ভারত-মমতার জমি রক্ষার আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে by পার্থ চট্টোপাধ্যায়

মতার জমি অধিগ্রহণ বিরোধিতার রাজনীতি বিভিন্ন রাজ্যের বিরোধীরা লুফে নিয়েছে_ উত্তর প্রদেশে তার শুরু। হয়তো এই জমি আন্দোলনের ধাক্কায় পশ্চিমবঙ্গের মতো উত্তর প্রদেশেও মায়াবতী সরকারের ভরাডুবি হতে পারে। আর এক বছরও দেরি নেই সেখানকার নির্বাচনের।


রাহুল গান্ধী যদি কংগ্রেসকে জেতাতে পারেন তাহলে আগামী প্রধানমন্ত্রিত্বের টেস্ট পরীক্ষায় তিনি স্টার পেয়ে পাস করে যাবেন এবারের লেখাটা লিখছি দিলি্ল থেকে। নানা কাজের সূত্রে মাঝে মধ্যে আমাকে দিলি্ল আসতে হয়। আমি যখন কলেজে পড়ি তখন একটি ছাত্র সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য ১৯৫৬ সালে প্রথম দিলি্ল আসি। যাযাবরের দৃষ্টিপাত পড়ে দিলি্ল শহরটির প্রতি আমি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। সে সময় দিলি্ল এত ঘিঞ্জি হয়ে ওঠেনি। শহরটিকে মনে হতো গাছপালায় ঘেরা একটি বড়সড় গ্রাম। তখন স্টেশনে পা দিলেই টাঙ্গাওয়ালারা ছেঁকে ধরত। দিলি্ল কেন, বিহার, উত্তর প্রদেশের যে কোনো শহরে আসুন না কেন, টাঙ্গা আর এক্কাগাড়ি ছিল প্রধান আকর্ষণ। এখন আর ভারতের কোনো শহরে ঘোড়ার গাড়ি খুঁজে পাওয়া যাবে না। তার বদলে অটোরিকশা আর ট্যাক্সি। তবে মুম্বাই, কলকাতার মতো দিলি্লতে রাস্তায় যত্রতত্র মিটার ট্যাক্সি পাওয়া যায় না। ট্যাক্সি চাইলে বুথে ফোন করতে হয়, গন্তব্য অনুযায়ী অথবা ঘণ্টা অনুসারে চার্জ করে তারা। তবে স্টেশনে প্রিপেইড ট্যাক্সি পাওয়া যায়।
দিলি্ল এখন গায়ে-গতরে এমন বেড়ে গিয়েছে যে দিলি্ল পৌরসভা এলাকায় নতুন নতুন অফিস আর জায়গা পাচ্ছে না। তারা চলে যাচ্ছে দিলি্লর দক্ষিণে লাগোয়া শহর গুরগাঁও অথবা দিলি্লর পূর্বের লাগোয়া শহর নয়দায়।
এ দুটিই কিন্তু দুটি আলাদা রাজ্যের শহর। নয়দা উত্তর প্রদেশের মধ্যে পড়ে আর গুরগাঁও হরিয়ানায়। এ দুটি শহরও লোকসংখ্যার চাপ সহ্য করতে না পেরে কৃষিজমি আর অরণ্য গ্রাস করে নতুন নতুন আবাসন এলাকা আর মাল্টিপ্লেক্স তৈরি করে চলেছে। কমনওয়েলথ গেমসের কল্যাণে এই দুটি উপ-নগরীতেই এখন মেট্রো পেঁৗছে গেছে। নিউ দিলি্ল স্টেশন থেকেই আপনি মেট্রোয় উঠে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে গুরগাঁওয়ের হুদা সিটি সেন্টারে পেঁৗছে যেতে পারেন। পথে কুতুব মিনার স্টেশন পড়বে। পূর্বে নয়দার ১৮নং সেক্টর হয়ে নয়দা সিটি সেন্টার পর্যন্ত যেতে পারেন। এ ছাড়া উত্তর জাহাঙ্গীরপুরী, পশ্চিমের দ্বারকা দিলি্ল মেট্রো দিলি্লর অনেকটাই কভার করছে। দিলি্লর আশপাশের শহরগুলোর মধ্যে গুরগাঁও লাখপতি ও কোটিপতিদের শহর হলেও রাস্তাঘাটের অবস্থা খুবই খারাপ। কোটিপতি অবশ্য এখন দিলি্লর সব ফ্ল্যাটের মালিকই। দিলি্লতে কোটির নিচে কোনো ভালো ফ্ল্যাট নেই। আমার ছেলেই দু'বছর আগে গুরগাঁওয়ে ১২০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট কিনেছে ৬২ লাখ টাকায়। এখন শুনছি সেটাই কোটিতে পেঁৗছেছে। দিলি্লতে চাকরি নিয়ে এখন যেসব মধ্যবিত্ত যুবক-যুবতী আসছেন, তারা হয় পেয়িং গেস্ট হয়ে দিলি্লর কোথাও থাকছেন, না হয় নয়ডা কিংবা আরও দূরে ফরিদাবাদ বা গাজিয়াবাদ থেকে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করছেন। দিলি্ল বা দিলি্লর কাছাকাছি যে কোনো শহরই বলুন, জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া। আগে দিলি্লতে চাল, মাছ, গোশত কলকাতার চেয়ে সস্তা ছিল। এখন দেখছি কলকাতাই ভারতের সবচেয়ে সস্তা শহর। দিলি্লতে রাস্তার ধারে ভাঁড়ে চা খেতে গেলে এক ক্ষুদে ভাঁড় চা পাঁচ টাকা। কলকাতায় দুই থেকে তিন টাকা। দিলি্লতে এক পাতা জেরক্স করতে নেয় এক টাকা, কলকাতায় এর অর্ধেক।
সম্প্রতি নয়দায় কয়েক হাজার গৃহহীন মধ্যবিত্ত বিক্ষোভ করছেন। নয়দা ডেভেলপমেন্ট অথরিটি মধ্যবিত্তদের ফ্ল্যাট বানিয়ে দেবে বলে টাকা নিয়েছিল। অনেক জায়গায় কাজও শুরু হয়ে গেছে। ফ্ল্যাট প্রার্থীরা দশ শতাংশ টাকা দিয়ে (তা ধরুন দু'তিন লাখ টাকা) ফ্ল্যাট বুক করেছেন। কৃষিজমি সরকার অধিকার করে আবাসন করছিল।
এভাবেই নয়দার বিশাল বিশাল আবাসন এলাকা গড়ে উঠেছে। সবই ছিল কৃষিজমি। হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা ঠুকে দিয়েছেন কেউ। হাইকোর্ট রায় দিয়ে বসেছেন, ওই আবাসন প্রকল্প বাতিল করে কৃষকদের সব জমি ফেরত দিতে হবে। ডেভেলপমেন্ট অথরিটি ও ফ্ল্যাটের ক্রেতাদের মাথায় হাত। তারা সর্বস্ব দিয়ে ফ্ল্যাট বুক করেছিলেন, এখন কী হবে? এদিকে কৃষকরাও আন্দোলনে নেমেছেন। নতুন নিয়ম অনুসারে চাষের জমি উন্নয়নের জন্য সরকার অধিগ্রহণ করলে ন্যস্ত জমির ১০ শতাংশ কৃষককে অন্যত্র কোথাও দিতে হবে। আর জমির দাম দিতে হবে বাজারদর অনুসারে। আগে সরকার জলের দরে জমি কিনে সেই জমি নিলাম করে বিক্রি করে প্রচুর মুনাফা করত। কিছুদিন আগে উত্তর প্রদেশে মহাসড়ক তৈরির জন্য চাষের জমি অধিকার করে রাজ্য সরকার। চাষিরা আন্দোলন করেন ন্যায্য দামের জন্য। ওই আন্দোলনে কৃষকরা মারমুখী হয়ে পুলিশকে মারধর করেন। তখন পুলিশ গুলি চালায়। মৃত্যু হয় কিছু কৃষকের। যেহেতু ২০১২ সালে উত্তর প্রদেশে নির্বাচন; এই কৃষক আন্দোলনকে রাজনৈতিক কাজে লাগায় কংগ্রেস। স্বয়ং রাহুল গান্ধী উত্তর প্রদেশে গিয়ে কৃষকদের পাশে দাঁড়ান।
পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই প্রথম সরকারের জমি অধিগ্রহণ নীতির বিরোধিতা করে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে আন্দোলন শুরু করেন। নন্দীগ্রামে অবশ্য সরকার জমি অধিগ্রহণ করতে পারেনি। কিন্তু টাটার ন্যানো কারখানা গড়ার জন্য তৎকালীন সিপিএম সরকার একটি গোপন চুক্তি করে কৃষকদের কাছ থেকে কয়েক হাজার একর দোফসলা জমি কেড়ে নিয়ে টাটাদের দিয়ে দেয়। টাটারা