জীবনটা যদি তাজমহল হতো! by সুভাষ সাহা

লোর গতিকে ছাড়িয়ে যাওয়ার যুগেও নারী-পুরুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে নারী এখনও দেহসর্বস্বরূপে লজ্জাবতী লতার মতো লীলায়িত ভঙ্গিমায় পুরুষের করুণাপ্রার্থী হয়ে বাঁচে-মরে। যে দেশটির শক্তির শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে গর্ব, জ্ঞান-বিজ্ঞানে শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে গর্ব, খাওয়া-দাওয়া, বিলাস-ব্যসনে তপস্বীর ত্যাগের মহিমা কীর্তনের পরিবর্তে আসক্তিতে জীবনের মানে খোঁজা_ গণতন্ত্রের আধুনিক দীক্ষাদানের অধিকার সংরক্ষণকারী সেই মার্কিন সমাজে নারী আধুনিকা হয়েও পুরুষের নিগ্রহ এমনকি ধর্ষণের হাত থেকে বাঁচতে সেই পুরুষশাসিত সমাজেরই কৃপাপ্রার্থী।


আমাদের দেশে নারী নিগ্রহ, নারীকে খাটো জ্ঞান করা, তাদের কেবল ভোগের বস্তু হিসেবে নানা কায়দায় উপস্থাপন করা এখন মোল্লা বা পুরোহিততান্ত্রিক সামাজিক বেড়া অতিক্রম করে আধুনিক দাবিদারদের পরিবার ও সমাজে নানা রঙে নানা রগরগে বর্ণনায় আদৃত হয়। মেয়েরা কোনো ক্ষেত্রে পুরুষকে ছাড়িয়ে গেলে অনেকের পৌরুষে (!) ঘা লাগে_ যন্ত্রণাকাতর মন ঈর্ষাতুর হয়ে নারীর শারীরিক গঠনের তথাকথিত দুর্বলতা নিয়ে পরিহাসের মধ্যে পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বের মহিমা প্রকাশে উদ্বেলিত হয়। এই একই মানসিকতা কি আমরা বাসে, ট্রেনে, পথচলায়, কর্মক্ষেত্রে, এমনকি সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠেও হরহামেশাই ঘটতে দেখি না?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে এবারের মাস্টার্স ফাইনালের ফল নিয়ে বিতণ্ডার কেন্দ্রেও মেয়েরাই চলে এসেছে। কেন ২৬ জন ফার্স্টক্লাস পাওয়া শিক্ষার্থীর ১৭ জনই ছাত্রী, সে ব্যাপারে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। পরীক্ষার ফল নিয়ে প্রশ্ন আসতেই পারে। তাই বলে ছাত্রীদের সঙ্গে শিক্ষকদের 'বিশেষ সম্পর্ক' থাকার কথা উল্লেখ করে নারীর মর্যাদাহানি করা কি আদৌ সমর্থনযোগ্য? এতে কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশে ছাত্রদের ছাত্রী দেখলেই নানা ভঙ্গিমায়, নানা ভাষায় টিজ করার মাত্রা বেড়ে যাবে না? এটা ধর্ষকাম মানসিকতায় এক ধরনের সুড়সুড়ি দেওয়ার সমতুল্য। তাই এ ধরনের ভাষা ব্যবহারের আগে সবার শতবার ভাবা উচিত।
আমাদের দেশের মেয়েরা সামাজিক ক্ষেত্রে, পারিবারিক ক্ষেত্রে অথবা কর্মক্ষেত্রে কি পূর্ণ স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার মধ্যে কাজ করতে পারে? শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও যদি মেয়েদের এভাবে নানা উপলক্ষে অশালীন মন্তব্য শুনতে হয় তাহলে নারীর অধিকার সুরক্ষা হবে কী করে আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পুরুষরা নারীকে সম্মানের চোখে দেখার মতো কতটুকু মননের অধিকারী হবে?
বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী, ধনশালী ও দানশীল মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ নারী অপরাহ উইনফ্রের জীবন বিশ্বের আর দশটা নারীর জীবনের মতোই নানা ঘাত-প্রতিঘাত আর যন্ত্রণা সয়ে সয়ে অঙ্গার হওয়ার মতো। কিন্তু জীবনযুদ্ধে জয়ী হয়ে উইনফ্রে এখন ওই অঙ্গারের বুক চিরে বেরিয়ে খাঁটি হীরা হয়ে ভূলোক আলোকিত করছেন। এখন তিনি কয়েক দিনের জন্য ভারত সফর করছেন। এ সময় এক অনুষ্ঠানে একজন তাকে তাজমহল উপহার দেবেন বলেছিলেন। এর জবাবে হাসতে হাসতে উইনফ্রে বলেছিলেন, 'আমার জীবনটাই তো তাজমহল হয়ে গেছে।' হ্যাঁ, সত্যিই তার জীবনটা তাজমহলের মর্মর পাথরের বুকে ধারণ করা কালজয়ী কাহিনীর মতোই। কৃষ্ণাঙ্গ মায়ের সন্তান উইনফ্রে মাত্র ৯ বছরের শিশু বয়সেই পৃথিবীর ত্রূক্রর রূপের যে পরিচয় পান তা যেন মেয়েদের জীবনের চিরকালের প্রতিচ্ছবি। শিশু বয়সেই তাকে তার পালক পিতা ও পালক পিতার ছেলে নিয়মিত ধর্ষণ করে গেছে। পুরুষের এই পশুবৃত্তিক আদিম নির্মমতার বিরুদ্ধে লড়াই করে তবেই না তিনি জীবনকে জয় করতে সমর্থ হয়েছেন। এভাবেই তিনি কালক্রমে বিশ্বের নির্যাতিত, অবহেলিত ও সহায়হীন মানুষের একান্ত আপনজন হয়ে উঠেছেন। উইনফ্রের মতো নারীরা এখন নারী অধিকার ও মানবাধিকার আন্দোলনের দিশারি। তবে নারীকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য পুরুষের কর্তব্য কম নয়। বরং এ ক্ষেত্রে যোগ্য ভূমিকা পালনের মাধ্যমে পুরুষ তার আজন্ম পাপের কিছুটা হলেও স্খলন করতে পারে। নারীকে নিয়ে সুড়সুড়ি জাগানো রগরগে ভাষা বন্ধ করে পুরুষ জানান দিতে পারে, 'আমরাও সভ্য হওয়ার পথ ধরেছি।'
হায়! সব মানুষের মন যদি সত্যিই তাজমহল হয়ে যেত! তাহলে পৃথিবীর রঙ, রূপ, গন্ধ এক অনির্বচনীয় আনন্দধারায় মিলেমিশে নারী-পুরুষের সম্পর্কে সাম্য প্রতিষ্ঠিত হতো।

No comments

Powered by Blogger.