কৃষিপণ্য : দরদাম নিয়ন্ত্রণে খুবই সতর্কতা প্রয়োজন by ড. শামসুল আলম

মন ফসল কাটার মৌসুম শুরু হয়েছে। শুরু থেকেই খবর বেরিয়েছে_আমন ধানের দাম খুব পড়তি বা নিম্নমুখী। ইত্তেফাক রিপোর্ট করেছে (২৭ নভেম্বর), এখন বাজারে প্রতি মণ আমন ধান সর্বোচ্চ বিক্রি হচ্ছে ৫৮০ টাকায়, যেখানে প্রতি মণ ধানের ফলনে এবার খরচ হয়েছে ৫০০ টাকার বেশি। এটা ভোলা-বরিশাল-পিরোজপুরের খরচ। উত্তরবঙ্গের খবর হলো, ধানের দাম বাড়তে শুরু করেছে। আমনের বাম্পার ফলন হতে যাচ্ছে সন্দেহ নেই।


আমনের কর্তন মৌসুমের শুরুতেই ধান-চালের দাম পড়ে যাওয়ার একটা কারণ হলো, নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে খবর বেরোল_সরকারি গুদামে খাদ্যশস্য রাখার জায়গা নেই; এবং এ পর্যন্ত আপৎকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলায় ১৫ লাখ টন খাদ্যশস্য মজুদ রয়েছে; আর এটা এযাবৎকালের সর্বাধিক। আবহাওয়া ভালো থাকলে আরেকটি বাম্পার ফলন হতে যাচ্ছে এই আমন মৌসুমে। এসব সংবাদে বেসরকারি মজুদদাররা ধানের দাম এবার না-ও বাড়তে পারে ভেবে তাদের গুদাম খালি করতে শুরু করে। অক্টোবরে আন্তর্জাতিক বাজারেও চালের দাম কমে যায়। এসব কারণে ধান কাটার মৌসুম শুরু না হতেই ধানের দাম নিম্নমুখী হয়েছে বলে একটা সংগত ব্যাখ্যা রয়েছে। সরকারি বর্ধিত খাদ্যশস্য আমদানির কারণে গত কয়েক মাস বেসরকারি আমদানিকারকরা খাদ্যশস্য আমদানি করেনি। অবশ্য ধান কাটার একদম ভরা মৌসুমে কিংবা যেকোনো ফসলেরই ভরা মৌসুমে সেসব ফসলের মণপ্রতি দাম বছরের সবচেয়ে নিম্ন পর্যায়ে থাকে। তারপর মৌসুম শেষ হওয়ার পর ক্রমান্বয়ে দাম বাড়তে থাকে এবং সর্বোচ্চ দাম ওঠে ফসল কাটা মৌসুমের আগে। এটাই আমাদের কৃষির ক্ষেত্রে চিরায়ত সত্য (Stylized fact)।
এই ধানের দাম কমতির প্রেক্ষাপটে গত ২৬ নভেম্বর সিরডাপ মিলনায়তনে ব্র্যাক, রাইস ফাউন্ডেশন এবং ইফ্রির (IFPRI) আয়োজনে এইউএসআইডির অর্থায়নে একটি নীতি সংলাপ (Policy Dialogue) হয়ে গেল, যার বিষয়বস্তু ছিল 'ধান-চালের দামের অস্থিতিশীলতা : সরকারের করণীয়'। উপস্থিত ছিলেন কৃষি অর্থনীতিবিদ, কৃষি বিশেষজ্ঞ, দাতা সংস্থার প্রতিনিধি এবং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকরা। কৃষিমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সভায় সভাপতিত্ব করেন কৃষিসচিব। উপস্থিত ছিলেন খাদ্যসচিব এবং দুজন নির্ধারিত সম্পূরক আলোচক। আর প্রধান প্রতিবেদক ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক ড. মাহবুব হোসেন। ড. মাহবুব হোসেন চালের দামের অস্থিতিশীলতা বা