দূরের দূরবীনে-বাংলাদেশি অভিবাসীদের শীর্ষ অবস্থান : অস্ট্রেলিয়া বিজয় by অজয় দাশগুপ্ত

মাদের দেশের সমস্যা আর উন্নত দেশের সমস্যা এক নয়, যেমন সম্ভাবনাও। স্বাধীনতার বা বিজয়ের চলি্লশ বছর পরও আমাদের সংগ্রাম, যুদ্ধ ও প্রত্যাশা তিমিরভেদী হতে পারেনি। বলতে গেলে, এখনো মৌলিক চাহিদার বৃত্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, যাতায়াত বা অবকাঠামোর মতো বিষয়ে অবহেলা, উদাসীনতা, কর্মপরিকল্পনার অভাবে মানুষের জীবন ঘোর দুর্বিপাকে। এখানে তেমন নয়, যত মানুষ তত কাজ।
কিঞ্চিৎ অধিকও বটে। যে কারণে একজনের পক্ষে একাধিক কাজ বা উপার্জন খুব কঠিন কিছু নয়। কাজের রকমফেরও অভূত। দিনভর যিনি ব্যাংক ম্যানেজার, পোস্টাপিসের বড় বাবু, এয়ারলাইনসের কর্মকর্তা_সন্ধ্যা নামতেই তাঁর অন্য রূপ। তিনি তখন সুপারস্টোরের ক্যাশিয়ার, কোনো বড় মার্কেটের ট্রলি নিয়ন্ত্রক কিংবা নৈশপ্রহরী। কেউ বা কানে হেডফোন লাগিয়ে ইনস্যুরেন্স পলিসি বা ফোন বিক্রয়ের ব্যস্ত পরামর্শদাতা। চাকরি এখানে অর্থ উপার্জন ব্যতীত আর কোনো মর্যাদা বহন করে না। যদি করেও বা তা অতি উচ্চপর্যায়ে। আশ্চর্যের বিষয় এই, সেই উচ্চ পদ বা মর্যাদার সঙ্গে মন্ত্রী-মিনিস্টারদেরও কোনো সম্পর্ক নেই। তাঁরা মালটিন্যাশনাল বা বহুজাতিক কম্পানির প্রধান অথবা বাণিজ্যিক দিগন্তের স্বপ্নদ্রষ্টা সাধক কোনো উদ্যোক্তা। বাকিরা সবাই এক খোঁয়াড়ে। শ্রমমর্যাদার এই সমাজে বাঙালিরাও কিন্তু পিছিয়ে নেই। ক্ষুদ্র ব্যবসা, গ্রোসারি শপ বা কায়িক শ্রমের চাকরিতে নিজেদের কর্মকুশলতা প্রমাণ করে আজ আমরা প্রতিষ্ঠিত এক সম্প্রদায় বা জাতির তালিকায়। আমার অতি ঘনিষ্ঠ সহৃদয় এক বাঙালি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর কথাই বলি না কেন। সিডনির উপকণ্ঠে জমজমাট গ্রোসারি শপের ব্যবসা তাঁর। আক্ষরিক অর্থেই নাক চুলকানোর সময় নেই তাঁর। উপচেপড়া খদ্দের আর বাণিজ্য লক্ষ্মীর কৃপায় রমরমা অবস্থা। তবু খোশগল্প আর দেশের হালহকিকত নিয়ে তাঁর উদ্বিগ্নতা বা আগ্রহের শেষ নেই। সামান্য লেখালেখির সূত্রে আমার প্রতি একধরনের ভালোবাসা আছে তাঁর। তাঁর বদ্ধমূল ধারণা, সরকারি ও বিরোধী দলের হাঁড়ির খবর জানেন সাংবাদিকরা, এর কিয়দংশ আমার কাছেও পেঁৗছায়। কে তাঁকে বোঝাবে, আমাদের রাজনীতিবিদরা কারো ধার ধারেন না। তাঁরা নিজেরাই সর্বেসর্বা, নিজেরাই গ্রহণ, বর্জন ও রূপায়ণের একমাত্র মালিক। ওই যে আলাপচারিতা, সে জাতীয় এক ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে জানলাম খুব ভোরবেলা সেকেন্ড জবও করেন তিনি। তাঁর নিপুণ বর্ণনায় বোঝা গেল এই সেকেন্ড বা অতিরিক্ত কাজটি করেন বিপুল আনন্দে। ঘন