আন্তর্জাতিক-পাক-মার্কিন সম্পর্কের বর্তমান অবস্থা by বদরুদ্দীন উমর

পাকিস্তানের পররাষ্ট্র নীতিনির্ধারণ ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী তাদের সরকারের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এ নিয়ে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সরকারের দ্বন্দ্বও কোনো কোনো সময় দেখা যায়। তবে সামরিক বাহিনীর কথার একেবারে বাইরে গিয়ে পাকিস্তান সরকার কিছু করতে পারে না। এদিক দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তার ক্ষমতার জানান মাঝে মধ্যেই দিয়ে থাকে। এ জন্য শুধু সরকারই নয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গেও বিভিন্ন


বিদেশি শক্তি, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বতন্ত্রভাবে যোগাযোগ রক্ষা ও মতবিনিময় করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানী ১১ ডিসেম্বর বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তারা আফগানিস্তানে রসদ ও যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোকে যে সুবিধা দিয়ে এসেছেন তা বন্ধ রাখা হয়েছে। তিনি এ প্রসঙ্গে আরও বলেছেন, কয়েক সপ্তাহ ধরে পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্ত বন্ধ রাখাই শুধু নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পাকিস্তান তার আকাশপথ যেভাবে ব্যবহার করার অনুমতি দিয়ে এসেছে সে অনুমতি প্রত্যাহার করার চিন্তাও তারা করছেন। পাকিস্তান এমন এক দেশ যেখানে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সামরিক বাহিনী নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে সমান্তরালভাবে রাজনৈতিক ও বৈদেশিক বিষয়ে তাদের বক্তব্য এবং নির্দেশ প্রদান করে থাকে। বর্তমানে পাকিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে সে প্রসঙ্গে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এক বিবৃতিতে বলেছে, তারা বালুচিস্তানের শামসি বিমান ঘাঁটি যেভাবে মার্কিন সরকার ও সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করতে দিয়েছিল, সেভাবে তারা এই বিমান ঘাঁটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীকে আর ব্যবহার করতে দেবে না। ইতিমধ্যেই তারা মার্কিন সরকারকে বলেছে শামসি বিমান ঘাঁটি থেকে মার্কিন বিমান ও সাজসরঞ্জাম সরিয়ে নিতে। সে অনুযায়ী মার্কিন বিমান বাহিনী তাদের বিমান এবং অন্যান্য সরঞ্জামসহ শামসি বিমানবন্দর পরিত্যাগ করেছে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র নীতিনির্ধারণ ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী তাদের সরকারের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এ নিয়ে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সরকারের দ্বন্দ্বও কোনো কোনো সময় দেখা যায়। তবে সামরিক বাহিনীর কথার একেবারে বাইরে গিয়ে পাকিস্তান সরকার কিছু করতে পারে না। এদিক দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তার ক্ষমতার জানান মাঝে মধ্যেই দিয়ে থাকে। এ জন্য শুধু সরকারই নয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গেও বিভিন্ন বিদেশি শক্তি, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বতন্ত্রভাবে যোগাযোগ রক্ষা ও মতবিনিময় করে।
বিগত মে মাসে মার্কিন বিমান বাহিনী পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনীর সম্পূর্ণ অজ্ঞাতসারে ওসামা বিন লাদেনকে যেভাবে হত্যা করে এবং তার লাশসুদ্ধ তুলে নিয়ে যায়, তাতে পাকিস্তান সরকারের ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এ দুই রাষ্ট্রে পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তখন থেকেই টানাপড়েন চলতে থাকে। এ ছাড়া পাকিস্তানের অভ্যন্তরে একাধিকবার মার্কিনের ড্রোন বা চালকবিহীন বিমান থেকে বোমাবর্ষণে সামরিক ও বেসামরিক পাকিস্তানিরা হতাহত হয়। সর্বশেষ এই ধরনের ঘটনায় সীমান্ত এলাকায় পাকিস্তানের অভ্যন্তরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন বিমান হামলায় ২৪ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। এ ঘটনা পাকিস্তান সরকার ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সম্পর্কে যেভাবে বড় রকম ফাটল সৃষ্টি করেছে এটা ইতিপূর্বে দেখা যায়নি।
পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী এক বিবৃতিতে বলেছে, তাদের নির্দেশ অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেলুচিস্তানে অবস্থিত শাসমি বিমান ঘাঁটি ত্যাগ করেছে এবং তারা সেই ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিয়েছে। এর থেকে বোঝা যায় যে, পাকিস্তানের মাটিতে এতদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনী একটি ঘাঁটি তৈরি করে সেটি সম্পূর্ণভাবে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকাতে বোমাবর্ষণ করে এসেছে তাদের 'সন্ত্রাসবিরোধী' অভিযানের অংশ হিসেবে। পাকিস্তান অন্য একটি রাষ্ট্রকে নিজেদের মাটিতে বিমান ঘাঁটি তৈরি করে সন্ত্রাসবাদ দমন করার অজুহাতে যেভাবে তাদের আফগান যুদ্ধে ব্যবহার করতে দিয়েছে, এটা একটি দেশের জন্য কলঙ্কজনক ব্যাপার। পাকিস্তান সরকার ও সামরিক বাহিনী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তাদের দেশের সার্বভৌমত্ব কীভাবে ইজারা দিয়ে এসেছে এটা তারই এক উল্লেখযোগ্য, এমনকি প্রামাণ্য দৃষ্টান্ত।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি পাকিস্তানের নতজানু নীতি ও কার্যকলাপের সুযোগ যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পুরোপুরি নেবে এটা স্বাভাবিক। এই 'স্বাভাবিক' কাজটি করতে গিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার ও তাদের সামরিক বাহিনী পাকিস্তানকে যেভাবে ব্যবহার করেছে, সেই দেশের অবস্থা সব দিক দিয়ে সংকটাপন্ন করেছে, ধ্বংসের দোরগোড়ায় তাদের এনে দাঁড়িয়েছে এটা সকলেই দেখছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা, বিশেষ করে তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি এবং মার্কিন সামরিক বাহিনীর প্রধান যেভাবে সন্ত্রাস দমনের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের ভূমিকার ব্যাপারে নিজেদের অসন্তুষ্টি জানিয়ে যাচ্ছেন ও পাকিস্তানকে 'সন্ত্রাস' দমনে আরও কঠোরভাবে এগিয়ে আসার জন্য চাপ সৃষ্টি করছেন এটা থেকে উভয়ের সম্পর্ক যে মালিক ও গোলামের সম্পর্কের মতোই দাঁড়িয়েছে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। যেভাবে পাকিস্তান নিজেদের জনগণের স্বার্থ, দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের সাম্রাজ্যবাদী আফগান যুদ্ধে সহায়তা করছে এবং মার্কিন সরকার ও সামরিক বাহিনীর নির্দেশ মান্য করে এসেছে, তাতে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে যে মালিকসুলভ ব্যবহার করবে এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু সবকিছুরই সীমা আছে। কাজেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে পাকিস্তানের জনগণ তো বটেই, এমনকি সামরিক বাহিনীর লোকদেরও অবাধে খুন করছে। এ কারণে পাকিস্তানের জনগণ আজ ব্যাপকভাবে মার্কিনবিরোধী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তান সরকারের সম্পর্ক যাই হোক, বর্তমানে পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা যেভাবে দেখা যায় সেটা এত ব্যাপকভাবে অন্য কোনো দেশের জনগণের মধ্যে দেখা যায় না। মার্কিন সরকার ও সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকার ও সামরিক বাহিনীর যে বিদ্রোহী অবস্থান এখন দেখা যাচ্ছে তার মধ্যে জনগণের ব্যাপক মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতারই প্রতিফলন ঘটছে। জনগণের এই অবস্থান ও তাদের এই প্রতিক্রিয়া যদি না থাকত, তাহলে পাকিস্তান সরকার ও সামরিক বাহিনীর এই 'গোলাম বিদ্রোহ' এখন যে পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে সেটা এভাবে দেখা যেত কি-না সে বিষয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে।
পাকিস্তান যদি তার সীমান্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর জন্য বন্ধ করে দেয়, তাহলে এই সাম্রাজ্যবাদীরা যে কত বড় সংকটের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হবে এটা সকলেরই জানা। কাজেই এই সরবরাহ লাইন অনির্দিষ্টকাল বন্ধ রাখা পাকিস্তানের পক্ষে কতখানি সম্ভব হবে এটাই দেখার বিষয়। মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর কিছু অস্ত্র ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম আফগানিস্তানে ঢোকে তাদের উত্তর সীমান্ত দিয়ে। কিন্তু তাদের মূল সরবরাহ লাইন হলো পাকিস্তান সীমান্তে। এই সীমান্ত যদি পাকিস্তান সত্যি সত্যিই বন্ধ রাখে তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রায় ষাট বছরের মৈত্রী ও গাঁটবন্ধন সম্পর্ক ছিন্ন হবে। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পাকিস্তানে সামরিক হামলা পরিচালনার সম্ভাবনা হিসেবে বাতিল করা যায় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের যুদ্ধ জোট ন্যাটো যেভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন ইচ্ছামতো সামরিকসহ সব ধরনের হামলা বেপরোয়াভাবে চালিয়ে যাচ্ছে তাতে শুধু হাত মোচড়ানো নয়, পাকিস্তানে তাদের সামরিক হামলা পর্যন্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাতিল করা যায় না।
১২.১২.২০১১

No comments

Powered by Blogger.