ওঠানামার বিষয়টি এবং এর ক্ষতিকর বিভিন্ন প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করেন। সেই আলোচনা প্রসঙ্গে নির্ধারিত সম্পূরক আলোচকরা যে পরামর্শ রেখেছেন, তা হলো, কৃষকদের ধান কিনে মূল্য সহায়তা দেওয়া। এবং তা কিনতে হবে কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি; মিল মালিকদের কাছ থেকে নয়। সরকারকে এ ব্যাপারে এক্ষুনি পদক্ষেপ নিতে হবে। এই পরামর্শ নিয়েই এখন কিছু কথা।
ড. মাহবুব হোসেন ধান-চালের ওঠানামা কোন পর্যায়ে উঠলে-নামলে ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে শুরু করবে, তার কোনো পরিমাপ বলেননি। আসলে পণ্যের দরদামের ওঠানামা, বিশেষ করে কৃষিপণ্যের অত্যন্ত স্বাভাবিক বিষয়। কৃষিপণ্যের দাম খুচরা ও পাইকারি বাজারে ঘণ্টায় ঘণ্টায় পরিবর্তন হতে পারে।
কৃষিপণ্যের বাজার সম্পর্কে আমাদের ধারণাটা এ রকম যে কৃষিপণ্য বিপণনে কৃষকরা খুব মার খান। তাঁরা শোষণের শিকার। মধ্যস্বত্বভোগী বা দালাল-ফড়িয়া-বেপারীরা (মিডলম্যানরা) সব লুটেপুটে খায়। এর জন্য বাজারে বা শহরে ভোক্তাদের বেশি বেশি দাম দিয়ে পণ্য কিনতে হয়। কৃষিপণ্যের বাজার আর উপকরণের বাজারব্যবস্থা অবশ্য দুই রকম। কৃষিপণ্যের বাজারের কতিপয় বৈশিষ্ট্য এখানে তুলে ধরছি। আমার এই বক্তব্য সাধারণভাবে প্রচলিত ধারণার বাইরে। এখানে বলে রাখি, কৃষি বাজারব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভর করবে বাজারব্যবস্থায় সরকার হস্তক্ষেপ করবে কি না বা করলেও তা কিভাবে করবে। কৃষিপণ্যের প্রতিটির বাজারব্যবস্থাই ভিন্ন (ইউনিক)। বাজারব্যবস্থা বলতে বোঝায় প্রতিটি স্তরে ক্রেতা-বিক্রেতার সংখ্যা, পণ্য বৈশিষ্ট্য এবং দরদাম ঠিক হওয়ার প্রক্রিয়া। বাজারের ধরন বা প্রকৃতির ওপর নির্ভর করবে, কৃষক বা উৎপাদক ঠকবে, না ভোক্তাকে বেশি দাম দিতে হবে। না মাঝপথের মিডলম্যানরাই মুনাফা লুটে নেবে। যদি কৃষকরা ন্যায্য দামের চেয়ে কম পায় কিংবা ভোক্তা ন্যায্য দামের বেশি দেয়, তাহলে সেই পণ্যের বাজার বিপণনের ভাষায় অদক্ষ। আর উৎপাদক এবং ভোক্তা মোটামুটি ন্যায্য দাম পেলে আমরা সেই পণ্যের বাজারকে বলি দক্ষ। দক্ষ বাজার হলে সরকারের কোনো পর্যায়েই হস্তক্ষেপের দরকার নেই। সরকার হস্তক্ষেপ করলে শুধু সম্পদের অপচয় ঘটবে।
