আন্তঃসীমান্ত সম্পদ-ভিন্ন বাস্তবতায় অভিন্ন নদী ব্যবস্থাপনা by শেখ রোকন

প্রশ্ন হচ্ছে, অভিন্ন নদীতে অভিন্ন ব্যবস্থাপনার এই যে সোনালি তত্ত্ব, তা বাংলাদেশ ও ভারতের ক্ষেত্রে কতটা প্রয়োগযোগ্য। ব্যাংককের হোটেল উইন্ডশোর স্যুইটসের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মিলনায়তনে দু'দেশের জনা পঁচিশেক সাংবাদিক ও রিসোর্স পার্সনের মধ্যে আধা-ঘরোয়া আলোচনায় এ প্রশ্নটিই দিনভর অদৃশ্য বুদ্বুদ হয়ে উড়ে বেড়িয়েছে
ঢাকা নয়, দিলি্ল নয়; বাংলাদেশ ও ভারতের অভিন্ন নদী সংক্রান্ত একদিনের সংলাপের জন্য দু'দেশের সাংবাদিকদের


কেন ব্যাংকক ছুটতে হয়_ এ প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই আন্তঃসীমান্ত পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার ভূত-ভবিষ্যৎ অনেকখানি স্পষ্ট। কারণটা কী, তা আয়োজক প্রতিষ্ঠান আইইউসিএনের (ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার) কর্মকর্তাদের ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন, অফিসিয়ালি 'বন্ধুরাষ্ট্র' হলেও বাংলাদেশ ও ভারতে অপর দেশের নাগরিকদের ভিসাপ্রাপ্তি সহজ নয়। পর্যটন ও চিকিৎসা ভিসা; বিশ্বের অনেক দেশই যাদের পয়মন্ত লক্ষ্মী মেনে সাদরে ডেকে নেয়, সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার দুই ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশীর ক্ষেত্রে তাতেও ঝামেলার অন্ত নেই। সম্মেলন, কর্মশালা, শিক্ষা কিংবা সংলাপের মতো আয়োজনের ক্ষেত্রে তো দূতাবাস থেকে যতভাবে সম্ভব নিরুৎসাহিত করা হয়। সবচেয়ে কঠিন সম্ভবত সাংবাদিকের জন্য ভিসা। ভিসার জন্য ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনে যারা গেছেন, তাদের কাছে মনে হতে পারে এ চিত্র বোধহয় একপক্ষীয়। কিন্তু সীমান্তের ওপাশের লোকজনের সঙ্গে কথা বললে মুদ্রার অপর পিঠটি সম্পর্কেও জানা যাবে।
অথচ আনুষ্ঠানিকভাবে বারবারই বলা হয়ে থাকে 'পিপলস টু পিপলস' যোগাযোগই পারে রাষ্ট্রের অদৃশ্য দূরত্ব কমিয়ে আনতে। আর এক দেশের মানুষের বার্তা অপর দেশের কাছে পেঁৗছে দিতে সংবাদমাধ্যমকর্মীদের চেয়ে উপযুক্ত আর কে হতে পারে? এসব ক্যারিক্যাচারে জেরবার হতে হতে বারবারই এ প্রশ্ন মনে হয়েছে যে প্রাযুক্তিক উৎকর্ষতার এই যুগে কোনো পরিস্থিতি আড়াল করার চেষ্টা কতটা কাজে দেয়? কিন্তু দু'দেশের মধ্যে নানা ইস্যুতে মেলবন্ধনে উদ্যোগী আয়োজকদের আকাশ-পাতাল ভাবার সময় কই। ফলে দু'দেশের মধ্যে বেসরকারি পর্যায়ে, কূটনৈতিক ভাষায় ট্র্যাক টু বা ট্র্যাক থ্রি আলোচনার জন্য কাছের বিকল্প কাঠমান্ডু বা ব্যাংকক ছাড়া গতি কী?
