অরণ্যে রোদন-মা-মেয়ের সংগ্রাম কি শেষ হবে না? by আনিসুল হক

বি রুবি রহমানের সঙ্গে বহু দিন দেখা করার সাহস করে উঠতে পারিনি। তাঁর মুখোমুখি হওয়ার সাহস আমার ছিল না। তাঁর সঙ্গে যদি দেখা হয়েই যায়, তাঁকে কী বলব, তা আমি জানতাম না। ঘটনার তিন বছর পেরিয়ে গেল। গত ৩ আর ৪ ডিসেম্বর ছিল রুবি আপার সন্তান ও স্বামীর মৃত্যুর তৃতীয় বার্ষিকী।


রুবি আপার ছিল সুখের সংসার। তাঁর স্বামী দেখতে ছিলেন সত্যজিৎ রায়ের মতো। শ্রমিকনেতা নূরুল ইসলাম। সদালাপী বিনয়ী এই ভদ্রলোককে মনে হতো অজাতশত্রু। কবি রুবি রহমান মানেই যেন স্নিগ্ধতা। তাঁর চলাফেরা, কথাবার্তায় বৃষ্টিধোয়া কাঁঠালচাঁপা ফুলের শান্ত স্নিগ্ধতা। তাঁর মতোই তাঁর কবিতাও খুব পরিমিত, সুরুচি-সুন্দর। তাঁকে দেখে আসছি সেই ১৯৮৭ সাল থেকে, জাতীয় কবিতা উৎসব উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে কবি রুবি রহমান আসতেন। সঙ্গে আসত তাঁর কিশোরী মেয়েটি—মৌটুসী ইসলাম।
রুবি রহমানের সঙ্গে আমার একটা বিশেষ হূদ্যতা আছে। দেখা হলেই আমাদের দুজনের মধ্যে একটা বার্তা বিনিময় ঘটে যেত। রুবি রহমান আমার কাছে কবিতা চাইতেন। তিনি কালি ও কলম-এর সম্পাদকীয় বিভাগে যোগ দেওয়ার পরও আমার কাছে গদ্য চাননি, কবিতাই চেয়েছেন। তিনি আমাকে বলতেন, ‘আনিস, আমি কিন্তু তোমার কাছে কবিতাই চাইব। গদ্য আমি তোমার কাছে চাই না।’
আমি খুব খুশি হতাম।
রুবি আপার কাছ থেকেও আমি আশা করতাম কবিতার অপূর্ব পঙিক্তমালাই।
এক ছেলে তমোহর, এক মেয়ে মৌটুসী, কবি রুবি রহমান আর শ্রমিকনেতা গণতন্ত্রী পার্টির সভাপতি নূরুল ইসলাম; তাঁদের ছিল সোনার ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখা ছবির মতো সংসার।
রুবি আপা ২০০৮ সালে গেলেন আমেরিকার আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে, আন্তর্জাতিক লেখকদের আবাসিক কর্মসূচিতে। আপনারা যাঁরা আমার লেখা নিয়মিত পড়েন, তাঁরা জানেন, ২০১০ সালে একই কর্মসূচিতে বাংলাদেশ থেকে আমিও গিয়েছিলাম। ওখানে কী কী করেছি, তার কিছু কিছু বর্ণনা আপনারা প্রথম আলোর এই কলামেই গত বছর পড়েওছেন। রুবি রহমানও আনন্দের সঙ্গেই গিয়েছিলেন আমেরিকায়। ৩ মাসের কর্মসূচি তখন শেষ। তিনি এসেছেন ওয়াশিংটন ডিসিতে। তাঁর মেয়ে মৌটুসীর বাসায়। মৌটুসী কাজ করেন একটা বিশ্বসংস্থায়। ঢাকায় রুবি আপার ছেলে ৩৮ বছরের তমোহর আছে। আছেন নূরুল ইসলাম। প্রোগ্রাম শেষ। মেয়ের বাসায় কয়েক দিন থেকেই ঢাকা ফিরে আসবেন রুবি রহমান।
ঢাকায় সে সময় চলছে নির্বাচনের মনোনয়ন নিয়ে উত্তেজনা। সামনে নির্বাচন। নূরুল ইসলাম প্রার্থী হবেন মহাজোট থেকে, সেই রকমেরই প্রস্তুতি চলছে।
ঠিক এই সময় ঢাকায় ঘটে যায় সেই হূদয়বিদারক ঘটনা। ৩ ডিসেম্বর রাতে লালমাটিয়ার ফ্ল্যাটে কী একটা রহস্যময় বিস্ফোরণ ঘটে, তাতে সে রাতেই মারা যান তমোহর, পরের দিন মৃত্যুবরণ করেন নূরুল ইসলাম।
কীভাবে খবর পেলেন কবি রুবি রহমান?
