নিজ বাড়িতে এক যুগ স্বেচ্ছাবন্দি দুই ভাই!

নিজেদের বাড়িতে প্রায় এক যুগ স্বেচ্ছাবন্দি ছিলেন দুই ভাই। পরিবারের অন্যদের সঙ্গে তারা কথা বলতেন না। খেতেন না ঘরে রান্না খাবার। হোটেল থেকে খাবার আনাতেন। অতি প্রয়োজনে কাগজে লিখে মনোভাব প্রকাশ করতেন। এ দুই ভাই বগুড়া শহরের মালতীনগর চাঁনমারী ঘাট এলাকার বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত খাদ্য কর্মকর্তা আবদুল লতিফ সরকারের ছেলে এসএম ফজলুল করিম মানিক এবং এসএম নুরুন্নবী রতন। গতকাল সোমবার লম্বা চুল,


দাড়ি ও গোঁফে ঢাকা দুই সহোদরকে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের সহায়তায় উদ্ধার করেন মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) বগুড়া শাখার কর্মীরা। চিকিৎসার জন্য তাদের বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
এদিকে দুই সহোদরের স্বেচ্ছাবন্দির ব্যাপারে তাদের বাবা, খালা, চাচাসহ আত্মীয়স্বজনের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। তাদের মা ফাতেমা খাতুন
১২ বছর ধরে অপ্রকৃতিস্থ।
মানিক ও রতনের খালা রাবেয়া খাতুন লাকি সব কিছুর জন্য ভগি্নপতি লতিফ সরকারকে দায়ী করে সাংবাদিকদের বলেন, 'তিনি দুই ছেলের ওপর দিনের পর দিন নির্যাতন চালিয়ে তাদের মানসিকভাবে অসুস্থ করেছেন। একইভাবে নির্যাতন চালিয়ে তিনি তার স্ত্রীকেও (লাকির বড় বোন) মানসিক ভারসাম্যহীন করে ফেলেছেন।'
আবদুল লতিফ সরকারের সন্দেহ, তার দুই ছেলেকে 'তাবিজ' করে অসুস্থ করে রাখা হয়েছে। এ জন্য তিনি নিজের ছোট ভাই ও তার স্ত্রী (মানিক-রতনের খালা) এবং আরেক শ্যালিকা লাকিকেও দায়ী করেন। জমিজমা আত্মসাতের জন্যই তারা এটি করেছেন বলে অভিযোগ তার।
পুলিশ ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আবদুল লতিফ খাদ্য বিভাগে কর্মরত থাকা অবস্থায় খালাতো বোন ফাতেমা খাতুনকে বিয়ে করেন। তার এক শ্যালিকার বিয়ে হয় ছোট ভাই স্বাস্থ্য বিভাগে কর্মরত হযরত আলীর সঙ্গে। আবদুল লতিফ ১৯৮৪ সালে মালতীনগর চানমারী ঘাট এলাকায় ১২ শতক জমি কিনে বসবাস শুরু করেন। কিছুদিন পর পাশে তার ছোট ভাই হযরত আলীকেও সাড়ে ৩ শতক জমি কিনে দেন। পেছনে তাদের শ্বশুর-শাশুড়ির বসতবাড়ি। ২০০৯ সালে অবসর নেওয়ার পর তিনি পেনশনের টাকায় একতলা বাড়ি নির্মাণ করেন।
বড় ছেলে এসএম ফজলুল করিম মানিক ১৯৯৬ সালে এসএসসি পাস করে বগুড়া সরকারি শাহ সুলতান কলেজে ভর্তি হন। পরে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নিলেও পাস করতে পারেননি। ছোট ছেলে এসএম নুরুন্নবী রতন শহরের প্রি-ক্যাডেট স্কুল থেকে ১৯৯৯ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে অকৃতকার্য হন। এরপর রতনের মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। প্রথমে বাড়ির সবার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেন। ছোট ভাইয়ের সেবা করতে গিয়ে এক সময়ে বড় ভাই মানিকও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। ডাক্তার দেখিয়েও লাভ হয়নি। একই বছর মানিক ও রতনের নানি মারা গেলে তাদের মা ফাতেমা খাতুন মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন।
আবদুল লতিফ দাবি করেন, বসতবাড়ির জায়গাজমির জন্যই তার ছেলেদের তাবিজ করা হয়েছে। টিউবওয়েলের পানিতে 'তাবিজ' রয়েছে এমন সন্দেহে রতন বাড়িতে রান্না করা কোনো খাবার খেত না। তিনি বলেন, 'আমার শাশুড়ি আমার ছোট ভাইসহ তার অন্য মেয়েদের নিয়ে একের পর এক ষড়যন্ত্র করেছেন। এখন সন্তানদের নির্যাতন এবং তাদের ঘরে আটকে রাখার অভিযোগ আনা হচ্ছে।'
আবদুল লতিফের চাচাতো ভাই বগুড়া বারের আইনজীবী নুরে আজম বাবু জানান, 'কোনো তাবিজ-কবজ নয় বা পারিবারিক শত্রুতাও নয়। মানিক ও রতন কেন যেন হঠাৎ করেই নিজেদের গুটিয়ে নেয়। তাদের অনেক চিকিৎসা করেও কাজ হয়নি।'
বগুড়া পৌরসভার ১১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সিপার আল বখতিয়ার জানান, 'দীর্ঘদিন ধরে ওই বাড়ির দুই ছেলে বের হয় না। তাদের এক আত্মীয় মানবাধিকার সংগঠনের কর্মীদের নিয়ে আমার কাছে আসে তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য।'
বগুড়া সদর থানার অফিসার ইনচার্জ খালেকুজ্জামান জানান, প্রাথমিকভাবে তদন্তে বাবার বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি।
বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মনোরোগ বিভাগের রেজিস্ট্রার ডা. ফজলুল বারী মিঠু জানান, মানিক ও রতন সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত। সাধারণত এ ধরনের রোগীরা নিজেদের সবার কাছ থেকে দূরে রাখতে পছন্দ করে। সবাইকে সন্দেহের চোখে দেখে এবং শরীরের কোনো যত্ন নেয় না। নিয়মিত চিকিৎসা নিলে মানিক-রতন সুস্থ হয়ে উঠতে পারে বলে জানান তিনি।

No comments

Powered by Blogger.