অল্পকথার গল্প-ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয় by আলী হাবিব

বিদের নিয়ে খুব বিপদ। একেকজন একেক রকমের কথা বলেন। এক কবির আক্ষেপ, আমাদের দেশে এমন ছেলে নেই, যে 'কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে'। কাজে বড় না হলেও অকাজে দড় অনেককেই আমরা আজকাল দেখতে পাই। কথায় বড়, এমন লোকের তো আকাল নেই। এক কবি লিখলেন, 'বড় যদি হতে চাও ছোট হও তবে।' হলাম। কিন্তু সেখানেও ঘোর আশঙ্কা। একেকজন আবার বেশি বড় হতে নিষেধ করেছেন। কেন? বেশি বড় হলে নাকি ঝড়ে


ভেঙে পড়তে হবে? তাহলে কি ছোট হব? বেশি ছোট হলেও ঝামেলা। ছাগলে মুড়ে খাওয়ার ভয় থেকে যায়। তাহলে কী হব? মাঝারি মানের? মাঝারি মানের হলে তো আবার সারা জীবন ঘেঁষটে ঘেঁষটে চলতে হয়। তাহলে হব কী? যাব কোথায়? চলব কী করে?
চলার কথা যখন এল, তখন একটি জোক শেয়ার করা যাক। আজকাল শেয়ারবাজারে যাওয়া যায় না। কেবলই পতন। দরপতনের এই ধারা অব্যাহত থাকলে পতনটা শেষ পর্যন্ত কোনদিক দিয়ে নেমে যাবে, কে জানে? সেখানে নাকি আস্থার সংকট। প্রণোদনা কাজে আসছে না। কোনো টোটকাই চাঙ্গা করতে পারছে না শেয়ারবাজারকে। সব ধরনের সালসা-মালসা ভোগে গেছে। শেয়ারবাজারের কথাই বা বলি কেন, পাড়ার কাঁচাবাজারেও কি যাওয়ার জো আছে? কোনটা কিনবেন? হাত দিতে গেলেই আগুনের আঁচ পাওয়া যায়। সে আগুনে পুড়ে খাক মধ্যবিত্ত জীবন। কারোই যেন কিছু করার নেই। সবাই যেন অসহায়, আত্মসমর্পণ করে বসে আছে। কথা ও কাজের মধ্যে বিস্তর ফারাক। জোকটি এখন বলা যাক। ক্লিনটন আমলের জোক। প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন আর প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ক্লিনটনের মধ্যে ফারাক কী, সেটা বোঝাতে গিয়েই বোধ হয় এই কৌতুকটির সৃষ্টি। প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ক্লিনটন মধ্যবিত্তের ট্যাঙ্ কমাতে চেয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন ট্যাঙ্ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ক্লিনটন বুশের নীতির বিপক্ষে ছিলেন। প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন বুশের রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে ব্যস্ত ছিলেন। এভাবে জনগণের চাওয়ার সঙ্গে পাওয়ার মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তখন ওই কবির ভাষায় 'যাহা পাই তাহা চাই না' জাতীয় একটা অবস্থার মধ্যে পড়তে হয় জনগণকে। তবে আমাদের চাওয়া 'স্বাধীনতা' কিন্তু মোটেও 'ভুল করে' চাওয়া ছিল না। সে কারণেই সেটা পেতে গিয়ে জীবন দিতেও কুণ্ঠা বোধ করেনি বাঙালি।
