ার একমাত্র ভিত্তি, সে ক্ষেত্রে প্রশ্নটির উত্তরে আপনি অবশ্যই বলবেন, 'না।' যদি কেউ 'হ্যাঁ' উত্তর দেন রাজনৈতিক উত্তেজিত মুহূর্তে, সে ক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ে তাঁর কর্তব্য কী? প্রশ্নটির উত্তর পাওয়া যাবে বোধ করি নিম্নবর্ণিত ঘটনাটির আলোকে।
১৯৮২ সালের জানুয়ারি মাসে লর্ড ডেনিং একটি বই লেখেন, যার নামের বঙ্গানুবাদ হবে 'বিধি-বিধানের অতঃপর কোনটা?' এই বইটির একটি অনুচ্ছেদে লর্ড ডেনিং মন্তব্য করেন, ফৌজদারি মামলায় কোনো কোনো অভিযুক্ত অবশ্য গ্রাহ্য আপত্তির সুযোগ নিয়ে তাদের বিচারকালে সহানুভূতিশীল ব্যক্তিদের নিয়ে জুরিবর্গ গঠন করিয়ে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ লর্ড ডেনিং ব্রিস্টল শহরে সংঘটিত দাঙ্গা মামলাটি উল্লেখ করে লেখেন, ওই মামলার অভিযুক্ত ব্যক্তিরা ও জুরিবর্গের অধিকাংশ কালো সম্প্রদায়ের ছিলেন। লর্ড ডেনিংয়ের উপরোক্ত মন্তব্যে তথ্যগত ভুল ছিল। ওই মামলার অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আদৌ ইচ্ছানুযায়ী নয়, বরং ওই মামলার বিচারকের একক ইচ্ছানুযায়ীই স্থানীয় কালো সম্প্রদায় থেকে অধিকাংশ জুরি নির্বাচিত হন বিচারপতি কর্তৃক এই যুক্তিতে যেন জুরিবর্গ প্রতিনিধিত্বমূলক হয়।
ইংল্যান্ডের পত্রপত্রিকায় লর্ড ডেনিংয়ের বইয়ে লিখিত এ মন্তব্যের তীব্র সমালোচনা করা হয় এবং তাঁর বিরুদ্ধে মানহানির মামলার প্রস্তুতি নেওয়া হয়। কালো সম্প্রদায়ের একজন ব্যারিস্টার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে লেখেন, 'একজন বড় বিচারপতি বৌদ্ধিক একাকিত্ব ও বৃদ্ধ বয়সের কারণে একটি বড় ভুল করেছেন।' লর্ড ডেনিং নিজের ভুল বুঝতে পারেন। তিনি প্রকাশ্যে দুঃখ প্রকাশ করেন এবং আপত্তিকর অংশটি বই থেকে বাদ দেন। তিনি নিজ ইচ্ছায় ঘোষণা দেন যে আগামী অক্টোবর মাসে বিচারপতির পদ থেকে অবসর নেবেন। আমার কাছে অনেকেই মানহানির সংজ্ঞা জানতে চেয়েছেন। এই লেখাটি প্রশ্নটির পণ্ডিতি উত্তর নয়, সাধারণ উত্তর। মানহানি সাধারণত দুই রকম। একটি হলো মৌখিক মানহানি আর অপরটি হলো লিখিত-পড়িত মানহানি, যাদের ইংরেজি নাম যথাক্রমে 'স্ল্যান্ডার' ও 'লাইবেল', কিন্তু বাংলা ভাষায় এদের পৃথক প্রতিশব্দ নেই।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, সুপ্রিম কোর্ট, আপিল বিভাগ

No comments

Powered by Blogger.