কীভাবে তিনি ছুটে এলেন ঢাকায় এটা দেখতে যে তাঁর ছেলে ও স্বামী আর নেই?
কীভাবে এসেছিলেন মৌটুসী, যিনি তাঁর বাবা ও ভাইকে আর কোনো দিনও দেখবেন না।
রুবি রহমানের সামনে এরপর থেকে দাঁড়াতে পারি না। তাঁর চোখের দিকে তাকাতে পারি না। তাঁকে একটা সান্ত্বনার বাক্যও আমি বলতে পারিনি। স্বামী আর পুত্রকে রেখে আমেরিকায় গিয়ে ফিরে এসে যিনি দেখেছেন তাঁদের মৃতদেহ, সেই মানুষটাকে কীভাবে সমবেদনা জানাতে হয় আমি জানি না।
এই পরিবারটি এবং তার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের সচেতন মানুষ, সেই দিন থেকে নূরুল ইসলাম ও ইসলাম তমোহর নিহত হওয়ার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চেয়ে আসছে। গত পরশু, শনিবার, ৩ ডিসেম্বর ২০১১, তাঁদের মৃত্যুর তৃতীয় বার্ষিকীতেও দুটো কর্মসূচি পালিত হয়েছে। দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় মৌন মানববন্ধন হয়েছে। সেখানে মুহম্মদ জাফর ইকবালসহ অনেকেই দাঁড়িয়েছিলেন হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করে প্রকাশিত পোস্টার শরীরে সেঁটে। মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, ‘বিজয়ের মাস এলে মানুষ আনন্দ বোধ করে। কিন্তু তিন বছর ধরে ডিসেম্বরে আর আনন্দ করতে পারছি না। যাঁরা বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলেন, যাঁদের ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, তাঁদেরই একজনকে হত্যা করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা জানতে পেরেছি, কয়েক দিন আগে নূরুল ইসলামকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। আমরা জানতে চাই, কারা হুমকি দিয়েছিল।’
শনিবারেই বিকেল বেলা নূরুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে গঠিত নাগরিক কমিটি আয়োজিত সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন। বক্তব্য দেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, আওয়ামী লীগের নেতা তোফায়েল আহমেদ, ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন, আওয়ামী লীগের নেতা নুহ-উল আলম লেনিন, পঙ্কজ ভট্টাচার্য্য, ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী, সিপিডির নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান, কবি মহাদেব সাহা। সভা সঞ্চালন করেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে উপস্থিত ছিলেন, মতিয়া চৌধুরীর মতো জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী ছিলেন। এর আগে, সৈয়দ আশরাফুল ইসলামও নূরুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করে আয়োজিত কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন। রুবি রহমান নিজেই এখন আওয়ামী লীগের সাংসদ।
এরপরও মৌটুসী তাঁর ভাই হত্যা, পিতৃহত্যার দাবিতে সংগ্রাম করতে করতে যেন জ্বলে-পুড়ে যাচ্ছেন। রুবি রহমান যেন ভেঙে পড়ছেন।
রুবি রহমান আর মৌটুসী এই মা-মেয়েকে যেন উজানস্রোতে নৌকা বাইতে হচ্ছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই হত্যাকাণ্ডও ধামাচাপা পড়ে যাবে। এই দুই নারী কোনো দিনও তাঁদের স্বজন হত্যার বিচার পাবেন না।
এই আশঙ্কার কারণ আছে। কারণ, যাকে তাঁরা বলছেন হত্যাকাণ্ড, কেউ কেউ তাকে একটা হঠাৎ ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দিতে চান। প্রচার করা হয়েছে, ফ্রিজ বিস্ফোরণে এই ঘটনা ঘটেছে।
অথচ ফ্রিজের গ্যাস সিলিন্ডার অক্ষত আছে। ফিজের সঙ্গে বিদ্যুতের কোনো সংযোগ ছিলই না।
বলা হয়েছে, শর্টসার্কিট থেকে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। অথচ শর্টসার্কিটের কোনো চিহ্নই নেই ওই গৃহে।
তাঁরা বলছেন, ওই দিন তাঁদের বাসগৃহের প্রবেশদ্বারের চাবি বাঁকানো ছিল। কে বাঁকিয়েছিল?
