মাটি ও বালু রপ্তানি : প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ by হাসান কামরুল

মাটি ও বালু রপ্তানি নিয়ে একটি বিধি প্রণয়ন করা হয়েছে। বিধিতে বলা হয়েছে, পরিবেশ মন্ত্রণালয়, খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের অনাপত্তিপত্র গ্রহণ সাপেক্ষে বিদেশে মাটি ও বালু রপ্তানি করা যাবে। বাংলাদেশ নিম্নভূমির দেশ। মাটির আসল রূপ বলতে যা বোঝায়, তা বাংলাদেশের মধুপুর গড়, লালমাই গড় ও বরেন্দ্র অঞ্চলেই রয়েছে। বাংলাদেশের বেশির ভাগ জায়গাই বালি দিয়ে গঠিত। নদীর অববাহিকায় পলি জমে ধীরে ধীরে ভূমিতে রূপান্তরিত হচ্ছে।


নদীনালার দেশ বলেই নদীর বুকজুড়ে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে শুধু চর আর চর। নদীর অববাহিকাজুড়ে বালু মাটির পুনর্বিন্যাসে বছরের পর বছর ধরে জৈবিক প্রক্রিয়ায় মাটির গঠনের ভিত স্থিতিশীল করে, যা পরবর্তী সময়ে জনপদে পরিণত হয়।
বাংলাদেশে নদীনালা, খালবিল, ডোবা, পুকুর সর্বত্রই ড্রেজিংয়ের চিত্র পরিলক্ষিত হয়। ব্যক্তি থেকে শুরু করে বালুমহাল ইজারা নেওয়া পর্যন্ত বালু উত্তোলনের চিত্র দেশজুড়ে বিদ্যমান, যা প্রভাবশালী মহলের ছত্রচ্ছায়ায় পরিবেশগত স্টাডি না করেই বছরের পর বছর ধরে চলছে। পরিবেশগত ছাড়পত্রেরও প্রয়োজন পড়ে না তাদের। সরকারি অনুমোদন ছাড়াই বালি উত্তোলনের চিত্র ভবিষ্যতের ভয়াবহতার ইঙ্গিত দিচ্ছে। ফলে ভূমিধসের মতো মারাত্মক ঘটনা ঘটতে পারে। বিশেষ করে বড় মাপের ভূমিকম্প হলে বালু উত্তোলিত এলাকায় ভূমির উপরিভাগ থেকে দেবে যাবে কয়েক মিটার। মাটি ও বালু রপ্তানির অনুমতি প্রদান করা হলে বিশেষায়িত এলাকা অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে। আর সেটা যেন নদী ড্রেজিংয়ের ফলে যে মাটি পাওয়া যাবে সে মাটিই রপ্তানি পণ্য হিসেবে নির্ধারিত হয়। অন্যথায় দেখা যাবে নিকট ভবিষ্যতে মধুপুর ও বরেন্দ্র ভূমির মাটি রপ্তানি পণ্যে জায়গা করে নিয়েছে। ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের নদনদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনার জন্য সরকার মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ১০১৪ লাখ ঘনমিটার বালি নদীপথ থেকে সরানো হবে। ৬৭৭ লাখ ঘনমিটার বালু বেসরকারি পর্যায়ে এবং ৩৩৭ লাখ ঘনমিটার বালু সরকারিভাবে নদী থেকে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে অপসারণ করা হবে (সূত্র : বিআইডাবি্লউটিএ)। সংগৃহীত বালু দেশের বিদ্যমান বাঁধ রক্ষা এবং নতুন রাস্তা নির্মাণে ব্যবহার করা হবে বলে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ে বলা হয়েছে। চলমান ড্রেজিং এলাকায় দেখা যায়, খননকৃত জায়গার পাশেই উত্তোলিত বালি ফেলা হচ্ছে, যা পরবর্তী সময়ে আবার ড্রেজিংকৃত এলাকায় গিয়েই পড়ছে। ফলে একই জায়গায় বছরের পর বছর ড্রেজিং হচ্ছে, যা রাষ্ট্রের অর্থের অপচয় ছাড়া কিছুই না। যদিও প্রধানমন্ত্রী ড্রেজিং প্রকল্পে সংগৃহীত বালু ড্রেজিং এলাকা থেকে ২০০ মিটার দূরে মজুদের কথা বলেছেন। কিন্তু লাখ লাখ ঘনমিটার বালু মজুদের মতো উম্মুক্ত স্থান ড্রেজিং এলাকায় পাওয়া যাবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েই যায়। জায়গার সংকুলান করা না গেলে ড্রেজিং এলাকায়ই বাধ্য হয়ে বালি ডাম্প করতে হবে। ফলে নদীর গতিপথের সংকোচন ছাড়া প্রসারণ হবে না। তাই সংগৃহীত বালি রাখার জায়গার সংকুলান না করে ড্রেজিং করে খুব একটা লাভ হবে না।