সেখানে কারখানার শেড তৈরি করেও ফেলেছিল। কিন্তু মমতার আন্দোলনের চাপে কারখানা অসমাপ্ত রেখে ন্যানো প্রকল্প গুজরাটে নিয়ে যাওয়া হয়। গুজরাট থেকে টাটার দিয়াশলাই বাক্সের মতো ন্যানো ছোট গাড়ি এখন বাজারে বেরিয়ে গেছে। প্রায় দেড় লাখ টাকার মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে এই গাড়ি। কিন্তু তেমন চাহিদা হয়নি। কেননা ন্যানো গাড়ি এত ছোট যে কোনো রকমে চালক ছাড়া তিনজন বসতে পারে, কিন্তু বেশি মালপত্র নেওয়ার জায়গা নেই। আর লাখখানেক খরচ করলে স্ট্যান্ডার্ড গাড়ি পাওয়া যায়। দ্বিতীয়ত, পেট্রোলের দাম বাড়তে বাড়তে ৬৫ টাকা লিটারে পেঁৗছেছে। সে জন্য ভারতে পেট্রোল গাড়ির চাহিদা হঠাৎ কমে গেছে। এখন সবাই ডিজেলের গাড়ি চাইছে, কিন্তু চাহিদামতো ডিজেল গাড়ি তৈরির পরিকাঠামো নেই। এদিকে কলকাতায় ট্যাক্সি ভাড়া বাড়ানোর দাবিতে একদিন ট্যাক্সি ধর্মঘট হয়ে গেল। মমতা সরকার কিছুতেই ট্রাম, বাস বা ট্যাক্সি ভাড়া বাড়াতে রাজি নয়। মমতার জমি আন্দোলনের রাজনীতি মুহূর্তের মধ্যে সারা ভারত গ্রহণ করেছে। মমতা প্রকাশ্য জনসভায় বলে দিয়েছেন, তার রাজ্যে কৃষকের সম্মতি ছাড়া সরকার কোনো জমি নেবে না। সারাদেশে কৃষকরা এখন সরকারি জমি অধিগ্রহণের বিরোধিতা করছেন। তারা চান বাজারদর এবং সেটা তাদের মনঃপূত হলে তবেই তারা জমি দেবেন। ফলে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বড় বড় শিল্প ও উন্নয়ন প্রকল্প আটকে গেছে।
ক্ষমতায় এসে মমতা পশ্চিমবঙ্গের জন্য একটি আইন পাস করিয়ে নিয়েছেন। ওই আইন মোতাবেক সিঙ্গুরে যেসব চাষি জমি দিতে রাজি ছিলেন না, এ জন্য কোনো ক্ষতিপূরণ নেননি (এমন জমি এক হাজার একর), সেসব চাষির জমি সরকার ফেরত দেবে। এ ছাড়া ওই আইনে টাটারা যে পরিমাণ জমির ওপর কারখানা বানিয়েছে, সেই জমিও সরকার টাটাদের কাছ থেকে নিয়ে নিল। ওই জমিতে আর চাষ হবে না। কারণ সেখানে বড় শেড উঠে গেছে। চাষিরাও জমির দাম পেয়ে গেছেন। ওই শেড নিয়ে মমতা কি অন্য কারখানা তৈরি করবেন? এসব কথা কিছুই তিনি বলেননি। কিন্তু টাটারা ইতিমধ্যে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে মামলা ঠুকে দিয়েছে নতুন আইনের বিরুদ্ধে। তারা বলছে, মমতার ওই আইন অবৈধ। কারণ তারা স্বেচ্ছায় কারখানা ছেড়ে চলে যাননি। শুধু মমতার আন্দোলনের জন্য কাজ স্থগিত রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন। এই সওয়াল-জবাব শেষ হয়ে শেষ পর্যন্ত কার জয় হবে_ মমতার, না টাটার, তা এখন বলা মুশকিল।
তবে মমতার জমি অধিগ্রহণ বিরোধিতার রাজনীতি বিভিন্ন রাজ্যের বিরোধীরা লুফে নিয়েছে_ উত্তর প্রদেশে তার শুরু। হয়তো এই জমি আন্দোলনের ধাক্কায় পশ্চিমবঙ্গের মতো উত্তর প্রদেশেও মায়াবতী সরকারের ভরাডুবি হতে পারে। আর এক বছরও দেরি নেই সেখানকার নির্বাচনের। কংগ্রেসের কাছে উত্তর প্রদেশ মস্তবড় চ্যালেঞ্জ। রাহুল গান্ধী যদি কংগ্রেসকে জেতাতে পারেন তাহলে আগামী প্রধানমন্ত্রিত্বের টেস্ট পরীক্ষায় তিনি স্টার পেয়ে পাস করে যাবেন।