দু'দেশের বন্ধুত্বের প্রলেপের নিচে কতখানি অবিশ্বাসের ফাটল, ভিসা সংক্রান্ত এসব বিড়ম্বনা তার সূচকমাত্র। আর প্রকৃতি আমাদের শিক্ষা দিয়েছে, গভীরে ফাটল রেখে ভূপৃষ্ঠে ভারী ইমারত নির্মাণ আখেরে ভূমিকম্পই ডেকে আনে। যেখানে অকৃত্রিক ভূগোলের ওপর আঁকা কৃত্রিম রাজনৈতিক সীমারেখা বেশি প্রভাবশালী, যেখানে সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্তি্বকভাবে অভিন্ন জনগোষ্ঠীর চলাচল এখনও 'বিচ্ছিন্নতাবাদী' আইনের দ্বারা সীমাবদ্ধ; সেখানে আন্তঃসীমান্ত পানি ব্যবস্থাপনার মতো সহযোগিতাঘনিষ্ঠ ব্যবস্থা কি আদতেই সম্ভব?
এটা ঠিক, সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হলে অভিন্ন নদীতে অভিন্ন ব্যবস্থাপনার দিকেই আমাদের হাঁটতে হবে। ভাগাভাগি নয়, বিশ্বজুড়ে এখন যৌথতারই জয়জয়কার। নদী বা পানির মতো বিচ্ছেদ-অসম্ভব সম্পদের ক্ষেত্রে তা উপরি উপযুক্ত। উৎস থেকে পতনস্থল পর্যন্ত নদীর যে ভিন্ন ভিন্ন উপযোগিতা এবং একটির সঙ্গে অপরটির যে যোগসূত্র, তার ওপর ভিত্তি করেই আন্তঃপ্রবাহের সর্বজনীন ও টেকসই ব্যবহারের এই 'নিউ প্যারাডাইম'। যেমন পদ্মা-মেঘনার ইলিশ সম্পদ। মূলগত দিক থেকে সামুদ্রিক এই মাছ যদিও ভাটির দিকে সুলভ, উজানে দূষণ কিংবা ভূমিক্ষয় বাড়লে ইলিশের বিচরণ ও প্রজনন স্বভাবতই ব্যাহত হবে। আবার আন্তঃসীমান্ত নৌচলাচলের ক্ষেত্রে যদি ভাটির দেশ সম্মতি না দেয়, উজানের নৌযান সাগরে যেতে পারবে না।
অভিন্ন ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বলা হয়ে থাকে, যৌথ নদীর পানি বণ্টনই শেষ কথা নয়। অববাহিকার দেশগুলো যার যার প্রয়োজনমতো পানি তুলে নিলেই হবে না। নদীর স্বাস্থ্যের দিকে নজর রাখতে হবে। পানি উত্তোলন ছাড়াও নদীর যে অন্যান্য ব্যবহার রয়েছে; যেমন নৌচলাচল, মৎস্যসম্পদ, জীববৈচিত্র্য, বন্যা ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি ব্যাহত করা যাবে না। বড় কথা, কেবল সুবিধা ভাগাভাগি করলে চলবে না। অসুবিধারও ভাগ নিতে হবে। নদী ব্যবহার বা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যেসব সংকট সৃষ্টি হবে, সব পক্ষ মিলে তার দায় নিতে হবে। উজানে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে একটি দেশ আলোকিত হবে, আর তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া ভোগ করবে ভাটির দেশ, তা হবে না। অভিন্ন নদী থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের ভাগ যেমন দিতে হবে, ভাটিতে সৃষ্ট ক্ষতির দায়ও নিতে হবে। আবার নদী যাতে বিগড়ে না যায়, নদী যাতে দুর্বল হয়ে না পড়ে; সে জন্য রক্ষণাবেক্ষণের কাজটিও করতে হবে যৌথভাবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, অভিন্ন নদীতে অভিন্ন ব্যবস্থাপনার এই যে সোনালি তত্ত্ব, তা বাংলাদেশ ও ভারতের ক্ষেত্রে কতটা প্রয়োগযোগ্য। ব্যাংককের হোটেল উইন্ডশোর স্যুইটসের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মিলনায়তনে দু'দেশের জনা পঁচিশেক সাংবাদিক ও রিসোর্স পার্সনের মধ্যে আধা-ঘরোয়া আলোচনায় এ প্রশ্নটিই দিনভর অদৃশ্য বুদ্বুদ হয়ে উড়ে বেড়িয়েছে।
