প্রচ্ছদ রচনা : বাংলাদেশের শিল্পায়নের তিন কাল-ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক!

ব অর্থনৈতিক সম্পর্কই একটা রাজনৈতিক আবহ নির্মাণ করে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিছক অর্থনৈতিক ছিল না কোনোকালেই। বরং বরাবরই তা আঞ্চলিক রাজনীতি এবং বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নির্ধারণে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক বাণিজ্য ঘাটতি তিন বিলিয়ন ডলারের ঘর ছাড়িয়েছে। চোরাচালান ইত্যাদির কল্যাণে অনানুষ্ঠানিকভাবে এই ঘাটতি তিন থেকে চার


গুণ বেশি হতে পারে, বিশ্বব্যাংক সূত্রেরও অনুমান এমনটিই। নিছক বাণিজ্যিক লেনদেনের সম্পর্কের বাইরেও যে পানি বণ্টনের নীতিমালা ভারত চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে প্রত্যাশা করে, সেদিক দিয়েও অমিত্রসুলভ আচরণের জন্য বাংলাদেশের মানুষের কাছে নিন্দিত। ফারাক্কা, তিস্তার পানি প্রবাহ প্রত্যাহারের পাশাপাশি সদ্য টিপাইমুখে বাঁধ দেওয়ার তোড়জোড় করার মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রাণ-প্রকৃতি পরিবেশ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ার আশঙ্কা করছেন অনেকেই। এ ছাড়া আছে ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রত্যাহারের উদ্যোগ। এরই পাশাপাশি প্রায় বিনা শুল্কে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোতে ট্রানজিট (কার্যত করিডর) প্রদানে বাংলাদেশের শাসকদের আগ্রহও জনগণের জন্য উত্তরোত্তর মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সীমান্তে নিয়মিত হামলা, গুলিবর্ষণ, বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা ও আহত করা, নারী নির্যাতন ইত্যাদির অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বিরুদ্ধে। ফলে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে আবেগের ঊধর্ে্ব ভাবাটা প্রায়ই সম্ভব হয় না, ভারতের যৌক্তিক বিরোধিতা এ দেশে বহু ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী ভাবনাকেও উস্কে দেয়। তাই আজ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর জন্য দরকার উভয় দেশের সম্পর্কের পুনঃপুন যৌক্তিক ব্যাখ্যা। সময়ের প্রয়োজনে ভারত-বাংলাদেশের দীর্ঘ ঐতিহাসিক মিত্রতা-অমিত্রতার বন্ধনকে বিশ্লেষণ করেছেন ফিরোজ আহমেদ

ভারতীয় উপমহাদেশে বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর চাকরি ও ভূসম্পত্তিপ্রীতি একটি আলোচিত বিষয়। শিল্পোদ্যোক্তার অনিশ্চিত জীবনের বদলে তারা চাকরির নিশ্চিত নিরাপত্ত বেশি পছন্দ করে, বাড়তি অর্থ জমিতে বিনিয়োগ করে, এমন পর্যবেক্ষণ সাহিত্যিক, সমাজবিজ্ঞানী থেকে শুরু করে চালু আড্ডারও বিষয়বস্তু। এই অভিযোগ অসত্য নয় পুরোটা, তবে এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট না জানা থাকলে আলোচনাটা নেহায়েতই অবিচার হয়ে যায়। শুধু ঐতিহাসিক-সামাজিক কৌতূহলের জন্যই নয়, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বৈচিত্র্য বোঝার জন্যও এ ভূমিকাটি প্রয়োজন।
ভারতের প্রধান দুটি শিল্পাঞ্চল, যেখানে আধুনিক ভারতীয় পুঁজির জন্ম ও বিকাশ এবং যেখান থেকে তা অন্যত্র ছড়িয়েছে, সে দুটি অঞ্চল হলো বোম্বে (আধুনিক মুম্বাই) এবং মাদ্রাজ উপকূল। অথচ কলকাতা এবং বোম্বে প্রেসিডেন্সি উভয়েই ভারতের আদিতম ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত এলাকা হলেও দীর্ঘকাল কলকাতাই ছিল রাজধানী, বাংলা এলাকা ছিল ব্রিটিশদের সব রকম আয়ের প্রধানতম উৎস। তাদের বাণিজ্য কুঠির বেশির ভাগই বাংলায় স্থাপিত ছিল। মোগল আমলের শেষদিকে শুধু নয়, ব্রিটিশদের আগমনের পরও একটা বড় পর্যায় পর্যন্ত ভারতের মধ্যে শুধু নয়, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে লগি্নকারক এবং শিল্পোদ্যোক্তাদের মধ্যেও বিশিষ্ট বেশ কয়েকজনের স্থায়ী আবাস ছিল বাংলা। অথচ অচিরেই বাংলা অঞ্চল বৃহৎ শিল্পোদ্যক্তাশূন্য হয়ে পড়ল। এর পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, যেখান থেকেই বাংলার জমিদার শ্রেণীরও জন্ম।
১৭৯৩ সালে প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পেছনে ব্রিটিশ প্রভুদের দুটি প্রধান লক্ষ্য ছিল, এটি লর্ড কর্নওয়ালিস যেমনটি বলেছিলেন, 'আমাদের নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যই ভূস্বামীদের আমাদের সহযোগী করে নিতে হবে। যে ভূস্বামী একটি লাভজনক সম্পত্তি নিশ্চিন্ত মনে ও সুখে-শান্তিতে ভোগ করতে পারে, তার মনে এটা কখনোই পরিবর্তনের ইচ্ছা জাগতেই পারে না।' অর্থাৎ এমন একটি জমিদার শ্রেণী ভারতে সৃষ্টি করা, যারা নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থেই ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সহযোগী হবে। অপর লক্ষ্যটিও কর্নওয়ালিস এরই ভাষায়_'ভূমিস্বত্বকে নিরাপদ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে এ দেশিদের হাতে যে বিরাট পুঁজি আছে, সেটাকে তারা অন্য কোনোভাবে বিনিয়োগ করার উপায় না দেখে ভূসম্পত্তি ক্রয়ের উদ্দেশ্যে ব্যয় করবে।'
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে ব্রিটিশদের কাঙ্ক্ষিত ফলাফলই ঘটে। রামদুলাল দে, দ্বারকানাথ ঠাকুর, রামগোপাল ঘোষসহ উনিশ শতকের প্রথম ভাগে যেসব বাঙালি পরিবার শিল্প-বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল তাঁদের প্রায় সবাই ব্রিটিশদের প্রতিকূল বাণিজ্যনীতি এবং অসম প্রতিযোগিতা থেকে রক্ষা পাওয়ার বাসনায় এবং বৃহৎ ভূসম্পত্তির নিরাপদ আয়কে অনুকূল মনে করে অচিরেই উদ্যোক্তা থেকে জমিদারে পরিণত হয়।
ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত 'বাঙালি ভদ্রসমাজ' বলে কথিত অংশের ভূসম্পত্তি-নির্ভরতা, বাণিজ্যের বদলে চাকরির পেছনে ছোটার মনোবৃত্তির লিখিত নিন্দা অসংখ্য, মৌখিক নিন্দা তার হাজার গুণ বেশি। কিন্তু এই কেরানিবৃত্তির যে একটা ঐতিহাসিক নির্মাণ আছে, সেটা অধিকাংশ সময়ই দৃষ্টির আড়ালে থাকে। কিন্তু সংক্ষেপে বলতে গেলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের এই ঐতিহাসিক পদক্ষেপটি বোম্বে এবং মাদ্রাজের সঙ্গে ভারতের বাকি অংশের এবং রাষ্ট্রীয় অভিজ্ঞতার বিবেচনায় বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।

রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে উদ্যোক্তা সৃষ্টি : আইয়ুবী শিল্পমালিকরা
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুবাদে যে মধ্যবিত্ত জমিদার ও পেশাজীবী শ্রেণী বাংলায় তৈরি হয়, তার একটা বড় বৈশিষ্ট্য ছিল সাম্প্রদায়িকভাবে প্রধানত একক হিন্দু প্রাধান্য। ১৯৪৭ সালের পর বাঙালি মুসলমানদের মাত্র চার জন ছিলেন আইসিএস। পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের প্রতি ব্রিটিশদের বদান্যস্বরূপ প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষক, আইন পেশায় নিযুক্তদের বড় অংশ এবং অধিকাংশ পেশাজীবী ছিলেন তাঁরাই। বাণিজ্য এবং শিল্প ক্ষেত্রে অবাঙালি মাড়োয়ারি হিন্দুদের ছিল একক প্রাধান্য। দেশবিভাগের সময় পূর্ববঙ্গে কোনো বাঙালি মুসলমানের মালিকানাধীন একটি বৃহদায়তন শিল্পও ছিল না। পাইকারি ব্যবসায় মুসলমানদের ভূমিকার একমাত্র নজির ছিলেন চট্টগ্রামের সওদাগররা। পাটের ব্যাপারী এবং আড়তদারিও ছিল মূলত বাঙালি হিন্দু এবং মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে। বিপুল দেশান্তর, দাঙ্গা ও দখলের পরও ১৯৫৯ সালের এক জরিপে দেখা যায়, পূর্ব পাকিস্তানের মোট শিল্প পরিসম্পদের মাত্র ৩ শতাংশ বাঙালি মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে, ৮.৫ শতাংশ বাঙালি হিন্দু এবং ২ শতাংশ মাড়োয়ারি সম্প্রদায়ের নিয়ন্ত্রণে। ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত মাত্র একজন বাঙালি মুসলমান ব্যবসায় ঢুকেছিলেন, তিনি হলেন এ কে খান। চাকরি ছেড়ে তিনি শ্বশুরের টাকায় একটি কাপড়ের কলসহ কয়েকটি কারখানা স্থাপন করেছিলেন।
পাকিস্তানে আইয়ুব খানের আমলে শিল্প উন্নয়ন করপোরেশনের পৃষ্ঠপোষকতায় যে শিল্পপতি শ্রেণী গজিয়ে ওঠে, নানা বাস্তবতা ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার সুবাদে দেখা যায়, তাদের প্রায় সবাই অবাঙালি মুসলমান। পাকিস্তানে শিল্পপতি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রীয় ভর্তুকিতে এই শ্রেণীটি গড়ে তোলা হয়। তারা বোম্বে ও মাদ্রাজকেন্দ্রিক পুঁজিপতিদের মতো ব্যক্তি উদ্যোগ আর প্রতিযোগিতার ফলাফল নয়। খুব দ্রুতই এই নতুন পুঁজিপতিরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাণিজ্য, মহাজনি ও আড়তদারিতে হিন্দু প্রতিদ্বন্দ্বীদের ছাড়িয়ে যায়, যাঁরা পাকিস্তানের অনিরাপদ ও সাম্প্রদায়িক পরিবেশে তাঁদের সম্পদ যথাসম্ভব ভারতে স্থানান্তরিত করছিলেন। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর হিন্দু মালিকানাধীন ৫২টি বৃহৎ শিল্প এবং ২৫০টি বাণিজ্যিক ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান অধিগ্রহণ করা হয়। এভাবে সাবেকি ব্রিটিশ, হিন্দু এবং মাড়োয়ারি আধিপত্যের বদলে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত মুসলমানদের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা হয় বাংলা এলাকায়। এমনকি ১৯৬৯-৭০ সালেও মাত্র ৩৯ জন বাঙালি ১০ লাখ টাকার লাইসেন্সের মালিক ছিলেন। পাকিস্তান আমলে পাটসমেত পূর্ববাংলার অধিকাংশ কাঁচামাল ও নিশ্চিত বাজার রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত পশ্চিম পাকিস্তানি শিল্প মালিকদের সম্পদ সৃষ্টিতে ব্যবহৃত হয়, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এস বারানভ এই সুবাদেই পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উপনিবেশ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। কর এবং অন্যান্য উৎস থেকে প্রাপ্ত জনগণের অর্থ ভর্তুকি দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান এবং প্রধানত পাঞ্জাবকেন্দ্রিক পাকিস্তানি বুর্জোয়া শ্রেণী এভাবেই বিকশিত হয়।
তবে এই পরিস্থিতির মধ্যেও একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, ১৯৫৯ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি শিল্পমালিক শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটে। তাদের জন্ম এবং বিকাশ পুরোপুরিই রাষ্ট্রীয় সহায়তা ও ঋণে। প্রধানত পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে স্বার্থের গাঁটছড়া বাঁধা একটি স্থানীয় বড়লোক শ্রেণী গড়ে তোলার চিন্তা থেকেই এই অংশটিকে জন্ম দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু একই সঙ্গে অনুগ্রহবঞ্চিত পেটি বুর্জোয়ারা নিজেদের স্বার্থেই এই শ্রেণী এবং শ্রেণীটির স্রষ্টা তদানীন্তন সরকারের বিরুদ্ধে চলে যায়। সুতরাং শুরু থেকেই এই (বুর্জোয়া) শ্রেণীটির কোনো সামাজিক সমর্থন ছিল না। বুর্জোয়া ব্যবস্থার অভ্যন্তরে এর কোনো নিজস্ব শিকড় ছিল না এবং সরকারের অনুগ্রহ ব্যতিরেকে বেঁচে থাকার ইচ্ছাশক্তি ও সামর্থ্যের কোনোটাই এদের ছিল না।' তবে বুর্জোয়ারা পাকিস্তান রাষ্ট্রের পক্ষে ভূমিকা রাখলেও বিক্ষুব্ধ পেটি বুর্জোয়া উকিল, শিক্ষক, পেশাজীবীর স্বার্থ ক্রমেই দানা বাঁধছিল প্রধানত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে।