আমরা অনেক কিছু চাইনি। পেয়ে গেছি। অনেক কিছু চেপে বসেছে আমাদের জীবনে। না চাইতেই যেমন অনেকের নানা অসুখ-বিসুখ ভর করে, তেমনি না চাইতে নানা বিপত্তি। ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের মাস। একাত্তরে আজকের এই দিনে আমাদের অপেক্ষা ছিল বিজয়ের। আজ বিজয় ধরে রাখাটাই যেন আমাদের জন্য একটা বড় পরীক্ষা হয়ে দেখা দিয়েছে। 'দ্য ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সি' গল্পটি অনেকেরই মনে থাকার কথা। সেই এক বুড়ো সান্তিয়াগো। প্রতিদিন নৌকা নিয়ে সাগরে যান মাছ ধরতে। মাছ আর পান না। দিনের পর দিন বুড়ো জেলে ছিপ ফেলে অপেক্ষায় থাকেন। মাছ আর ধরা পড়ে না। অন্য জেলেরা হাসাহাসি করে বুড়োকে নিয়ে। বুড়ো ওসব গায়েও মাখেন না। তিনি জানেন, এক দিন বড় মাছ তার টোপ গিলবেই। বুড়োকে সাহস জোগায় এক কিশোর। এই বুড়োই তাকে মাছ ধরতে সাগরে যাওয়া শিখিয়েছে। এক দিন বুড়ো টোপ গেঁথে ছিপ ফেলেন। একটা বড় মাছ ঠিকই টোপ গেলে। কিন্তু বুড়ো সান্তিয়াগোর মাছে ভাগ বসায় একদল হাঙর। হাঙররা চারদিক থেকে মাছটাকে খুবলে খেতে থাকে। একদিকে মাছ তোলার যুদ্ধ, অন্যদিকে হাঙরগুলোর হাত থেকে মাছটিকে রক্ষার যুদ্ধ_এক সময় ক্লান্ত হয়ে পড়েন বুড়ো সান্তিয়াগো। মাছটিকে একসময় নৌকায় তুলতে পারেন বুুড়ো। কিন্তু ততক্ষণে মাছ আর মাছ নেই। নৌকায় উঠে আসে মাছের কঙ্কাল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার চার দশকে আমরা কী দেখছি? আমাদের স্বাধীনতায় দাঁত বসাতে চেয়েছে অনেক হাঙর। সেই হাঙরদের হাত থেকে স্বাধীনতা রক্ষার চেষ্টা তো এখনো চলছে। বুড়ো সান্তিয়াগো রোজ সাগর থেকে ফিরে ক্লান্ত হয়ে ঘুমোতে যেতেন। ঘুমের ভেতর একটি স্বপ্ন দেখতেন বুড়ো সান্তিয়াগো। একটা সিংহের সঙ্গে যুদ্ধের স্বপ্ন। বুড়ো সান্তিয়াগো স্বপ্ন দেখতেন ঘুমিয়ে। স্বাধীন বাংলাদেশের অবস্থা এখন অনেকটা সেই বুড়ো সান্তিয়াগোর মতো। স্বাধীনতা পেয়েছি আমরা। স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার সুফল ঘরে তুলতে পারিনি। সেই সুফল চলে গেছে অন্যের ঘরে। এ ব্যর্থতা স্বীকার না করে উপায় কী?