মাটি ও বালু রপ্তানির জন্য মালদ্বীপ বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করেছে। মালদ্বীপ জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রে তলিয়ে যাবে, তাই মালদ্বীপের জমি পুনরুদ্ধারে মাটি ও বালুর প্রয়োজন। মালদ্বীপ প্রথমে ভারত থেকে মাটি ও বালু আমদানির প্রস্তাব দিলে ভারত তা নাকচ করে দেয়। পরবর্তী সময়ে জলবায়ু সামিটে মালদ্বীপ আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ সরকারকে মাটি ও বালু রপ্তানির অনুরোধ জানায়। বাংলাদেশ সরকার ইতিবাচক মনোভাব দেখানোর পর পরই দুই দেশের কূটনৈতিক পর্যায়ে বিষয়টি উঠে আসে এবং সরকার প্রক্রিয়া সহজ ও দ্রুতকরণের লক্ষ্যে একটি বিধি প্রণয়ন করেছে। বিধিতে বলা হয়েছে, মালদ্বীপের চাহিদা বিবেচনায় এনে মাটি ও বালুর গুণগতমান পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে কারিগরি দিক পর্যবেক্ষণ সমেত প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য। প্রতিবেদনটি পাওয়ার পরই সরকার রপ্তানিযোগ্য বালুর পরিমাণ ও স্থান নির্ধারণ করার পর ত্বরিত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এ ক্ষেত্রে ভূতাত্তি্বক জরিপ অধিদপ্তরের মতামতের ভিত্তিতে খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় তাদের অবস্থান জানাবে। নদীর তলা থেকে মাটি ও বালু উত্তোলনের ফলে পরিবেশের কতটা হেরফের হবে, তা পরিবেশ অধিদপ্তরের মতামতের ওপর নির্ভরশীল। তারপর ভূমি মন্ত্রণালয়ের ভূমির ব্যাপার তো রয়েছেই। এতসবের পর আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিংয়ের প্রয়োজন হবে। সব কিছু বিবেচনার পরই সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে মাটি ও বালু রপ্তানি করা যাবে কি না? সরকার ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদনদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে চায় এবং এ লক্ষ্যে মহাপ্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। তাই ড্রেজিংকৃত মাটি ও বালু রাখা নিয়ে ভয়াবহ বিপদে পড়তে হবে। যদি নদীর বালু কেটে সরাসরি জাহাজে করে রপ্তানির সুযোগ রাখা হয়, তাহলে ডাম্প করার ঝামেলা পোহাতে হবে না। তবে মাটি ও বালু রপ্তানিতে প্রশাসনিক জটিলতা এড়িয়ে একমুখী সার্ভিস প্রদান করা গেলে মাটি ও বালু রপ্তানি খুব দ্রুত লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হবে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে অনাপত্তি গ্রহণের যে বিধান রাখা হয়েছে, তা কালক্ষেপণের নামান্তর হবে। ভালো হয় যদি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে একজন করে প্রতিনিধি নিয়ে টাস্কফোর্স গঠন করে দ্রুত অনাপত্তিপত্র বা ছাড়পত্র প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়, যা স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আগ্রহ জন্মাবে।

লেখক : ভূতত্ত্ববিদ

No comments

Powered by Blogger.