ধর্ম-ইসলামে সর্বজনীন মানবাধিকার by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

মানবাধিকার মানুষের জন্মগত মৌলিক অধিকার। এ ছাড়া কোনো ব্যক্তি মানবিক মর্যাদা নিয়ে জীবন ধারণ করতে পারে না। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি জীবনের সর্বক্ষেত্রে পরিব্যাপ্ত। ইসলামের ইতিহাসে প্রথম লিখিত সংবিধান ‘মদিনা সনদে’ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার ঘোষণা রয়েছে। ইসলামি জীবনব্যবস্থার যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিশ্বমানবতার মানবাধিকার লাভের নিশ্চয়তা বিধান করা হয়।


জীবন রক্ষার অধিকার: ইসলাম মানবজীবনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করেছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নরহত্যা অথবা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি ছাড়া কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন দুনিয়ার সমগ্র মানবগোষ্ঠীকে হত্যা করল। আর কেউ কারও প্রাণ রক্ষা করলে সে যেন পৃথিবীর সমগ্র মানবগোষ্ঠীকে প্রাণে রক্ষা করল।’ (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত-৩২)
মান-সম্মানের অধিকার: ইসলামে সমাজের ধনী-গরিব, উঁচু-নিচু, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, মুসলিম-অমুসলিম সর্বস্তরের মানুষের যথেষ্ট মান-সম্মান ও মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখার বিধান রয়েছে। কোনো অবস্থায় কাউকে অবমাননা করা চলবে না। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের কোনো সম্প্রদায় অপর সম্প্রদায়কে হেয়প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে যেন ঠাট্টা-বিদ্রূপ না করে।’ (সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত-১১)
ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার: ইসলামের দৃষ্টিতে প্রত্যেক মানুষই জন্মগতভাবে স্বাধীন। রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে তারা অবাধে চলাফেরা করতে পারবে। ইসলামি বিধান অনুসারে, বিনা বিচারে বা যুক্তিসংগত কারণ ব্যতীত কাউকে আটক রাখা যাবে না এবং শাস্তিও দেওয়া যাবে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বাণী প্রদান করেছেন, ‘ন্যায়সংগত কারণ ছাড়া ইসলামে কোনো ব্যক্তিকে বন্দী করে রাখা যাবে না।’ (মুয়াত্তা)
ধর্মীয় স্বাধীনতা: ইসলামে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। সব ধর্মের অনুসারীদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও উপাসনালয় রক্ষণাবেক্ষণের সুবন্দোবস্ত রয়েছে। কখনো ভিন্নধর্মাবলম্বীদের জোরপূর্বক ইসলামে দীক্ষিত করা যাবে না এবং তাদের ধর্মীয় কাজে কটাক্ষ করা যাবে না। এ মর্মে ইরশাদ হয়েছে, ‘ধর্মের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-২৫৬)
মত প্রকাশ ও বাকস্বাধীনতা: ইসলাম মানুষের মতামত প্রকাশের ও প্রচারের অধিকার সংরক্ষণ করেছে। ন্যায়সংগত ও গঠনমূলকভাবে সরকারি নীতির সমালোচনা করা যাবে, কিন্তু রাষ্ট্রদ্রোহ বা ধ্বংসাত্মক সমালোচনা অন্যায় ও অসংগত বলে বিবেচিত হবে। তবে মতামত প্রকাশের মধ্যে কোনো অশ্লীলতা থাকবে না।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ: ইসলাম মানুষকে যেকোনো ধরনের দুর্নীতি, অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার অধিকার দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) ঘোষণা করেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ যদি কারও অন্যায় কাজ করতে দেখে, তাহলে সে যেন হাত দিয়ে তা প্রতিহত করে; যদি সে এতে অক্ষম হয়, তবে মুখ দ্বারা নিষেধ করবে; যদি সে এতেও অক্ষম হয়, তবে সে অন্তর দ্বারা ঘৃণা পোষণ করবে।’ (মুসলিম)