বাংলাদেশ আমল
পাকিস্তান আমলে জন্ম নেওয়া পেটি বুর্জোয়া অংশটি দেশি বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণর্ না হলেও তাদের বঞ্চনার আংশিক প্রতিশোধ নিয়েছিল বটে। ১৯৬৯-৭০ সাল নাগাদ প্রধান ১৬টি শিল্পপতি পরিবারের সর্বমোট সম্পদ ছিল ৬৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা। পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত সম্পত্তির পাশাপাশি এদের একটা বড় অংশের সম্পদ জাতীয়করণ করা হয়।
'১৯৭২ সালের মার্চে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যেসব পাটকল, বস্ত্রকল এবং একটি চিনিকল জাতীয়করণ করা হয়, তার মোট মূল্য দাঁড়িয়েছিল ৯১ কোটি আট লাখ টাকা।' এই জাতীয়করণকৃত পরিসম্পদের ৪২ শতাংশ এসেছিল উপরোক্ত ১৬টি ব্যবসায়ী পরিবারের সম্পদ থেকে, বাকি ৫৮ ভাগ হলো পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি। উল্লেখ্য, পশ্চিমা দেশগুলোর পুঁজি কিন্তু এই জাতীয়করণের আঘাত থেকে প্রায় সম্পূর্ণ নিরাপদ ছিল। 'জাতীয়করণ হওয়ার পর এই পরিবারগুলোর হাতে অবশিষ্ট ছিল ৩১ কোটি ৬০ লাখ টাকা, অর্থাৎ গড়ে পরিবার প্রতি এক কোটি ৯৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা।' জাতীয়করণ হওয়ার আগে এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় এ কে খান গ্রুপের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ১২টি, আনুমানিক সম্পদ ছিল সাড়ে সাত কোটি টাকা।
বুর্জোয়াদের প্রতি পেটি বুর্জোয়াদের প্রতিশোধের ধরন কী ছিল? পাকিস্তান আমলে ধনী হওয়ার সুযোগটি ছিল অতি সীমিতসংখ্যক বাঙালির জন্য, যাদের সুযোগ ছিল নানা যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে বরাদ্দকৃত লাইসেন্স, পারমিট, ঋণ প্রভৃতি সংগ্রহ করার। রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে এবার বাঙালি পেটি বুর্জোয়া শ্রেণী দ্রুত তাদের স্থলাভিষিক্ত হতে চাইল। পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি বা বাঙালি বড়লোকদের কলকারখানা সরাসরি দখল করাটা সম্ভব ছিল না বটে, সেই কাজটিই তারা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সম্পাদন করল এই সম্পদকে সমাজতন্ত্রের নামে জাতীয়করণ করার মাধ্যমে।
১৯৭২ সাল থেকেই বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সদ্যোজাত বাংলাদেশকে কিভাবে ভারতের প্রায় অর্থনৈতিক উপনিবেশে পরিণত করা হচ্ছে, তার নিয়মিত বর্ণনা ও প্রতিবাদ জারি রাখলেও ভারতের রাজনৈতিক প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ নিয়েও তারা সংগত কারণেই উদ্বেগ প্রকাশ করছিল। বলা যায়, বাংলাদেশের শৈশবাবস্থাতেই যে নিয়ন্ত্রণমূলক অর্থনৈতিক সম্পর্ক ভারতের সঙ্গে স্থাপিত হয়েছিল, তারই সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাজনৈতিকব্যবস্থাও দেশে জারি হয়েছিল। এই অধীনতামূলক অর্থনৈতিক সম্পর্কের জন্যই প্রয়োজন ছিল স্বৈরতান্ত্রিক, গোপনপ্রবণ এবং জনগণের অংশগ্রহণহীন একটি রাজনৈতিকব্যবস্থা। আওয়ামী লীগ মূলত ছিল উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কহীন খুদে বুর্জোয়াদের রাজনৈতিক দল, স্বাধীনতার পর এরা রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করেছিল রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ দিয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বৃদ্ধিতে, এর বাইরে ধনী হওয়ার প্রধান উপায় ছিল রিলিফসামগ্রী লুণ্ঠন (দেশের দ্বিতীয় ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হওয়া আওয়ামী লীগ নেতা গাজী গোলাম মোস্তফা ছিলেন রেডক্রসের চেয়ারম্যান), লাইসেন্স-পারমিটের একচেটিয়াকরণ এবং গ্রাম ও মফস্বলে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষসহ অপরের সম্পত্তি দখল। কারখানাগুলোতে সরাসরি কলকবজা পাচার থেকে শুরু করে বাড়তি মূল্যে যন্ত্রপাতি-কাঁচামাল সরবরাহ, অস্বাভাবিক কম দরে উৎপাদিত দ্রব্যাদির একচেটিয়া সরবরাহের অধিকার লাভ এবং সেই পণ্যাদি অস্বাভাবিক উচ্চ দরে জনগণের কাছে বিক্রি_এই ছিল সম্পত্তির মালিক হওয়ার সবচেয়ে লাভজনক উপায়।
কারখানা পর্যায়ে উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দাম নির্ধারণ করাটা চক্রান্তমূলক ছিল না কি পারমিটধারীদের মুনাফা যথাসম্ভব উচ্চ করার 'নিরীহ ধান্ধা', তা বলা মুশকিল। কিন্তু এর ফলাফল যা হওয়ার তাই হলো। এভাবে কৃষক পর্যায়ে চাষিরা কতটা বঞ্চিত হতো, পরিশেষে দেশবাসী কত টাকায় পণ্যটি ক্রয় করত এবং 'সমাজতান্ত্রিক' বাংলাদেশে মধ্যস্বত্বভোগীরা ধাপে ধাপে জনগণের কতটা অর্থ পকেটস্থ করত, তার একটা ধ্রুপদী উদাহরণ পাওয়া যাবে ১৯৭৪ সালের লবণ কেলেঙ্কারির সময়। ৯ অক্টোবর দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত শ্রমিক লীগের এমপি আবদুল মান্নানের বক্তব্য অনুযায়ী 'লবণের দুষ্প্রাপ্যতা সম্পর্কে সম্ভাব্য সব ধরনের খোঁজ নিয়ে জানা গেছে যে মজুদদাররা উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে দুই টাকা মণ দরে লবণ কেনে। মজুদদারদের জন্য অশোধিত লবণের সরকারি দাম ১৫ টাকা, আর শোধিত লবণের দাম ৫৫ টাকা।...অশোধিত লবণের দাম ৪০ টাকা করা হলে বাজারে প্রচুর লবণ পাওয়া যাবে বলে মজুদদারের মত প্রকাশ করছেন।' লবণের দাম এই সময়ে খুচরা পর্যায়ে কত ছিল, সেটা কল্পনাতীত নিশ্চয়ই, এই বক্তব্যের কয়েক মাস আগেই পত্রিকার খবর অনুযায়ী চার আনা সেরের লবণের দাম ৩২ টাকা হয়ে গিয়েছিল। চাষি যেটি মণ প্রতি দুই টাকা দরে বিক্রি করছেন, অতি সামান্য মূল্য সংযোজন শেষে সের প্রতি তা ৩২ টাকায় খুচরা বিক্রি হওয়া থেকেই কতটা অকল্পনীয় হারে লুণ্ঠন সম্পন্ন হয়েছে তা বোঝা যায়। পরিকল্পনা কমিশনের হিসাব থেকে জানা যায়, মাত্র দুই বছরে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম প্রায় ৪০০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছিল। বর্ধিত এই গোটা অর্থ অল্প কিছু রাজনৈতিক যোগাযোগসম্পন্ন পারমিটধারী ব্যক্তির পকেটস্থ হতো। এর পুরোটাই 'সমাজতান্ত্রিক' বাংলাদেশের নব্য ধনিক শ্রেণীর পকেটস্থ হয়ে কেবল তাদের সম্পদই বৃদ্ধি করেনি, দেশের উৎপাদন ক্ষেত্রেরও মহাসর্বনাশ করেছিল।
ভারত তার এই বাজার বিস্তারে শুধু যে বাংলাদেশের ভঙ্গুর এবং লুণ্ঠনজীবী শাসকগোষ্ঠীর আনুগত্য পেয়েছিল তা-ই নয়, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিন্যাসও তাকে মস্কোপন্থী বলে পরিচিত বাংলাদেশের বামপন্থীদের একটা বড় অংশের সহায়তা এনে দিয়েছিল। এটা কৌতূহলোদ্দীপক যে ভারতের শাসকগোষ্ঠী, যারা মূলত বোম্বে এবং মাদ্রাজকেন্দ্রিক পুঁজিপতিদের প্রতিভূ, যে সময়টিতে 'সমাজতান্ত্রিক সংবিধান'-এর বন্দোবস্ত করে এবং নানা সংরক্ষণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে বিদেশি পুঁজির হাত দেশি উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রবিশেষে রক্ষা এবং নিজেদের শিল্পভিত্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, সেই একই সময়ে বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী 'সমাজতান্ত্রিক সংবিধান'-এর আড়ালে ভারতীয় শিল্প এবং বণিক পুঁজির শিকারে পরিণত করছে দেশটিকে। এ ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়ন একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। বাংলাদেশে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রত্যক্ষ কোনো বিরাট অর্থনৈতিক স্বার্থ না থাকলেও, এবং সীমিত আকারে হলেও মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী সময়ে বন্ধুত্বপূর্ণ কিছু দান-খয়রাত সদ্য স্বাধীন দেশটিকে করলেও তারা তাদের অনুগত রাজনৈতিক দলগুলোকে শেখ মুজিবুর রহমান ও ভারতের সঙ্গে মিত্রতা বজায় রাখার নির্দেশ দেয়। বিশ্বরাজনীতিতে নিজেদের ভারসাম্য টিকিয়ে রাখার জন্য ভারতের বন্ধুত্ব সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য প্রয়োজন ছিল, আর সে বন্ধুত্বের দায় মেটানোর জন্য সোভিয়েতপন্থী দলগুলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের স্বার্থ টিকিয়ে রাখার রাজনৈতিক ভূমিকাটি যথাসম্ভব পালন করে। আরো একটি বিষয় বিবেচনায় রাখা দরকার। সেটি হলো, ভারত সাধারণভাবে রুশ বলয়ের বলে পরিচিত হলেও সত্তরের দশকের সেই সময়টিতেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার অর্থনৈতিক ও অন্যান্য সম্পর্ক যথেষ্টই দৃঢ় ছিল। আজকের মতোই তখনো ভারতকেই এই অঞ্চলের 'মাতব্বর' হিসেবেই যুক্তরাষ্ট্র বিবেচনা করত। ভারত বিশ্ব-ভূরাজনৈতিক বিভাজনে একদিকে রাশিয়ার পক্ষালম্বন করে সামরিক-অর্থনৈতিক দিক দিয়ে প্রভূত লাভবান হয়েছে, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সম্পর্ক রক্ষা করেছে। বাংলাদেশের বেলায় এই উভয় সম্পর্কই তার জন্য লাভজনক হয়েছে।
অবশ্য পুরনো বুর্জোয়াদের কেউ কেউ নতুন আমলে আপস এবং আঁতাতের দ্রুত পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নেয়। '৭৫-এর পর পরই তাদের রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানার মালিকানা পুনরায় হস্তান্তর করা হয়। শুধু তা-ই নয়, পাকিস্তানিদের রাষ্ট্রায়ত্ত কলকারখানাও অতি অল্প দরে বেসরকারি খাতে হস্তান্তর করা হয়। অধিকাংশ খাতে এই ক্রয়ের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে ঋণ হিসেবে প্রদান করা হয়। ফলে পুরনো ধনিকদের সঙ্গে হঠাৎ বহু নতুন উদ্যোক্তাও 'গজিয়ে' ওঠে, যারা ব্যাংকঋণের সুযোগ রাতারাতি চালু শিল্পের মালিক বনে যায়। কিন্তু উদ্যোক্তা-সংস্কৃতির অভাবে তাদের প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়ায় এভাবে মালিক বনে যাওয়া 'নিজের কারখানাটির' যন্ত্রপাতি-জমি বিক্রি করে, কারখানা পরিচালনার জন্য প্রাপ্ত মূলধনস্বরূপ ঋণ অন্য খাতে সরিয়ে নিয়ে নানা অজুহাতে কারখানাটিকে অলাভজনক বানানো এবং বন্ধ করে দেওয়া। অধিকাংশ বিরাষ্ট্রীয়কৃত কারখানাই এভাবে অদৃশ্য হয়ে গেছে, সেই সঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত খাত থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ স্থানান্তরিত হয়ে বেসরকারি মালিকদের বিত্তবান করেছে। মোটামুটি এই হচ্ছে বাংলাদেশের উচ্চবিত্ত শ্রেণীর ঐতিহাসিক বেড়ে ওঠা, যেখানে ব্যক্তিগত উদ্যোগে এবং প্রতিযোগিতার মাধ্যমে শিল্পকারখানা বা ব্যবসার মালিক হওয়ার বদলে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় জনগণের অর্থ লোপাট করাটাই ধনী হওয়ার সহজতম সড়ক হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। বহু ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীর আচরণ আপাতদৃষ্টে, তাই মনে হয়, তার নিজেরই স্বার্থের বিরুদ্ধে; একটি সত্যিকারের উদ্যোক্তা শ্রেণী যেমন তার নিজের খনিজ সম্পদ বহুজাতিক কম্পানির হাতে তুলে দিয়ে বহু গুণ বেশি দামে তা কিনতে চাইবে না, নিজেরা বেশি দামে গ্যাস কিনে কম দামে তা কাফকোর মতো প্রতিষ্ঠানকে নামমাত্র ভর্তুকিমূল্যে প্রদান করতে চাইবে না। স্বল্পদামে প্রাপ্য বিদ্যুৎ বহু গুণ বেশি দামে কুইক রেন্টাল নামের খেলনা-প্রায় বিদ্যুৎকারখানা মালিকদের কাছ থেকে কিনতে চাইবে না। কিন্তু এ দেশে এ সবই যে অনায়াসে ঘটছে, তার একটা বড় কারণ সত্যিকারের উদ্যোক্তা আর বিনিয়োগকারীদের তুলনায় এখানে অনেক বেশি দাপট এমন সব ব্যক্তির, যারা বিদেশি বিনিয়োগের কমিশনভোগী। বড়লোকদের প্রধানতম অংশ শিল্পোদ্যোক্তা না হয়ে আমদানি কিংবা রপ্তানিতে নিজেদের ভাগ্য গড়ার কারণে কারখানায় সস্তা জ্বালানি সরবরাহের চেয়ে বিদেশি পণ্য আমদানিতে তাদের তেমন কোনো আপত্তি নেই। এই একই অভিজ্ঞতা কিন্তু পাকিস্তানি উদ্যোক্তাদের বেলায়ও ঘটল, উপনিবেশস্বরূপ পূর্ব পাকিস্তানের বাজারটি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পর রাতারাতি সেখানকার শিল্পপুঁজিতে ধস নামে।

ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্য সম্পর্ক
১৯৭১-এর পর একদিকে যেমন পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা উদ্যোক্তারা অনেকটাই রাজনৈতিক ক্ষমতাহীন ও দুর্বল হয়ে পড়েছিল, নতুন ক্ষমতাবানরাও শিল্পকারখানা সংশ্লিষ্ট ছিল না বলে অস্তিত্বশীল কারখানাগুলো লুণ্ঠনই তাদের প্রধান আয়ের পথ হয়ে দাঁড়াল। আবার বহির্বিশ্বে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সমীকরণে পাকিস্তান রাষ্ট্রের পক্ষাবলম্বন করার কারণে পুঁজিবাদী দুনিয়ার প্রধান কেন্দ্রশক্তিগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্বস্তিকর সম্পর্ক (যেটা অবশ্য দ্রুতই কেটে যাচ্ছিল) রুশ বলয়ে অবস্থান করা ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতির একটা গভীর গাঁটছড়া বাঁধানোর কাজটি দারুণভাবে সম্পন্ন করে।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের '৭৫ সাল পর্যন্ত বাণিজ্য সম্পর্ক খতিয়ে দেখা যাক।
বছর রপ্তানি আমদানি বাণিজ্য-ঘাটতি আমদানির তুলনায়
রপ্তানি শতকরা হার
১৯৭৩ ২৩.৩ ১১৪.৮ ৯১.৫ ২০.৩
১৯৭৪ ০.৪ ৮২ ৮১.৬ ০.৫
১৯৭৫ ৫.৩ ৮৩.৩ ৭৮ ৬.৪
১৯৭৬ ৭.১ ৫৮.৫ ৫১.৪ ১২.১
(সব হিসাব মিলিয়ন মার্কিন ডলারে)
এ হিসাবটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৭০ সালের আগ পর্যন্ত ভারত থেকে বাংলাদেশের আমদানি ছিল অতি নগণ্য। কিন্তু ১৯৭১ সালের পর পরই ভারত বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদারে পরিণত হয়। একদিকে বাংলাদেশ থেকে পাট, চামড়াসহ কাঁচামাল রপ্তানি ছিল রপ্তানি ক্ষেত্রের বড় অংশ, আমদানীকৃত অধিকাংশ সামগ্রী ছিল শিল্পপণ্য ও যন্ত্রাংশ। সেই সময়কার কড়া সেন্সরশিপের মধ্যেও মওলানা ভাসানীর সাপ্তাহিক 'হককথা'য় এমন সব দুর্নীতির সংবাদ ছাপা হয়, যেখানে প্রায় অর্ধেক দামে নতুন জার্মান জাহাজ ক্রয় না করে শিপিং করপোরেশনের জন্য ভারতীয় পুরনো জাহাজ ক্রয় করা হয়েছিল। মোট কথা, '৪৭ সালের পর ভারত যেখানে আমদানি-বিকল্প অর্থনৈতিক কাঠামো নিজের জন্য নির্মাণ করেছিল, প্রতিবেশী বাংলাদেশের দুর্বল ও লুণ্ঠনজীবী শাসকদের ওপর সে চাপিয়ে দেয় তার উৎপাদনের উদ্বৃত্তটাকে।
'৭৫ সালের পর যে শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতায় আসে, জনগণের কাছ থেকে বৈধতা পাওয়ার জন্য তারা ব্যবহার করে দুটি প্রধান অস্ত্র। একটা ভারত ও সমাজতন্ত্র বিরোধিতা, অন্যটি ধর্ম। বলে রাখা দরকার, রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পত্তির লুণ্ঠনের সঙ্গে স্লোগান ছাড়া আর কোনো কিছুতেই সমাজতন্ত্রের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না থাকলেও এবং সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক বলয়ে ভারতের অবস্থান নিজস্ব মালিকগোষ্ঠীকে একটা নিরাপদ, প্রতিযোগিতাহীনতার সুবিধা প্রদান হলেও ভারত এ সব কিছুর মধ্য দিয়ে নিজেদের পুঁজিবাদী বিকাশকেই কিছুটা হলেও গতিশীল করতে সক্ষম হয়েছিল।
কিন্তু '৭৫ সালের পর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক অর্থনীতিতে কিভাবে অনূদিত হলো_ওই একই ছকের পরের দুটো বছরের দিকে তাকালে তা কিছুটা পরিষ্কার হবে :
বছর রপ্তানি আমদানি বাণিজ্য-ঘাটতি আমদানির তুলনায়
রপ্তানি শতকরা হার
১৯৭৭ ০.৬ ৫৫.২ ৫৪.৬ ১.১
১৯৭৮ ২.৩ ৪৩ ৪০.৭ ৫.৪
১৯৭৯ ১২.১ ৪০ ২৭.৯ ৩০.৩
সব হিসাব মিলিয়ন মার্কিন ডলারে
পরিষ্কার একটা ছাপ পড়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও উত্তেজনার। '৭৬ সাল থেকে আমদানি কমেছে, রপ্তানি হঠাৎ বেড়েছে এবং আবার কমেছে। নিজেদের ভারতবিরোধী ভাবমূর্তি প্রমাণ করার বাসনায় শাসকরা কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন, হয়তো প্রতিবেশীর উদ্বেগজনক নড়াচড়ার সময় ভারতেরও প্রয়োজন ছিল বাণিজ্য ক্ষেত্রে কিছুটা নমনীয় ভূমিকা গ্রহণ করে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ইতিমধ্যে প্রবল হওয়া অর্থনৈতিকভাবে গ্রাস হওয়ার আশঙ্কা দূর করার কামনায়। এমনকি এই প্রথম রপ্তানি আমদানির ৩০.৩ শতাংশে গিয়ে পেঁৗছায়। দ্রুতই কিন্তু দুই দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতাই আবার স্বাভাবিক রূপ নিতে থাকে। পরের বছরগুলোর চিত্র এমন :
বছর রপ্তানি আমদানি বাণিজ্য-ঘাটতি আমদানির তুলনায় রপ্তানি শতকরা হার
১৯৮০ ৮ ৫৫.৬ ৪৭.৬ ১৪.৪
১৯৮১ ২০.২ ৬৪ ৪৩.৮ ৩১.৬
১৯৮২ ২০.৩ ৪৩.৩ ২৩ ৪৬.৯
১৯৮৩ ৬.৯ ৩৭.৯ ৩১ ১৮.২
সব হিসাব মিলিয়ন মার্কিন ডলারে
এরপর '৮৪ এবং '৮৫ এ দুটি বছরের অস্বাভাবিক ব্যতিক্রম বাদ দিলে, যে দুই বছর আবার রপ্তানি ২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ছুঁয়েছিল এবং ভারতে রপ্তানির পরিমাণ আমদানির ৪৫ শতাংশের বেশি ছিল, পরের বছরগুলোতে ক্রমেই রপ্তানি হ্রাস কিংবা একই রকম থাকা কিংবা অতিসামান্য বৃদ্ধি পেতে থাকে, অন্যদিকে আমদানির তুলনায় রপ্তানির আনুপাতিক হার ক্রমাগত উচ্চতর হারে কমতে থাকে। '৮৮, '৮৯ ও '৯০_এই তিন বছরে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল যথাক্রমে ৮১.৩, ১২০.৭ ও ১৪৮ মিলিয়ন ডলার। এই তিন বছরে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৮.৭, ১০.৭ ও ২২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