কফির ধূমায়িত কাপে চুমুক দিতে দিতে এক থেকে দেড় ঘণ্টায় ব্যস্ত একটি ক্যাফের সাফ-সুতোরের কাজ শেষ। সূর্য ওঠার আগে পেঁৗছে যান, ঘণ্টা দেড়েক পর বাড়ি। সামান্য বিশ্রামের পর নিজের ব্যবসায় আগমন। কাজটি কথিত ক্লিনার বা পরিচার্যকের। আমাদের দেশের নাক উঁচু বুদ্ধিজীবী বা একধরনের শ্রেণীবিন্যাসিত এলিটজনরা প্রায়ই ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাঁদের মতে, আমাদের দেশের মেধার বিপুল অপচয় ঘটছে বিদেশে। যুক্তি হিসেবে তাঁরা ডিগ্রিধারী মানুষ, সার্টিফিকেটধারী বাঙালির কর্মপরিধি বা কাজকে চিহ্নিত করেন। অর্থাৎ গ্র্যাজুয়েট কেন ট্যাঙ্ িচালায়, প্রকৌশলী কেন হোটেল ম্যানেজার বা সাংবাদিক কেন রেলওয়ে গার্ড? বলা সহজ, বলার ওপর কোনো ট্যাঙ্ও নেই। কিন্তু নিজেদের চেহারাটা কেমন? রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স করছে পোস্টাপিসের করণিকের কাজ। ডাবল এমএ চালাচ্ছে টায়ার বা রবারের বিজনেস, বাংলায় পণ্ডিতজন আলো করেছেন ম্যাজিস্ট্রেটের পদ। সেও কি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, অদ্ভুত নয়? চাকরি ও শ্রমের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মর্যাদা এবং আইনকানুন মেনে চলার এক শ পার্সেন্ট এই দেশে চাকরির পদ বা গুরুত্ব সর্বক্ষেত্রে বড় বিষয় নয়। পরিচ্ছন্নতার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি, ইলেকট্রিশিয়ান ও কর্মকর্তার ভেতর আক্ষরিক অর্থেই কোনো ভেদাভেদ নেই। ভেদাভেদ যে নেই, সেটা চায়ের কাপ থেকে আড্ডার ঘনিষ্ঠতাতেই মূর্ত।
আমার বাঙালি বন্ধুটি সে কারণে বাণিজ্যে সার্থক হওয়ার পরও পরিচ্ছন্নতার কাজটি ছেড়ে দেননি। এ দেশে আগত তরুণ-তরুণী বিশেষত শিক্ষা ভিসায় আগতদের পরিশ্রম ও উপার্জনের বৃত্তিগুলোও চমকপ্রদ। ভিসার নিয়মানুযায়ী যিনি পড়াশোনা করেন, শিক্ষাকালীন বা প্রতিষ্ঠান চলাকালীন ফুলটাইম কাজ করতে পারেন না। তার কাজের সময় নির্দিষ্ট বা ঘণ্টা মাপা। যদি সে বিবাহিত বা বিবাহিতা না হয়, তাহলে তো আরো বিপদ। ওই প্রান্ত থেকে ফুলটাইম বা পার্টটাইম চাকরির অর্থ নেই। এরা তাই নৈশকালীন চাকরিগুলোয় ঝাঁপিয়ে পড়ে। আনন্দ-বিনোদনের জন্য দু-এক রাত ও দিন ব্যতীত বাকি সময়টা কাটে পড়াশোনার চাপে। অর্থ উপার্জনের এই নেশা মানুষকে একদিকে যেমন স্বাবলম্বী করে, অন্যদিকে করে তোলে ফালতু বিষয়ে আগ্রহহীন। জীবন ও জগতের অন্যান্য সৌন্দর্য, পর্যটন, ভালো পোশাক, খাদ্য, বাসগৃহ, আসবাব যখন নাগালে; জীবনও হয়ে ওঠে কান্তিময়, সুন্দর। জীবনের স্বভাবই হচ্ছে ভালোবাসা। ফলে একবার যখন জীবন নিজেই ভালোবাসার হয়ে ওঠে; রাজনীতি, মাস্তানতন্ত্র ও দুর্নীতির মতো জটিল বিষয়গুলো তখন দূরে হটতে শুরু করে। যে কারণে উন্নত দেশের রাজনীতিতে তারুণ্যের তেমন কোনো আগ্রহ নেই। মাঝেমধ্যে যে প্রতিবাদ বিক্ষোভ বা উত্তালতা, তার পেছনে হয় কোনো অমানবিক যুদ্ধ বা সংঘাত অথবা নিজেদের আর্থিক বা জীবনগত সমস্যা জড়িয়ে। অন্যথায় আমাদের দেশের মতো দল, দলবাজি কিংবা পার্টি-পলিটিঙ্ বলে কিছু নেই।