আমাদের কৃষিপণ্য বাজারব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো_কৃষিপণ্য বাজারব্যবস্থা প্রতিযোগিতামূলক, অসংখ্য ক্রেতা-বিক্রেতা, সমজাতীয় পণ্য হলেও গুণগত পার্থক্য থাকায় একই পণ্যের ইউনিক দাম বিরাজ করে না। সব মিলিয়ে পণ্য বাজারব্যবস্থা দক্ষ। এখানে উৎপাদকরা বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়া মোটামুটি ন্যায্য দাম পেয়ে থাকে এবং অনেক শোরগোল সত্ত্বেও ভোক্তারা মোটামুটি ন্যায্য দাম দিয়ে থাকে। আমাদের দেশে প্রায় সবারই অভিযোগ, ফড়িয়া-বেপারী-আড়তদার-মজুদদাররা সব কিছু লুটেপুটে খায়। বিশেষ দু-একটি পরিস্থিতি ছাড়া এটা অসম্ভব। কেননা, তাহলে হাজার হাজার বেকার যুবক ফড়িয়া, বেপারী বা মজুদদার বনে যেত এবং প্রতিযোগিতার মাধ্যমে প্রত্যেকের মুনাফা স্বাভাবিক অবস্থায় নামিয়ে আনত, যা বাস্তবে রয়েছে। আমাদের ধান-চালসহ কৃষি বাজারব্যবস্থা মোটামুটি দক্ষ এ কারণে বলছি, দিনাজপুর থেকে যে চাল ঢাকায় বিক্রি হয়, পরিবহন-প্যাকেজিং-হ্যান্ডলিং খরচ বাদ দিলে মণপ্রতি তার দাম একই। কুষ্টিয়া থেকে ঢাকায়ও চালের দাম পরিবহন-প্যাকেজিং-হ্যান্ডলিং খরচ বাদ দিলে একই। দিনাজপুরের কৃষকরা ঢাকার দামের গড়ে ৮০ শতাংশ পেয়ে থাকেন। দেশি-বিদেশি প্রাজ্ঞজনদের গবেষণা থেকে এ ফলাফল বেরিয়ে এসেছে। ধান-চালসহ শাকসবজি প্রায় সর্বক্ষেত্রেই বাংলাদেশের একই পণ্যের দুটি বাজারের দামের পার্থক্য শুধু পরিবহন খরচ। পরিবহন, প্যাকেজিং ও হ্যান্ডলিং খরচ বাদ দিলে বাংলাদেশে সব বাজারেই কৃষিপণ্যের দাম একই। অর্থনীতিতে একই পণ্যের ভিন্ন ভিন্ন বাজারে পরিবহন ও ডেমারেজ খরচ বাদ দিলে যদি দাম একই হয়, তাহলে সেই বাজার দক্ষ। মানে, উৎপাদক ও ভোক্তা খুব একটা ঠকে না। যদিও আমাদের দেশের শিক্ষিত মহলসহ সাধারণের বিশ্বাস, কৃষিপণ্যের দরদামের ব্যাপক ওঠানামার কারণ এবং কখনো কখনো অত্যধিক দাম বেড়ে যাওয়ার পেছনে 'অপশক্তি' হলো মিডলম্যান ও মজুদদাররা। কৃষিপণ্যের দামের ব্যাপক ওঠানামার মূল কারণ হলো মৌসুমভিত্তিক উৎপাদন এবং উৎপাদনে প্রকৃতিনির্ভরতা, আমদানিনির্ভরতা, কৃষিপণ্যের পচনশীলতা ইত্যাদি। আর উৎপাদন মৌসুমভিত্তিক হওয়ায় ব্যাপক উৎপাদন হলে এবং প্রায় একই সময়ে কর্তন মৌসুম হওয়ায় দাম একদম পড়ে যায় এবং মৌসুম শেষে আবার বেড়ে কর্তন মৌসুমের আগে সর্বাধিক দাম হয়।
এবার কর্তন মৌসুমের প্রারম্ভে ধানের দাম কমে যাওয়ার কারণ আগেই বলেছি। ওয়ার্কশপ-ডায়ালগ-সেমিনারের জন্য আমাদের কিছু দাতা সংস্থা সর্বদা প্রস্তুত। এবং প্রধান প্রধান এনজিও সেই সুযোগ নিয়ে কোনো ইস্যু সৃষ্টি না হতেই ওয়ার্কশপ-ডায়ালগ-সেমিনার এত বেশি করে যে আমাদের পাঁচতারা হোটেলসহ বিভিন্ন মিলনায়তনের বুকিং পাওয়াটা প্রায় দুঃসাধ্য। আমাদের একটা নির্দিষ্ট আঁতেল শ্রেণীও গড়ে উঠেছে। মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণে এই বুদ্ধিজীবী