আশির দশকজুড়ে বাণিজ্য-ঘাটতির এই প্রবল বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীর আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকীয় নীতি বাস্তবায়নের অতি উৎসাহের। একই সময়ে ভারত কিন্তু অন্য সব প্রতিবেশীর তুলনায় কম হারে নিজেদের বাজার বিশ্ববাজারের জন্য উন্মুক্ত করেছে। এরশাদের পতনের পর অন্য সরকারগুলোও শুল্কহার কমিয়ে বাজার উন্মোচনের প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখে। ১৯৯১ সালে স্বৈরাচারী এরশাদের পতন ঘটে, ক্ষমতায় আসে ভারতবিরোধী কথাবার্তা বলে মাঠ গরম করা বিএনপি। '৯১ থেকে '৯৫ সাল পর্যন্ত ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি, আমদানি, ঘাটতি ও শতকরা হারে খতিয়ানগুলো নেওয়া গেলে কিন্তু আগের ধারাবাহিকতাই ফুটে উঠবে :
বছর রপ্তানি আমদানি বাণিজ্য-ঘাটতি আমদানির তুলনায়
রপ্তানি শতকরা হার
১৯৯১ ২৩ ১৮৯ ১৬৬ ১২.২
১৯৯২ ৪ ২৮৪ ২৮০ ১.৪
১৯৯৩ ১৩ ৩৮০ ৩৬৭ ৩.৪
১৯৯৪ ২৪ ৪৬৭ ৪৪৩ ৫.১
১৯৯৫ ৩৬ ৯৯৪ ৯৫৮ ৩.৬
১৯৯৬ ২০ ১১৩৮ ১১১৮ ১.৮
সব হিসাব মিলিয়ন মার্কিন ডলারে
ভারতবিরোধী বিএনপির শেষ তিন বছরে ভারতে রপ্তানির পরিমাণ কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও আমদানি ইতিমধ্যেই লাফিয়ে লাফিয়ে আকাশ ছুঁয়েছে, শেষ বছরের তা প্রথমবারের মতো চার অঙ্কে পেঁৗছে। আমদানির তুলনায় শতকরা রপ্তানির হার ১.৮ শতাংশ।
এরপর আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী আওয়ামী লীগের আমল, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি বৃদ্ধির চিত্রটি কিন্তু রইল অটুট। তারপর আবারও বিএনপি এবং ভারত-বাংলাদেশের বাণিজ্য চিত্রে একই ধারবাহিকতা আমরা লক্ষ করব। সাধারণ জ্ঞাতব্য হিসেবে অঙ্কগুলো জরুরি, তাই তুলে দিচ্ছি।
বছর রপ্তানি আমদানি বাণিজ্য-ঘাটতি আমদানির তুলনায়
রপ্তানি শতকরা হার
১৯৯৭ ৩৭.২ ৭৯৫.৬ ৭৫৮.৪ ৪.৭
১৯৯৮ ৫৫ ১১৭৮.৮ ১১২৩.৮ ৪.৭
১৯৯৯ ৪৯.৫ ১০২৩.৮ ৯৭৪.৩ ৪.৮
২০০০ ৫০.১ ৯৪৫.৫ ৮৯৫.৩২ ৫.৩
২০০১ ৬০.৮ ১১৯৫.৫ ১১৩৪.৭ ৫.১
২০০২ ৩৯.৩ ১১৪৫.৮ ১১০৬.৫ ৩.৪
২০০৩ ৫২.৯ ১৪৮৮.৭ ১৪৩৫.৯ ৩.৬
সব হিসাব মিলিয়ন মার্কিন ডলারে
এই সংখ্যাগুলো কেবল পরিসংখ্যানই নয়, বাংলাদেশের অর্থনীতির রক্তক্ষরণ ও ক্রমাগত অপুষ্ট হওয়ার চিত্র।
এবার দেখা যাক, বাংলাদেশের এই ক্রমাগত রপ্তানি ঘাটতির প্রধানতম কারণ বাংলাদেশ-ভারত গড় শুল্কহারের বৈষম্য। ১৯৯২-২০০২ এই ১০ বছরের প্রাপ্ত শুল্কহারের একটা তুলনামূলক চিত্র নিচে উদ্ধৃত হলো :
বছর বাংলাদেশ ভারত
১৯৯১ ৮৮.৬ ৭৯.২
১৯৯২ ৫৭.৫ ৫৩
১৯৯৩ ৪৭.৪ ৪৭.৮
১৯৯৪ ৩৬ ৪৭.৮
১৯৯৫ ২৫.৯ ৪১
১৯৯৬ ২২.৩ ৩৮.৭
১৯৯৭ ২১.৫ ৩৫
১৯৯৮ ২০.৮ ৩০
১৯৯৯ ২০.৩ ৩২.৫
২০০০ ২১.৬ ৩১
২০০১ ১৭.১ ৩০.৯
২০০২ ১৭.১ ৩৩
খুবই কৌতূহলোদ্দীপক চিত্র, সন্দেহ নেই। কেবল '৯১ ও '৯২ সালে বাংলাদেশের গড় শুল্কের হার ভারতের চেয়ে বেশি ছিল, '৯৩ সালে তা ভারতের চেয়ে দশমিক ৪ শতাংশ কম। কিন্তু এর পর থেকে ধারাবাহিকভাবেই বাংলাদেশের শুল্কহার ভারতের চেয়ে অনেক বেশি হারে কমেছে। এই ধারা 'ভারতবিরোধী' বিএনপির শেষ বছরে অক্ষুণ্ন থেকে পরবর্তী 'মুক্তিযুদ্ধপন্থী' আওয়ামী লীগ সরকার এবং পরবর্তী সময়ে আবারও ক্ষমতায় আসা বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলেও অব্যাহত থাকে।
এ সব কিছুর পরিণতিতে গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য সম্পর্ক যা দাঁড়িয়েছে, পত্রিকান্তরে প্রকাশিত একটি ছক পাঠকদের জন্য সুবিধাজনক হবে বিবেচনায় তুলে দেওয়া হলো।
স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের অর্থনীতিকে কবজা করতে সক্ষম হওয়া ভারতের সঙ্গে '৮০-৮৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের বাণিজ্য বৃদ্ধির হার ছিল শতকরা ৯.৭২ শতাংশ, '৮৫-৯০ পর্যন্ত এই বৃদ্ধির হার ছিল ২০.৬৩ শতাংশ। '৯০-৯৫ সালে এই বৃদ্ধির হার ছিল ৮৭.২৯! এই বৃদ্ধির হারের পুরোটাই ছিল বাংলাদেশের বিপক্ষে, কেননা এই সময়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতের আমদানির তুলনায় ভারত থেকে বাংলাদেশের আমদানি বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এটাও খেয়াল করা দরকার যে অর্থনৈতিক সম্পর্কের এই ধারাবাহিক অধীনতার বিষয়ে কোনো সরকারই কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেয়নি।
বাংলাদেশ-ভারত অর্থনৈতিক সম্পর্কের আর একটি দিক হলো উভয়ের রপ্তানি পণ্যের ধরন। বাংলাদেশ খুব সামান্য পরিমাণে প্রক্রিয়াজাত পণ্য ভারতে রপ্তানি করে। অধিকাংশই কাঁচাপাট, হিমায়িত মাছ বা রাসায়নিক সারের মতো কাঁচামালনির্ভর পণ্য। প্রায় সব রপ্তানি ৫-১০টি ক্ষেত্রে ঘনীভূত। অন্যদিকে ভারতের রপ্তানি পণ্যের বৈচিত্র্য এবং পরিমাণ উভয়ই বিশাল। কয়েক হাজার ধরনের পণ্য ভারত থেকে বাংলাদেশে আমদানি করা হয়। সাপটা অনুযায়ী পরস্পরের পণ্য অগ্রাধিকার পাওয়ার জন্য পণ্যটির অন্তত ৫০ শতাংশ স্থানীয় উৎসজাত হওয়ার আইনটিকে আপাতদৃষ্টে যতই নিরীহ মনে হোক না কেন, ভারতের পক্ষেই সেটি কাজ করেছে, কেননা বিশালাকৃতি ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের কারণে ভারতেরই সর্বাধিক পরিমাণ কাঁচামাল নিজের শিল্পপণ্যের জন্য সরবরাহে সক্ষম। কিন্তু শুধু কি শুল্ক বাধা? সম্প্রতি ভারত আরো অনেক বাংলাদেশি পণ্যের জন্য শুল্কমুক্ত প্রবেশের সুযোগ দিয়েছে, এই সংবাদেও সংশ্লিষ্ট রফতানিকারকরা খুব বেশি আহ্লাদ প্রদর্শন করেননি। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত সংবাদে কেউ কেউ আনন্দ প্রকাশ করলেও রপ্তানিকারকরা বেশ সতর্কতার সঙ্গেই কথা বলেছেন। এই সর্বশেষ বাজারসুবিধা প্রদান বিষয়ে ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বক্তব্য দেওয়া যাবে, কিন্তু এই শুল্ক প্রত্যাহারই যথেষ্ট নয়। যেকোনো রফতানিকারক ভারতে আরো অনেক গুণ বেশি অশুল্ক বাধার সম্মুখীন হন। আমদানি শুল্কের পরও তাদের কাস্টমস ভ্যালুয়েবল ডিউটি, শিক্ষা কর ইত্যাদি সমেত মোট ৩২টির মতো শুল্ক প্রদান করতে হয়।