অথচ আমাদের রাজনীতি আছে। রাজনৈতিক দল আছে। রাজনীতি নাকি জনগণের মঙ্গল করে। জনগণের মঙ্গলের জন্যই যদি রাজনীতি, তাহলে তাদের মুখ দেখাদেখি বন্ধ কেন? শুধু মুখ দেখাদেখি বন্ধ নয়, এক দল যেন আরেক দলের কাছে নাজায়েজ। এক দল পশ্চিমে হাঁটলে আরেক দল হাঁটে পূর্ব দিকে। ঘোর উত্তরমুখী যেমন আছে, তেমনি ঘোরতর দক্ষিণমুখীও পাওয়া যাবে। কেন এমন হবে? সবারই তো চাওয়া জনগণের কল্যাণ। মাঝখানে কে এসে এই মুখ দেখাদেখি বন্ধ করে দিল? সবার চাওয়া যেহেতু জনগণের মঙ্গল, তাহলে তাদের একযোগে কাজ করতে বাধা কোথায়? ইগো সমস্যা একটা বড় সমস্যা হতে পারে। কয়েকটা উদাহরণ তুলে ধরা যাক। আমাদের সমস্যা তেল-গ্যাস-পানি। আমাদের সমস্যা বিদ্যুৎ। তিস্তার পানির বণ্টন নিয়ে কথা হলো না। ট্রানজিট না ট্রানশিপমেন্ট_কী হবে তা-ই নিয়ে আমরা দোটানায় আছি। বাংলাদেশের জন্য ক্ষতির কারণ হয় টিপাইমুখে এমন কিছু করতে দিতে নারাজ আমরা। কিন্তু এসব ইস্যুতে আমরা এক হতে পারি না। যার যার অবস্থানে থেকে আমরা আমাদের কথা বলি। একে অন্যকে দোষারোপ করি। এক হই না।
আবার একটা গল্প শেয়ার করি। এক ছিল জামাই। সে চুপচাপ ধরনের মানুষ। বেশি কথা বলা বা হাসিঠাট্টা ছিল তার অপছন্দ। কিন্তু তার শ্বশুর সাহেব এতে নাখোশ। যাদের সঙ্গে ঠাট্টার সম্পর্ক, সব জামাই শ্বশুরবাড়িতে এসে তাদের সঙ্গে ঠাট্টা-ইয়ার্কি করে। অথচ এই বেচারা চুপ করে থাকে, কেউ একটু ঠাট্টা করলে চোখ পাকিয়ে তাকায়। কি করা, শ্বশুর সাহেব জামাইয়ের বাবার কাছে গিয়ে সব বললে ছেলের বাবা ছেলেকে তিরস্কার করলেন। বললেন এবার থেকে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে ঠাট্টা-ইয়ার্কি করতে। তো জামাই বেচারা চুপচাপ থাকলেও একটু স্মার্ট ছিল। শ্বশুরের এহেন আচরণে খুবই বিরক্ত জামাই আবার শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে উঠতেই এবার যেন অন্য রকম একটা ঠাট্টা করে বসল।
জামাই শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই শ্বশুর এসে কুশলাদি জানতে চাইলেন। জামাইও নিজের বাড়ির কথা জানাল। পাশাপাশি শ্বশুরকে জানাল, বাড়িতে তার বাবার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। যাকেই সামনে পাচ্ছেন, তার দিকেই লাঠি হাতে ছুটে যাচ্ছেন। শ্বশুর তো এই কথা শুনে জামাইকে সমবেদনা জানিয়ে বললেন, তিনি আজই দেখতে যাবেন। জামাই বলে দিল, যাওয়ার সময় শ্বশুর সাহেব যেন একটা শক্ত লাঠি নিয়ে যান। ওদিকে শ্বশুরকে এ কথা বলে জামাই তাড়াতাড়ি ফিরে এল নিজের বাড়িতে। বাড়িতে ফিরে যেতেই বাবা উদ্বেগের সঙ্গে জানতে চাইলেন ছেলের তড়িঘড়ি ফিরে আসার কারণ। ছেলে জানাল, শ্বশুরবাড়িতে তার শ্বশুর পাগল হয়ে গেছেন। যাকে সামনে পাচ্ছেন, তাকেই লাঠিপেটা করছেন। সে যাওয়ার পথে শুনেছে শ্বশুর একটা শক্ত লাঠি নিয়ে এ বাড়ির দিকে আসছে। ওদিকে দুই বেয়াই আবার পরস্পরের বন্ধু। ছেলের বাবা ভাবলেন, আমার তো যাওয়া উচিত। ছেলের পরামর্শে তিনি একটা শক্ত লাঠি হাতে বেয়াইবাড়ির পথ ধরলেন। অন্যদিকে তার বন্ধু বেয়াই তো আগেই রওনা হয়েছেন। মাঝপথে দুজনের দেখা হয়ে গেল। দুই বেয়াই পরস্পরকে লাঠি হাতে যেতে দেখে অনেকটা তেড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। শুরু হয়ে গেল লাঠালাঠি। গ্রামের মানুষজন ছুটে এসে অনেক কষ্টে থামালে দুই বেয়াই প্রায় রক্তারক্তির হাত থেকে বেঁচে যান। আমাদের রাজনীতিতে কি এমন কোনো জামাই ঢুকে গেছে?
