জননী সাহসিকা-মা এখনো আছেন ছায়া হয়ে

বাড়িতে ছোট্ট শিশুরা এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করছে। কেউ কেউ এটা-ওটার বায়না ধরছে—যেন নাছোড়বান্দা! পূরণ করা চাই-ই চাই। তাতে বিরক্ত হতে পারে কেউ! কিন্তু শিশুদের এই চঞ্চলতার মধ্যেই নিজের তৃপ্তি খুঁজছেন একজন। তিনি মহসিনা খাতুন। তাঁর একটি বড় পরিচয় হচ্ছে, তিনি শহীদ অধ্যাপক আনোয়ার পাশার স্ত্রী।
১৯৭১ সালে দেশদ্রোহী ঘাতকেরা পরিকল্পিতভাবে হত্যা করার জন্য যে কজন বুদ্ধিজীবীকে ধরে নিয়ে নির্বিচারে হত্যা করেছিল, তাঁদেরই একজন অধ্যাপক আনোয়ার পাশা। ‘১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর ঈশা খাঁ রোডের বাসায় ছিলাম আমরা। সকালে বাবাকে নাশতা দিলেন মা। শোবার ঘর থেকেই লক্ষ করলেন, একটা গাড়ি এসে বাসার ঠিক সামনে এসে দাঁড়াল। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওরা বাবাকে ধরে নিয়ে গেল। এরপর মা এখানে-সেখানে বাবাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান হলেন, কিন্তু সে যাত্রায় তাঁর দেখা পেলেন না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জানুয়ারির ২ তারিখ বাবার লাশ পাওয়া গেল মিরপুরের বধ্যভূমিতে। মা আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে যেন চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলেন।’—স্বাধীনতার ৪০ বছর পর এভাবেই সেদিনের কথায় ফেরত গেলেন অধ্যাপক আনোয়ার পাশার ছোট ছেলে রবিউল আফতাব। যুদ্ধের পরে মা মহসিনা খাতুন কীভাবে তাঁদের আগলে রেখে বড় করেছেন, শিক্ষিত করেছেন, নিজের পায়ে নিজেদের দাঁড়াতে শিখিয়েছেন—সেই কথাগুলোই শোনা গেল তাঁর মুখে।
তখন তাঁর বয়স ছয় বছর। বড় ভাই মাশারুল আফতাব কলেজে পড়েন। এই দুই সন্তানকে নিয়ে মা মহসিনা খাতুন চিন্তিত হয়ে পড়লেন। পরিবারের উপার্জনক্ষম মানুষটি না থাকলে একটি পরিবারের কী অবস্থা হয়, তা সহজেই অনুমেয়। মহসিনা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। পরিবারের দুই সন্তানকে রেখে কোনো চাকরি করবেন, সেই অবস্থাও ছিল না। সে সময় শহীদ বুদ্ধিজীবীর পরিবারকে ৫০০ টাকা করে ভাতা দেওয়া হতো। পরে তা বাড়িয়ে এক হাজার টাকা করা হয়। এ রকম অবস্থায় সেই কটা টাকা দিয়েই টেনেটুনে সংসার কোনো রকম চলে যেত। এমনও অনেক দিন গেছে, ঘরে কোনো টাকা নেই, কিন্তু প্রয়োজন তো থেমে থাকে না। সেই দিনগুলো তিনি পার করেছেন।
১৯৭২ সালে বিধ্বস্ত এই পরিবারের ওপর নেমে এল আরেক কঠিন দুর্যোগ। মহসিনা খাতুনের বড় ছেলেকে ভুল করে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল। পরে যদিও পুলিশ নিজেদের ভুল বুঝতে পারল, কিন্তু ততক্ষণে ক্ষতির চূড়ান্ত হয়ে গেছে। বাড়ি ফিরেই তাঁর বড় ছেলে মানসিকভাবে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। যে ছেলেটি এসএসসি ও এইচএসসিতে অনেক ভালো ফল করেছিল, সেই ছেলের এমন অবস্থায় ধাক্কা খেলেন মা। এই সময়ে ছেলেকে আদর-মমতা দিয়ে, শক্তি-সামর্থ্য দিয়ে মনোবল জুগিয়ে অনেকটা স্বাভাবিক করতে পারলেন মহসিনা খাতুন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিভাগে পড়ালেখা শেষ করেন তিনি। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) কর্মরত বড় ছেলে মাশারুল আফতাব। কিন্তু এখনো তিনি মানসিকভাবে পূর্ণ সামর্থ্য ফিরে পাননি। চোখে যেমন কম দেখেন, তেমনি কিডনিতেও সমস্যা রয়েছে তাঁর। সন্তানের এই অসহায় অবস্থার কথা ভেবে এখনো দিনমান বিচলিত থাকেন মহসিনা খাতুন। ছোট ছেলে রবিউল আফতাবকেও তিনি সমানভাবে পড়াশোনার তাগিদ দিতেন। ‘মা সব সময় আমাদের দিকে খেয়াল রাখতেন। ঠিকমতো পড়াশেনা করছি কি না, তা লক্ষ রাখতেন। এভাবে ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে আমার পড়ালেখা শেষ হয়। এরপর একটি চাকরি পাই আমি। কিন্তু আজকে এই জায়গায় আসার পেছনে মায়ের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। মা আমাদের আগলে রেখেছেন বুকের মধ্যে। এখনো মা আমাদের পাশে ছায়ার মতোই পাশে আছেন। তিনি কখনো ভেঙে পড়েননি। এত কষ্ট করেছেন তিনি আমাদের জন্য, তা বলে বোঝানো যাবে না।’ রবিউল আফতাবের কণ্ঠ ধরে আসে।
আনোয়ার পাশা ১৯৬৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন এবং আমৃত্যু এখানেই কর্মরত ছিলেন।ছিলেন একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক। তাঁর রোটি-রাইফেল-আওরাত উপন্যাসটি রচিত হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আনোয়ার পাশা নামের একটি আলাদা ভবন আছে। সেখানেই একটি বাসাতে ছেলেদের সঙ্গে থাকেন মহসিনা খাতুন। বাইরে থেকে কেউ এলে, স্বামীর বিষয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন। ছোট ছেলে রবিউলের মুখেই শোনা যায় আক্ষেপের কথা। ‘একজন শহীদ বুদ্ধিজীবীর স্ত্রী হয়ে যে সম্মানটুকু মায়ের পাওয়ার কথা ছিল, তা কি তিনি পেয়েছেন? নিজেও যেমন কষ্ট করেছেন, তেমনই আমাদের অনেক কষ্টে বড় করেছেন। তিনি জানেন, বাবা ফিরে আসবেন না কখনো, তার পরও তাঁর জন্য তিনি অপেক্ষা করেন। এই বুঝি বাবা দরজায় টোকা দিলেন!’
ছেলেরা কাজে ঘরের বাইরে থাকে, মহসিনা খাতুনের দিন কাটে নাতি-নাতনিদের সঙ্গে। তাদের মধ্যেই নিজেকে বিলিয়ে দেন তিনি। যুদ্ধের গল্প শোনান। সেই গল্প শুনতে শুনতে একসময় নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে তারা। স্বামী হারানোর পর কষ্টে সন্তানদের বড় করেছেন মহসিনা খাতুন, কখনো কি তিনি পেরেছেন এক রাত নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমাতে?
মোছাব্বের হোসেন

No comments

Powered by Blogger.