চীনা কামান!
বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তাদের নতুন আতঙ্ক হিসেবে ৯০-এর পর দ্রুত আবির্ভূত হয়েছে সস্তা চীনা পণ্য। রক্ষণ শুল্কের আড়ালে দ্রুত উৎকর্ষ লাভ করা চীনা পণ্য দ্রুত আন্তর্জাতিক বাজারে শক্তিশালী হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে শুল্কহার কমানো দরিদ্র দেশগুলোর শিল্পভিত্তি ধ্বংস করে দিয়েছে অনায়াসে। ভারতের সঙ্গে যেমন বাংলাদেশের বাণিজ্য-ঘাটতির বড় অংশ ভারতীয় রপ্তানিকারকদের পরিবহন ব্যয় খুবই কম হওয়া এবং বন্দরে শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ ঘটে, চীনের ক্ষেত্রে এর প্রধানতম কারণ পণ্যের সুলভ মূল্য। ভারত থেকে যেমন বিপুল পরিমাণে কৃষিপণ্যও আমদানি করা হয়, চীনের বেলায় তার বড় অংশই শিল্পপণ্য। এগুলোর বড় অংশ দেশেই উৎপাদন সম্ভব। বাংলাদেশের বাজারে চীনের এই দখলাভিযান বিষয়ে ভারতীয়রাও যে উদ্বিগ্ন, তার নিদর্শন পাওয়া গেল অর্থনীতির ভারতীয় একজন অধ্যাপকের প্রতিবেদনে। সব হিসাবে বাংলাদেশে ভারতের রপ্তানি যখন বিপুল হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, তখন তাঁর হিসাব অনুযায়ী কিন্তু বাংলাদেশে চীনের তুলনায় ভারতের রপ্তানির পরিমাণ কমেছে! ২০১০ সালে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য-ঘাটতি ৩.৮ বিলিয়ন ডলার। প্রতিরোধমূলক শুল্কব্যবস্থা ছাড়া সে ক্ষেত্রে ভারত ও চীনের এই যৌথপণ্য আগ্রাসন থেকে দেশি শিল্পকে বাঁচানোর কোনো উপায়ই নেই। অন্যথায় অচিরেই (ইতিমধ্যেই অনেকটা) বাংলাদেশের শিল্পখাতের পরিমান হবে বিশ্ব-উৎপাদনব্যবস্থার ফাঁকফোকরে কিংবা পরিবেশগত বা অন্যান্য কারণে অচ্ছুৎ বলে প্রতিষ্ঠা পাওয়া কিছু খাত, যা আবার সর্বদাই সরকারি নীতি বদলের কারণে নিত্যনতুন হুমকির মুখে থাকবে।