গ্রিলও বাঁকানো ছিল।
মৌটুসী এর আগে প্রকাশিত তাঁর লেখায় এসব প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি জানতে চান, কেই বা ২ ডিসেম্বর ২০০৮-এ নোয়াখালী সফররত নূরুল ইসলামকে ফোন করে ঋণখেলাপি হিসেবে তাঁর নাম উঠেছে বলে তাঁকে ডেকে ঢাকায় এনেছিল?
এসব প্রশ্ন নিয়ে মৌটুসী একবার সংবাদমাধ্যমের অফিসে, একবার মন্ত্রী-নেতাদের বাড়িতে কিংবা দপ্তরে, একবার পুলিশের উচ্চকর্তাদের দ্বারে হন্যে হয়ে ঘুরছেন।
কথার মালা গাঁথা হচ্ছে, কিন্তু তদন্ত ঠিক পথটা খুঁজে পায় না। এই মামলা ‘চাঞ্চল্যকর মামলা হিসেবে’ গণ্য করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেল বিশেষভাবে এই মামলা পর্যবেক্ষণে রেখেছে। তবু তদন্ত এগোয় না কেন?
তখনই ভয়ে আমাদের শরীর হিম হয়ে আসে। আওয়ামী লীগের এমপি তাঁর স্বামী ও সন্তান হত্যার বিচার পান না! মহাজোটের সম্ভাব্য প্রার্থীকে মেরে ফেলা হলো, সেই মহাজোট বিপুল ভোটে জিতে ক্ষমতায় এল, তারপরও সেই হত্যারহস্যের কিনারা হয় না। স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যেই নিহতের স্মরণসভায় উপস্থিত থাকেন, সেই নিহত তাঁর মৃত্যুর বিচার পান না?
রুবি রহমানের মুখের দিকে তাকানোর সাহস তাই আমরা হারিয়ে ফেলি। তাঁর মেয়ে মৌটুসী যখন বিচারের দাবিতে জনমত সংগঠনের জন্য প্রাণান্তকর পরিশ্রম করেন, আমরা তাঁকে সমর্থন দিই, কিন্তু আশ্বাস দিতে পারি না।
এবার বোধহয় সময় এসেছে সত্যিকারের একটা পরিবর্তন আনার। অর্থবহ কিছু একটা করার। শ্রমিকনেতা নূরুল ইসলাম হত্যা মামলাকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়ার, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার। আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে এই ‘হত্যাকাণ্ডের’ সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা যাবে না, আমাদের তা মনে হয় না। মৌটুসী ইসলাম ও অন্যরা যে প্রশ্নগুলো তুলছেন, সেসবের উত্তর তো আমাদের পেতে হবে। সেসব প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব পাওয়ার পরে যদি একটা সিদ্ধান্তে আসা যায়, সেই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে নিশ্চয়ই কারো আপত্তি থাকবে না।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.