শ্রেণী সম্ভাব্য-অসম্ভাব্য সুপারিশ জোর গলায় তুলে ধরছে। তেমনিভাবে সেদিনকার 'সংলাপের' (যদিও আয়োজকরাই নির্ধারিত সময়ের প্রায় সমুদয়টা বক্তব্য রেখেছেন) একজন নির্ধারিত সম্পূরক আলোচক কৃষক রক্ষায় এখনই সরকারকে ধান সংগ্রহের পরামর্শ দিয়েছেন, যাতে কৃষকরা ন্যায্য দাম পান, যদিও বর্তমান দামেও কৃষকরা ঠকছেন না। আসলে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে সরকারি হস্তক্ষেপকে অনেকেই বাজার নিয়ন্ত্রণে মহৌষধ মনে করেন। কৃষক কল্যাণের নামে সরকারের অসময়োচিত হস্তক্ষেপ কিংবা অযাচিত হস্তক্ষেপ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পণ্যমূল্যকে আরো অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে, এমন নজির অসংখ্য। ঘাটতি পণ্যগুলোর ক্ষেত্রে কিংবা দৈব-দুর্যোগ হলে আমদানি সহায়ক পদক্ষেপ সরকারকে দ্রুতই নিতে হবে। তা ছাড়া পণ্যের বাজারব্যবস্থাকে এর নিজস্ব গতিতে কাজ করতে দেওয়া উচিত। কেননা প্রতিযোগিতামূলক দক্ষ পণ্যবাজার হিসেবে বেশির ভাগ সময়ই মূল্যসমূহ থাকে অন দ্য লাইন। প্রাইসেস 'আউট অব লাইনে' গেলেই (দৈব দুর্বিপাক, উৎপাদন ঘাটতি) কেবল সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারে; এবং তখন অবশ্যই সরকার হস্তক্ষেপ করবে।
সরকারের যা করণীয়, তা হলো কৃষি উপকরণ বাজারের ক্ষেত্রে। বীজের বাজার খুবই অস্থিতিশীল; এবং মানসম্পন্ন বীজের অভাব রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের করণীয় ব্যাপক_বিশেষ করে বীজের বাজার গড়ে তোলা, মানসম্মত বীজ সরবরাহ নিশ্চিত করা। সারের বাজার প্রতিযোগিতামূলক নয়; এবং সরকার সার সরবরাহের নিশ্চয়তা না দিলে গোটা কৃষিতে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। মানহীন কীটনাশকে বাজার সয়লাব। এ ক্ষেত্রেও মাননিয়ন্ত্রণ ও সরবরাহে সরকারের করণীয় ব্যাপক। সেচ সুবিধা সম্প্রসারণেও সরকারের ভূমিকার গুরুত্ব ব্যাপক। কৃষি উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং আমদানিতে সরকারের ব্যাপক সহায়তা প্রয়োজন। ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষি তথ্যকেন্দ্রগুলোকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। শেষ কথা হলো, কৃষিপণ্যের বাজারে নয়, অস্থিতিশীল কৃষি উপকরণের বাজারের প্রতি সরকারকে মনোনিবেশ করতে হবে এবং উপকরণের বাজারগুলো নিবিড় নিরীক্ষণে রাখতে হবে।
লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ এবং পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য

No comments

Powered by Blogger.