সহজ-সরল-বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, সরকার ছুঁলে? by কনকচাঁপা

থায় আছে, বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা। আর সরকার ছুঁলে? ১১৮ ঘা! সরকারি লাল রিবনে যদি কিছু বাঁধা পড়ে তো এ জীবনে সেটা খোলার আর উপায় নেই। একজন সরকারি চাকরিজীবী যখন অবসরে যান এমনিতেই সেটা তাঁর জন্য কষ্টকর হয়। যেমন হতে পারে তখনো তাঁর ছেলের পড়া বাকি আছে বা মেয়েটাকে পাত্রস্থ করেননি। তবুও নিয়ম অনুযায়ী তাঁর পদ তাঁকে ছাড়তেই হয়।


কিন্তু সেটা একটা করুণতম সুরমালার সৃষ্টি হয়, যখন তিনি নিজে মৃত্যুবরণ করেন। আমি আমার জীবনে দেখা দুটি উপমা এখানে উদাহরণ হিসেবে টানতে চাই। দুই বছর হয়েছে আমি ও আমার জীবনসঙ্গী দুজনই তিন মাসের এদিক-ওদিক এতিম হয়েছি।
দুজনই বাবা হারিয়েছি। এতে আমরা যতটা না ভেঙে পড়েছি, তার চেয়ে আমার মা ও শাশুড়ির বিধবা হওয়ায় অদ্ভুত এক পরিস্থিতির সামনে পড়েছি। তাঁদের বৈধব্য যেন মানতেই পারছি না। তবু জীবন থেমে থাকে না। আমার মা একটু ধাতস্থ হওয়ার পর পেনশনের কাগজপত্র নিয়ে দৌড়াদৌড়ি। আমার ছোট খালা এজিবিতে চাকরি করেন, তিনি মায়ের সব কাগজপত্র নিয়ে ছোটাছুটি করছেন; তিনিই সেটা দেখছেন। প্যাঁচ লাগল শাশুড়ির কাগজপত্র নিয়ে। তিনি থাকেন উত্তরায়। পেনশনের এসব কাগজপত্র হালনাগাদ করতে পুরান ঢাকায় দৌড়াতে হবে। সইসাবুদ, ফরম পূরণ-ছবি_কত কিছু! সেখানে একটা ফরমে নমিনি যেন আর বিয়ে না করেন বা আর বিয়ে করেননি এমন হলফনামায় সই দিতে হবে। আমার শাশুড়ি রেগে আগুন! 'কও তো দেখি এমন লেখায় সই দিতে ইচ্ছা হয়?' বললাম, 'আম্মা, এটা তো একটা গৎ।' 'রাখ তোমার গৎ! একটা লোক অবসরে গেল ৫৭তে; তারপর সে মারা গেল ৯০ বছর বয়সে। আর আমি তার স্ত্রী, আমার বয়স ৮০। আমি আবার বিয়ে করব?' তাঁর কথা, অন্তত দু-তিন রকম ফরম থাকবে। সেই অনুযায়ী ফরম আনা হবে। বললাম, 'আম্মা ঠিক আছে, আপনি সই করেন। এটা দাপ্তরিক ব্যাপার। আপনি তাকাবেন না।' কিন্তু সব সইসাবুদ বাসায় থেকে করা যাবে না। অফিসে যেতে হবে। তাজ্জব! ৮০ বছরের একটা মানুষকে নিয়ে অফিস-আদালত করব কিভাবে? আমার শাশুড়ির সব ছেলেমেয়ে দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকেন। তাঁদের সই-ছবি এগুলো জোগাড় করা চাট্টিখানি কথা নয়। অথচ আমার শাশুড়ির পর আর কেউ এই পেনশনের দাবিদার হবেন না। তবে? এই নিয়ম কেন? অনেকে নাকি আছেন, মাকে পেনশনের টাকা না দিয়ে নিজেই তোলেন, ভোগ করেন বা পেনশনধারী মারা গেলেন দুই-চারজন স্ত্রী রেখে। উফ! এই দুই-চারজন ভুল চরিত্রের অধিকারী মানুষের জন্য সবার এত কষ্ট!
আমার মনে হয়, পেনশন তো আধাবৃদ্ধ মানুষই তোলেন।
তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রীর জন্য ব্যাপারটা আরো কষ্টদায়ক হয়ে পড়ে। সে ক্ষেত্রে চাকরিরত অবস্থায়ই কি একটা আইডি কার্ডের মতো করা যেতে পারে না, যা সরকারের তথ্যভাণ্ডারে থাকবে? তাঁর কোন স্ত্রী (দুটো থাকলে) পেনশন পাবেন তাঁর অবর্তমানে, তাঁর নাম, ঠিকুজি-নিকুজি_সব লেখা থাকবে তাতে। তিনি মারা গেলে সরকারই সে তথ্য থেকে একটা বই পাস করে তাঁর নমিনিকে দেবে! এটা করা কি খুবই অসুবিধা, না কি ভীষণ কঠিন কাজ? একজন বিধবা যখন স্বামী হারানোর ব্যথা-বেদনা সামলাতে পারছেন না, তখন তাঁর কাছে দুটো পয়সার জন্য এ অফিস-ও অফিসের দ্বারে দ্বারে ঘোরা কী যে কঠিন, তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ জানে না। আর পেনশন তো মানুষ চাকরির পয়লা পায় না, পায় শেষে!
একজন প্রায় ৬০ বছরের মানুষের পক্ষে পুরান ঢাকায় গিয়ে পেনশন আনা কি সোজা কথা? আর একটা কথা সরকার জানে কি না জানি না; তবে জনগণ সবাই জানে, পেনশনসংক্রান্ত অফিসের দেয়ালের প্রতিটি ইট, কলাপসিবল গেট অদৃশ্য হাত বাড়ায় কিছু পাওয়ার আশায়! এটাকে কি এটিএম কার্ডগুলোর মতো ঝকঝকে কোনো ফর্মুলায় আনা যায়_যাতে মাস শেষে অল্প কয়টা টাকাই হোক তা পাওয়া যেতে পারে স্মার্টলি?
এই আগুনগরম বাজারে অবসরে যাওয়া একটা ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। আর তিনি মারা যাওয়ার পর তাঁর স্ত্রীর পক্ষে অফিসের দ্বারে দ্বারে ঘোরা আরো ভয়ংকর। একজন সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীর স্ত্রী তো তাঁর স্বামীর জীবদ্দশায় ভদ্রস্থ জীবনই পার করেছেন। দুটো টাকার জন্য তাঁর ওই মানসিক অবস্থায় (সদ্য বিধবা হওয়ার অবস্থায়) এই কাগজ-কলমের হালনাগাদ করা থেকে অব্যাহতি দেওয়া কি খুবই কঠিন কাজ? দেশের মানুষ শেষ বয়সে এই আয়েশ বা সেবাটুকু যেকোনো সরকারের কাছ থেকে আশা করতেই পারেন। এতে ওই মৃত অবসরপ্রাপ্ত চাকুরের আত্মাকেও সম্মান জানানো সম্ভব।
তাই নয় কি?
লেখক : সংগীতশিল্পী

No comments

Powered by Blogger.