সুখবর এই_আমাদের নবীন প্রজন্ম, এমনকি দীর্ঘকাল ধরে বসবাসরত মধ্যবয়সীরাও এই কর্মচঞ্চলতায় অভ্যস্ত এক মানবগোষ্ঠী হয়ে উঠেছে। এ আমার মুখের কথা নয়, নয় ভবিষ্যদ্বাণী।
অস্ট্রেলিয়ান সরকারের সাম্প্রতিক তথ্যে তা বলা হয়েছে। বলাবাহুল্য, যেকোনো অভিবাসননির্ভর বা মিশ্র জাতিসত্তার দেশে জাতিগুলোর ভিন্ন ধরনের ইমেজ থাকে। সেই ইমেজ প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব সেসব দেশের মানুষগুলোর। অস্ট্রেলিয়া মনে করে, কথিত করণিক বা বৃত্তিভিত্তিক দপ্তরির প্রয়োজন নেই। উচ্চমানের কারিগরি দক্ষতা, বদলে যাওয়া নিয়মে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত পেশা আর সর্বোপরি হার্ডওয়ার্ক বা যার যার পেশাগত দক্ষতা আর নৈপুণ্যই মাপকাঠি। সে মানদণ্ডে আজ আমরা শীর্ষপর্যায়ে।
রাষ্ট্রদূত জেনারেল মাসুদউদ্দীন চৌধুরী ক্যানবেরাভিত্তিক ওয়েব কাগজের সাংবাদিক শাহদাত মানিকের প্রিয় অস্ট্রেলিয়া ডট কমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা জানিয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ান সরকার মনে করে, এ দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মপ্রবাহে সর্বোচ্চ মেধা ও শ্রম দানে অগ্রগামী বাংলাদেশি অস্ট্রেলিয়ানরা আছেন প্রথম সারিতে। অভিবাসনের দেশে অপরাপর দেশের অভিবাসীদের টপকে এ মর্যাদা লাভ ও অর্জন বিজয়ের মাসে বাঙালির অন্য আরেকটি বিজয়ও বটে।
এ বিজয়ের কৃতিত্ব ভোরবেলার পরিচ্ছন্নতাকর্মী, দুপুরের রোদে ঘর্মাক্ত দেহের সিকিউরিটি অফিসার, দণ্ডায়মান ব্যাংক টেলার, মেধাবী শিক্ষার্থী থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, অফিস-আদালত, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কর্মরত সব বাংলাদেশির। ট্যাঙ্চিালক, ছোট-বড় দোকানদার, রেস্তোরাঁ মালিক-কর্মচারী, বাংলাদেশি পুলিশ, ছাত্র, গৃহবধূ, শিশু ও বৃদ্ধদের কর্তব্যনিষ্ঠা, আইনপ্রীতি আর কর্মযজ্ঞেই এই অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব হয়ে উঠেছে।
আমরা যে চাইলেই পারি_এটা তারও এক বড় উদাহরণ। বিজয়ের মাসে স্যালুট জানাই তাঁদের।

লেখক : সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক
dasguptaajoy@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.