শেয়ারবাজার নিয়ে সেমিনারে মত-এসইসি ব্যর্থতা ঢাকতে চাইছে সরকারও কিছু আড়াল করছে

'তদন্ত প্রতিবেদনে যেসব ব্যক্তির কাছ থেকে সতর্ক থাকতে বলেছিলাম, সরকার তাঁদের ওপর শেয়ারবাজার ঠিক করার দায়িত্ব দিল। এতে বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট হয়েছে। শেয়ারবাজার বর্তমানে আস্থার সংকটে ভুগছে। অথচ পুঁজির সংকট দেখিয়ে বাজার স্থিতিশীল করতে এসইসি প্রধানমন্ত্রীকে সম্পৃক্ত করেছে। নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করতেই তারা এটা করেছে।' এমন অভিমত ব্যক্ত করেছেন পুঁজিবাজারের কারসাজির ঘটনা অনুসন্ধানে গঠিত


তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। গতকাল সোমবার সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) উদ্যোগে ব্র্যাক সেন্টারে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ইব্রাহিম খালেদ বলেন, শেয়ারবাজারে কিছু হলে এর দায় এসইসির। পৃথিবীতে এমন একটা নজির নেই, যেখানে শেয়ারবাজার ঠিক করতে প্রধানমন্ত্রীকে চার ঘণ্টা বৈঠক করতে হয়। তিনি বলেন, এখানে তারল্য সংকট মূল বিষয় নয়। তারল্য সংকটের কথা বলা হচ্ছে অন্য কোনো গেম খেলার জন্য। সরকার হয়তো তারল্য সংকটের কথা বলে কোনো কিছু আড়াল করতে চাইছে।
তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করার ১১ মাস পর নিজের তদন্ত প্রতিবেদন সম্পর্কে গতকাল খোলামেলা কথা বললেন ইব্রাহিম খালেদ। তিনি বলেন, "আমরা যখন তদন্ত করছিলাম তখন আমাদের বলা হয়েছিল, সাত দিনের মধ্যে তা প্রকাশ করা হবে। কিন্তু সেদিন বিকেলেই টেলিভিশনে দেখলাম অর্থমন্ত্রী বলছেন, 'তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা যাবে না। কেননা এই প্রতিবেদনে অনেক নামিদামি শক্তিশালী লোক জড়িত।' তখনই বুঝেছিলাম তদন্ত প্রতিবেদনটি ১৯৯৬ সালের তদন্ত প্রতিবেদনের পরিণতি লাভ করতে যাচ্ছে। আজ সেটা প্রমাণিত হয়েছে।"
পুঁজিবাজারের বর্তমান অবস্থা এবং সর্বশেষ উদ্যোগগুলো নিয়ে আয়োজিত সংলাপে সিপিডির ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
সভাপতিত্ব করেন। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
সেমিনারে সরকারদলীয় সংসদ সদস্য অধ্যাপক আলী আশরাফ বলেন, 'ইব্রাহিম খালেদের তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে জাতীয় সংসদে নির্ধারিত বিতর্ক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নোটিশ দিয়ে কোনো বিতর্ক হয়নি। তদন্ত প্রতিবেদন সরকার গ্রহণ করল, না বর্জন করল সেটা বুঝিনি। এত বড় তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি হলো কিন্তু কাউকে শাস্তি দেওয়া হলো না।'
মূল প্রবন্ধে ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, '৩৩ লাখ বিও অ্যাকাউন্ট থাকলেও পাঁচ লাখ বাজার থেকে চলে গেছে, বাকি ২৮ লাখের মধ্যে ১১ লাখ বিও অ্যাকাউন্টধারী বাজারে সক্রিয় রয়েছেন। আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, সার্বিকভাবে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি ছিল। বিভিন্ন জায়গা থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো আবার ভুলে যাওয়া হয়েছে। আবারও নতুন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলো পুঁজিবাজার থেকে যে টাকা নিয়েছে সেটা ফিরিয়ে এনে বাজার ঠিক করার কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।'
সভাপতির বক্তব্যে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, 'নীতি কাঠামোর দুর্বলতায় বাজারে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। শেয়ারবাজারের সমস্যা সমাধানে নানাভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে। বিভিন্ন সংস্থা থেকে প্রায় অর্ধডজন পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী উদ্যোগ নিয়েছেন। আমাদের দেখতে হবে, এত উদ্যোগ নিলেও তা কার্যকর হচ্ছে না কেন।'
সেমিনারে অংশগ্রহণকারীরা ঢাকা স্টক এঙ্চেঞ্জের সদস্যপদ কুক্ষিগত করে না রেখে এর সংখ্যা এক হাজারে উন্নীত করার কথা বলেন। আলোচনায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে আরো ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সাবেক এসইসি চেয়ারম্যান মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ফজলুল আজিম, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর এবং সরকারের পুঁজিবাজারসংক্রান্ত বিশেষ কমিটির প্রধান ড. ফরাসউদ্দিন আহমেদ, পূবালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান হাফিজ মজুমদার, এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী, সাবেক অর্থসচিব সিদ্দিকুর রহমান, সাবেক বাণিজ্যসচিব সোহেল আহমেদ চৌধুরী, দুই স্টক এঙ্চেঞ্জের নেতারাসহ অনেকে।
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, 'আমরা সবাই একে অন্যের ঘাড়ে দায়িত্ব চাপাতে চাইছি। এসইসি আইনগতভাবে স্বাধীন। এসইসিকে তা পরিপালন করতে হবে।' তিনি আরো বলেন, 'বাজার বটম লাইনের কাছাকাছি চলে এসেছে। বাজার অবশ্যই ঘুরে দাঁড়াবে। ডিসেম্বরের ক্লোজিং শেষ হলে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংক-বীমাসহ প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ শুরু হবে। তখন বাজার স্বাভাবিক হয়ে উঠবে।'
ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, '১৯৬৪ সালে ডিএসইর যে সদস্যপদের দাম ছিল পাঁচ হাজার টাকা, এখন তা ১০০ কোটি টাকা। ডিএসইতে ২০০ সদস্য আছেন, এর মধ্যে ২৫-৩০ জন পাকা খেলোয়াড়। তাঁরা যখন খুশি বাজার তোলেন, আবার যখন খুশি বাজার ফেলেন।

No comments

Powered by Blogger.