হাসপাতালে নিরাপত্তা-দায়িত্বহীনতার আগুন যেন দগ্ধ না করে

হাসপাতালে মানুষ ভর্তি হয় জীবন বাঁচাতে কিংবা অসুখ থেকে নিরাময় বা রেহাই পেতে। বাস্তবে এমন প্রত্যাশা পূরণ নাও হতে পারে। রোগব্যাধি নিরাময় অযোগ্য হলে কিংবা ভুল চিকিৎসার কারণেও আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্নের পরও রোগীর মৃত্যু অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু ভারতের কলকাতা শহরের 'আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন' হিসেবে পরিচিত এএমআরআই হাসপাতালের অগি্নকাণ্ডে যেভাবে নব্বইয়ের অধিক রোগীর মৃত্যু ঘটেছে তা অভাবনীয়।


মৃতদের মধ্যে বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জের এক রোগীও রয়েছেন। এ ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকে বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষেরও শিক্ষা নেওয়ার রয়েছে। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যয়ে সরকারের ভর্তুকি থাকে, তাই দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত রোগীদের প্রচণ্ড ভিড়। কোনো কোনো ওয়ার্ড ও সংলগ্ন বারান্দায় এত রোগী থাকে যে স্বাভাবিক সময়েই দম বন্ধ হওয়ার অবস্থা। অগি্নকাণ্ড কিংবা এ ধরনের মারাত্মক দুর্ঘটনা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কিংবা স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মতো ভিড়াক্রান্ত প্রতিষ্ঠানের শত শত রোগীর বেঘোরে প্রাণ সংশয়ের কারণ ঘটাতে পারে। বেসরকারি ক্লিনিক-হাসপাতালগুলো ব্যয়বহুল, কিন্তু সেখানে অগি্ননিরাপত্তা বিধিগুলো যথাযথভাবে পালন করা হচ্ছে কি-না তা নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো কর্তৃপক্ষের অভাব যে প্রকট তাতে সন্দেহ করা চলে না। রাজধানী ঢাকার অনেক বেসরকারি হাসপাতাল এখন রোগীর ভিড়ে সর্বক্ষণ সরগরম থাকে। প্যাথলজি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্যও ভিড় হয়। পান্থপথ ও গ্রীন রোড এলাকায় কয়েকটি বড় বড় বেসরকারি ক্লিনিক সংলগ্ন সড়কে যানজট এতই প্রকট যে, কোনো রকম দুর্ঘটনা ঘটলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি কিংবা রোগীদের দ্রুত সরিয়ে নিতে অ্যাম্বুলেন্সের সেখানে সহজে পেঁৗছানোর উপায় নেই। ক্লিনিকের অভ্যন্তরে অগি্ননির্বাপক ও অন্যান্য জরুরি নিরাপত্তা ব্যবস্থা কতটা সচল তাও প্রশ্নবিদ্ধ। হয়তো কাগজে-কলমে সবই ঠিক, কিন্তু কে না জানে যে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে সরকারি পরিদর্শক দল কখনও হাজির হলে তাদের খুশি করে বিদায় দেওয়ার উপায় সবারই জানা। রাজধানীতে শুধু হাসপাতাল নয়, এখন বহুতল ভবনেরও ছড়াছড়ি। নতুন ঢাকাতে তো আছেই, ঘিঞ্জি হিসেবে অভিহিত পুরান ঢাকার দিগন্তও এখন বদলে যাচ্ছে। কোনো অগি্নকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের কমন অভিযোগ_ তাদের গাড়ি চলাচলের পথ সংকীর্ণ কিংবা আদৌ নেই। সুউচ্চ আধুনিক ভবন নির্মাতারাও বিন্দুমাত্র জমিন ছাড়তে প্রস্তুত থাকে না। অলিগলিতেও এখন আকাশছোঁয়া ভবনে শ্রমঘন কারখানা স্থাপনের 'অনুমতি' মিলছে। গড়ে উঠছে বিপণি বিতান কিংবা অফিস ভবন। এসব ভবনের অনেকগুলোকেই অনিরাপদ হিসেবে চিহ্নিত করা চলে। নতুন-পুরান ঢাকার সংযোগস্থল নিমতলীর অগি্নকাণ্ডের ঘটনার স্মৃতি এখনও তরতাজা। কিন্তু এমন প্রাণঘাতী ঘটনার পরও আবাসিক এলাকাগুলো থেকে কেমিক্যাল ব্যবস্থা বন্ধ করা যায়নি। এএমআরআই বিপর্যয় আমাদের সতর্ক করবে, এমন প্রত্যাশা করাই সঙ্গত। হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোতে এখন বিশেষভাবে নিরাপত্তা ব্যবস্থা খতিয়ে দেখতে পারে। সঙ্গত কারণেই এখানে বিস্তর দাহ্যবস্তুর উপস্থিতি থাকে। তৈরি পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠানেও একই ধরনের সমস্যা। আর কে না জানে যে গত তিন দশকে এ শিল্পের শত শত শ্রমিকের জীবন গেছে দায়িত্বহীনতার আগুনে দগ্ধ হয়ে। এমন দায়িত্বহীনতা সম্পূর্ণ দূর করা না যেতে পারে, কিন্তু সংশ্লিষ্টরা সতর্ক হলে বহুলাংশে কমানো সম্ভব।

No comments

Powered by Blogger.