ভারতবিরোধী রাজনীতির সমীকরণ
গত সপ্তাহ দুয়েকের বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মোড় সম্ভবত বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার আচমকা ভারতবিরোধী 'কথার কামান বহর' আকস্মিক নতুন করে সক্রিয় হয়ে ওঠা। সরকারি দলের বিরুদ্ধে ট্রানজিট, বাণিজ্য-ঘাটতি, রামপালের বিদ্যুৎকেন্দ্রের সম্ভাব্য পরিবেশ বিপর্যয় প্রভৃতি প্রসঙ্গে তিনি জনগণকে সজাগ হওয়ার আহ্বান জানান। প্রসঙ্গগুলোর সত্য-মিথ্যার হিসাব এক, কিন্তু আরো জরুরি হলো, ভারতবিরোধী অনুভূতির তাসটি খালেদা জিয়া দেরি না করেই ব্যবহার করেছেন। অথচ মাত্র কিছুদিন আগেও, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময়েও, এসব বিষয়ে প্রায় নীরব ছিলেন তিনি ও তাঁর দল। একই প্রসঙ্গগুলো যদিও আলোচিত হচ্চ্ছ অনেককাল ধরেই।
এটা কোনো কাকতালীয় নয়, যে মূহূর্তে বিএনপি আন্দোলনের মাঠ গরম করা বিরোধী দল হিসেবে বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছে, একই সঙ্গেই তার অন্যতম বক্তব্যের একটা প্রধান অংশ ভারতকে কেন্দ্র করেই ঘুরপাক খাচ্ছে। শাসক দলের লুণ্ঠন, দুর্নীতি, দলীয়করণ, জ্বালানি সংকট, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পাশাপাশি বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কও বারবার ঘুরে-ফিরে বলার কারণ নানা ঐতিহাসিক বাস্তবতায় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের জটিলতার মধ্যে এমন অনেক প্রসঙ্গই আছে, যেগুলো জনগণের স্মৃতি এবং বাস্তব জীবনে জোরালো আবেদন তৈরি করতে পারে। টিপাইমুখ বাঁধ বা ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট প্রশ্নে সরকারের মন্ত্রী ও উপদেষ্টাদের তথ্য গোপন করা, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা কিংবা যথাসম্ভব ভারতীয় পক্ষের সাফাই গাওয়ার ভূমিকায় জনগণের আত্মমর্যাদাবোধে যে আঘাত লেগেছে, তার রাজনৈতিক গুরুত্বও অপরিসীম। বিশেষ করে ট্রানজিটের প্রশ্নে দেখাই গেল যে শুরুতে বিশাল লাভের কথা বলা হলেও আদতে বাংলাদেশকে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হবে ট্রানজিটের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণে, অথচ এখান থেকে লাভ কী হবে বা আদৌ কিছু হবে কি না তা কেউই পরিষ্কার বলছেন না।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ধারাবাহিকতার প্রশ্নে গুরুতর কোনো পার্থক্য শাসক দলগুলো তাই দেখাতে সক্ষম না হলেও (্একই সঙ্গে লুটেরা শাসনব্যবস্থা, বিশ্বপুঁজিবাদের সঙ্গে গাঁটছড়া প্রভৃতি বিষয়ে অভিন্ন হলেও) বাংলাদেশে ভারত প্রশ্নটি নিছক অর্থনীতির সীমানা ছাড়িয়ে রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়ায়। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক প্রশ্নে যে গড় চিন্তাগুলো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সমাজে হাজির দেখা যায়, সেগুলো মোটামুটি এমন :