কাজের সময় কাজী
বাংলায় একটা প্রবাদ আছে_ কাজের সময় কাজী, কাজ ফুরোলে পাজি। রাজনীতিতে কাজীদের এমন পরিণাম সর্বত্রই হয়ে থাকে। ভারতের একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ দিই।
কিছুকাল আগে পর্যন্তও অমর সিং উত্তর প্রদেশের সমাজবাদী পার্টির নেতা মুলায়ম সিং যাদবের ডান হাত ছিলেন। মুলায়ম তাকে পার্টির সম্পাদক করেছিলেন। দিলি্লর রাজনীতিতে মুলায়মকে সবাই সমীহ করে চলতেন। সব দলের সঙ্গে তার দারুণ কন্ট্যাক্ট। ছয়কে নয় করতে পারেন, নয়কে ছয়; যাকে বলে তিনি হয়ে উঠেছিলেন রাজনীতির পয়লা নম্বর ঘোড়া বিক্রেতা। তা ছাড়া বলিউডের তারকাদের মধ্যে তার প্রচণ্ড প্রভাব ছিল। অমিতাভ বচ্চন যখন ব্যবসায় দেউলিয়া হতে বসেছিলেন তখন অমর তাকে টাকা ধার দিয়ে বাঁচিয়েছিলেন। ২০০৮ সালে মার্কিন পরমাণু চুক্তির প্রশ্নে ড. মনমোহন সিংয়ের প্রথম ইউপিএ সরকার পড়ো পড়ো, কারণ সিপিএম তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করেছে। সে সময় সমাজবাদী দলের সমর্থনে ইউপিএ সরকার সেবারের মতো রক্ষা পায়। ওই সময় বিজেপি কয়েক কোটি টাকার নোটের তোড়া সংসদের মধ্যে স্পিকারকে দেখিয়ে অভিযোগ করেন, কংগ্রেস এই টাকা তিন বিজেপি সদস্যকে দিয়েছিল তাদের ভোট পাওয়ার জন্য। কংগ্রেস অস্বীকার করে তারা কাউকে টাকা অফার করেনি বলে। স্পিকার সেই সময় পুলিশি তদন্তের নির্দেশ দেন।
দীর্ঘ তিন বছর পর দিলি্ল পুলিশ তদন্ত করতে গিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছে, ওই তিন কোটি টাকা অমর সিং তার এক চেলাকে দিয়ে নাকি বিজেপি সাংসদদের কাছে ঘুষ হিসেবে পাঠিয়েছিলেন।
অমর সিং এখন আর মুলায়মের সঙ্গে নেই। সমাজবাদী পার্টি তাকে বহিষ্কার করেছে। তবে তিনি এখনও রাজ্যসভার সাংসদ আছেন। অমর সিং সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। বলেছেন, তার যে চেলার মাধ্যমে টাকা ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে, ওই চেলাকে তিনি চেনেনই না। পুলিশ অবশ্য বলছে, তিনি যে অমরের লোক তার প্রমাণ পুলিশের হাতে আছে।
বেচারা অমরের পাশে এখন মুলায়ম সিং ছাড়া কংগ্রেস নেই। সংসদে সব কংগ্রেস সদস্য মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন। ইউপিএর পুলিশের জেরাতেই অমর জেরবার হচ্ছেন। যে সরকারকে রক্ষা করতে গিয়েছিলেন, সেই সরকারই এখন ঘুষ-কাণ্ডে অমরকে হয়রান করছে। যদি প্রমাণিত হয় অমর এই ঘুষ-কাণ্ডে জড়িত ছিলেন, তাহলে তার জেল হতে পারে। টাকা নিয়ে নরসিমা রাও সরকারকে রক্ষা করতে গিয়ে একদা ঝাড়খণ্ড নেতা শিবু সোরেনকে জেলে যেতে হয়েছিল।

ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায় : পশ্চিমবঙ্গের সাংবাদিক
 

No comments

Powered by Blogger.