কী হয়েছে, ঘরে কে ঢুকেছে, সেটা তো বুঝতেই হবে। কারণ ভেতর থেকে ঘুণ পোকার মতো কিছু একটা কাটছে। ভেঙে যাচ্ছে সমাজ। এই ভাঙন একদিন কোথায় নিয়ে যাবে দেশটাকে, কোন ধ্বংসের কিনারে_তা কেউ জানে না। না জানলেও তো আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কাজেই দেশের মঙ্গল করতে হবে। দেশের মঙ্গল মানেই দেশের মানুষের মঙ্গল। সেটা কেমন করে করা যায়? ইচ্ছে করলেই করা সম্ভব। একেবারে সাম্প্রতিক একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যেকোনো উপায়ে পদ্মা সেতু হবে। দেশি উদ্যোক্তারাও যদি এগিয়ে আসেন, তা হলেও পদ্মা সেতু হবে। আমাদের দেশে এমন উদ্যোক্তা আছেন। প্রয়োজন রাজনৈতিক মতৈক্যের। সেটা কি সম্ভব? কেন নয়? প্রয়োজন একটি ইচ্ছা। কথায় আছে, 'ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়'। রাজনৈতিক মতৈক্যের প্রয়োজনে সেই ইচ্ছাশক্তির প্রয়োগ করার সময় এখন।
একটা গল্প বলা যাক। অনেক আগের কথা। তা প্রায় বছর পঞ্চাশেক আগের কথা তো বটেই। ভদ্রলোক নিরক্ষর, কিন্তু জ্ঞানী। চমৎকার বাঁশি বাজাতেন। অন্যদিকে তাঁর 'সেন্স অব হিউমার' ছিল অসাধারণ। এই ভদ্রলোক একদিন মাঠের ধারে গাছের নিচে বসে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। পড়ন্ত বিকেল। দূর থেকে একজনকে আসতে দেখা গেল। দূরের সেই পথিক কাছে আসতেই দেখা গেল, তিনি বেশ ক্লান্ত। পথিককে তিনি পানি পান করালেন। তিনি কোথা থেকে আসছেন, জানতে চাইলেন। পথিক ছিলেন স্থানীয় থানার কর্মী। তিনি ওই ভদ্রলোকের কাছে জানতে চাইলেন, ওই রাস্তা দিয়ে থানায় যাওয়া যাবে কি না। ভদ্রলোক জবাব দিলেন, গেলেই যাওয়া যাবে। পথিক পুলিশের এ কথা শুনে মেজাজ ঠিক থাকার কথা নয়। তিনি রেগে গিয়ে বললেন, গেলেই যাওয়া যায়, এমন কথার অর্থ কী? ভদ্রলোক পথিকের মাথায় তাঁর টিনের তোরঙ্গ তুলে দিতে দিতে বললেন, রাস্তাটি থানার দিকেই গেছে। আপনি যদি যেতে চান তা হলে যেতে পারবেন। কিন্তু আপনার যদি যাওয়ার ইচ্ছা না থাকে বা আপনি যদি না যান, তাহলে তো যাওয়া যাবে না।
মূল কথা হচ্ছে এটাই। ইচ্ছা থাকলে তবেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব। অন্যথায় নয়। ইচ্ছা থাকলেই ঘুচিয়ে ফেলা যাবে সব দূরত্ব। অন্যদিকে দূরত্ব বজায় রেখে কেউ চলতে চাইলে কী আর করা যাবে?
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.