মার্কিন ছায়া> ভারতকে প্রতিরোধ (গড়ে বিএনপি)

মার্কিন ছায়া> পাকিস্তান, মৌলবাদ প্রতিরোধ
(গড়ে আওয়ামী লীগ)

ভারতীয় ছায়া> মার্কিনকে প্রতিরোধ (সাবেক মস্কোপন্থী বামপন্থী কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ, শেষ বিচারে আওয়ামী-বৃত্তে বন্দি)

চীনা+পাকিস্তানি ছায়া> ভারতকে প্রতিরোধ
('পুবমুখী কূটনীতির উদ্গাতা বামপন্থীদের আরেকাংশ, শেষ বিচারে বিএনপি-বৃত্তের সাফাই)

প্রথম দুটি অংশই অধিক শক্তিশালী এবং অধিকতর প্রতিনিধিত্বশীল এবং উভয়েরই এই একটা মজার বৈশিষ্ট্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে এদের কেউ ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ঠেকানোর আওয়াজ দেয়, একই শক্তির বলে বলীয়ান হয়ে আরেক দল মৌলবাদবিরোধী হুঙ্কার ছাড়ে। এদেরই গৌণ-সহগামী একদল রুশ-ভারত মৈত্রীর হ্যাঙওভারে আক্রান্ত থেকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আর মৌলবাদকে ঠেকাতে ভারতীয় গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতার মিথ্যাচারকে আঁকড়ে ধরে, আরেক দল ভারতকে প্রতিরোধ করার স্বপ্ন দেখে চীন আর পাকিস্তানের আশ্রয়ে। স্বাধীন এবং নিজের পায়ে দাঁড়ানো রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতে এদের সবাই সংগত কারণেই অক্ষম। পরের দুই দল গৌণ বটে, কিন্তু প্রথম দুই দল জনগণকে দু-দুটো অর্ধসত্য দিয়ে বিভক্ত করে রেখেছে। আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধের ব্যবসায় আর বিএনপির ভারতবিরোধিতায় তাই জনগণ উপায়হীনভাবেই ছোটাছুটি করে চলেছে, যতক্ষণ না তাদের মধ্য থেকেই দেশীয় উৎপাদিকা শক্তির মুক্তি ঘটানোর কর্মসূচি-সংবলিত নতুন, পাল্টা শক্তির আবির্ভাব ঘটে।

No comments

Powered by Blogger.