বস্তুত সংলাপটি অনুষ্ঠিতই হয়েছিল এমন সময়, যখন তিস্তা ও টিপাইমুখ নিয়ে নানা গুঞ্জনে ঢাকা ও দিলি্লর আকাশ-বাতাস ভরা। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শেষ মুহূর্তের বাগড়ার মুখে বহুল প্রত্যাশিত তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি ভেস্তে গিয়েছিল। সে নিয়ে পরস্পরবিরোধী কথাবার্তার রেশ কাটতে না কাটতেই ফুটেছিল টিপাইমুখ বোমা। ভারতের পক্ষে বারবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশকে, না জানিয়ে টিপাইমুখে কিছু করা হবে না। কিন্তু প্রকল্পটির নির্মাণকাজের ব্যাপারে দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত দুটি সংস্থা ও মণিপুর রাজ্য সরকারের মধ্যে অনেকটা গোপনে যৌথ বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ওই উদ্যোগ স্বভাবতই সীমান্তের এপাশ থেকে বৃহৎ প্রতিবেশীটির সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ এবং দ্বিপক্ষীয় চুক্তি, আন্তর্জাতিক আইন ও রেওয়াজ লঙ্ঘনের নিকৃষ্ট নজির হিসেবে অনুবাদ হয়েছে। আবার সীমান্তের ওপাশে বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়াকে 'অহেতুক' বলা হয়েছে।
কেবল কি টিপাইমুখ ইস্যুতে বিপরীত মেরুতে অবস্থান? কেবল কি তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে পাঁচ দশকের আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার হতাশা? বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্বীকৃত ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র একটি, গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি সম্ভব হয়েছে। সে চুক্তি নিয়েও আগে এ দেশে, হালে সে দেশেও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। বাকি ৫৩টি নদীর পানি বণ্টনে এখন পর্যন্ত মতৈক্যেই পেঁৗছা গেল না। দু'দেশের মধ্যে নৌচলাচলের হাজার বছরের প্রাচীন রুট এবং চার দশকের পুরনো প্রটোকল রয়েছে; কিন্তু সেটা চালুই হলো না। অভিন্ন নদী সংক্রান্ত তথ্য আদান-প্রদানের যে অনুচ্ছেদ গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির মধ্যে রয়েছে, তার সুফল এখনও অধরা।
নদী অভিন্ন হলেও এগুলোর অধিকার ও ব্যবহারের প্রশ্নে সীমান্তের দুই পাশে স্পষ্টতই ভিন্ন বাস্তবতা। এ পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েও যৌথ ব্যবস্থাপনার কথা বলা নিঃসন্দেহে সর্বোচ্চ সদিচ্ছার লক্ষণ। ওই সংলাপে আশা প্রকাশ করা হয়েছে_ সরকারি পর্যায়ে যা-ই হোক, বেসরকারি পর্যায়ে যদি তথ্যের আদান-প্রদান, আলাপ-আলোচনা, সমাধান সন্ধান করা যায় অভিন্ন নদী ব্যবস্থাপনা হয়তো দূরের বাদ্য নয়। আমরা সে আশাই করতে পারি। কে না জানে, আশাই মানুষকে বেদনার বালুচরেও খেলাঘর বাঁধতে প্রেরণা জোগায়।

শেখ রোকন : সাংবাদিক ও গবেষক
skrokon@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.