সামাজিক নিরাপত্তা: ইসলাম ব্যক্তিগত ও পারিবারিক গোপনীয়তা রক্ষার প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দিয়েছে। যাতে প্রত্যেক নাগরিক বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে শান্তিতে বসবাস করতে পারে, সে জন্য বিনা অনুমতিতে কারও গৃহে প্রবেশ করা যাবে না।
সভা-সমিতির অধিকার: নাগরিকগণ মহৎ উদ্দেশে ও দেশ গড়ার জন্য বিভিন্ন সভা-সমিতিতে যোগদান করতে পারবেন। তাঁরা সভা-সমিতির মাধ্যমে জনগণকে উপদেশ প্রদান করবেন, নিজেরা সৎকাজ করবেন এবং অন্যকে সৎকাজের প্রতি আহ্বান জানাবেন ও সহযোগিতা করবেন।
জীবনযাত্রায় মৌলিক অধিকার: ইসলামে মানুষের জীবনযাত্রায় পাঁচটি মৌলিক অধিকার যথা—অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা প্রভৃতি চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা রয়েছে। কোনো দরিদ্র ও অভাবী নাগরিক অন্ন, বস্ত্র ও আশ্রয়হীন হয়ে পড়লে রাষ্ট্র তার দুর্দশা মোচনের জন্য সব ধরনের সাহায্য-সহায়তা প্রদান করবে।
সম্পদের অধিকার: ইসলাম সব মানুষের বৈধভাবে সম্পদ অর্জন, আয়, ব্যয়, ভোগ ও সঞ্চয়ের অধিকার দিয়েছে। এ ব্যাপারে রাষ্ট্র নাগরিকের সম্পদের নিরাপত্তা বিধান করবে। মহানবী (সা.) মক্কা বিজয়ের পর অমুসলিমদের জান-মাল ও সম্মান রক্ষণাবেক্ষণ করেছেন। কোনো মানুষের ধন-সম্পদ জোরপূর্বক দখল বা আত্মসাৎ করা ইসলামসম্মত নয়। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘তোমরা পরস্পরের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-১৮৮)
সাম্যের অধিকার: ইসলামের দৃষ্টিতে সব মানুষই সমান। ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত-অসম্ভ্রান্ত, ইতর-ভদ্র, মুসলিম-অমুসলিম সব শ্রেণীর লোক আইনের দৃষ্টিতে সমান অধিকার পাবে। ইসলামের বিধানে কোনো স্বজনপ্রীতি থাকবে না। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘উচ্চ বংশ, নিচু বংশ, প্রভাবশালী ও প্রভাবহীন সবাই আল্লাহর আইনের চোখে সমান।’
অর্থনৈতিক অধিকার: ইসলামে নারী-পুরুষ উভয়ের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা লাভের অধিকার রয়েছে। স্বামী যা উপার্জন করবে তা তার অধিকারে থাকবে আর স্ত্রী যা উপার্জন করবে তা তার অধিকারে থাকবে। স্ত্রীর অনুমতি ব্যতীত স্বামী স্ত্রীর উপার্জিত সম্পদ ইচ্ছামতো খরচ করতে পারবে না। এ মর্মে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘পুরুষ যা যা উপার্জন করে তা তার প্রাপ্য অংশ আর নারী যা উপার্জন করে, তা তার প্রাপ্য অংশ।’ (সূরা আন-নিসা, আয়াত-৩২)
হালাল উপার্জনের অধিকার: ইসলাম মানুষকে প্রাত্যহিক জীবনে দৈনন্দিন আয়-উপার্জন করে সৎ ও বৈধভাবে হালাল পথে জীবিকা নির্বাহের নির্দেশনা প্রদান করেছে। ইসলামি বিধানমতে জনগণ সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি প্রভৃতি হারাম উপার্জন থেকে বিরত থাকবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা পবিত্র ও উত্তম বস্তু আহার করো, যা আমি তোমাদের জীবিকারূপে দিয়েছি।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-১৭২)
এতিম-অসহায়দের অধিকার: ইসলাম সমাজে ধনবানদের সম্পদে এতিম, মিসকিন, হতদরিদ্র, দুস্থ-অসহায়দের অধিকার নিশ্চিত করেছে। যদি ধনীরা গরিবদের প্রাপ্য না দেয় তাহলে রাষ্ট্র বাধ্যতামূলকভাবে তা ধনীদের কাছ থেকে আদায় করে গরিবদের দিয়ে দেবে। পবিত্র কোরআনে ঘোষিত হয়েছে, ‘তোমাদের ধন-সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে।’ (সূরা আল-যারিআত, আয়াত-১৯)
এমনিভাবে ইসলামে সর্বজনীন মানবাধিকার সংরক্ষণ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের পরিপূর্ণ ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও কলাম লেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.