ওরসের খাবার খেয়ে দুই শিশুর মৃত্যু-সৈয়দপুরের ১০ গ্রামের দুই হাজার লোক অসুস্থ, ২৫০ হাসপাতালে

রসের খাবার খেয়ে সৈয়দপুরের ১০ গ্রামের প্রায় দুই হাজার শিশু-নারী-পুরুষ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। গুরুতর অসুস্থ ২৫০ জনকে স্থানীয় হাসপাতাল ও রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ ছাড়া ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র, কমিউনিটি ক্লিনিক ও বাড়িতে আরো অনেককে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় সৈয়দপুর উপজেলার হাজীর বটতলা ব্র্যাক স্কুলের প্রথম শ্রেণীর ছাত্র সেলিম রংপুর মেডিক্যাল কলেজ


হাসপাতালে মারা যায়। তার বাড়ি উপজেলার ছিকলি গ্রামে। সকালে বাড়িতে মারা যায় পাশের জেলা রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার মধুপুর ইউনিয়নের সন্তোষপুর গ্রামের শরিফুদ্দিনের মেয়ে সুরভি।
সৈয়দপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডা. নাসরিন সুলতানা জানান, খাদ্যে বিষক্রিয়ায়ই মূলত গ্রামবাসীর অসুস্থ হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। অসুস্থদের সার্বক্ষণিক চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। চিকিৎসায় সবাই সুস্থ হয়ে উঠবে বলে আশা করেন তিনি।
গত শনিবার সৈয়দপুরের কামারপুকুর ইউনিয়নের আইসঢাল পীরপাড়া গ্রামে পীর দাউদ আলী খন্দকারের চতুর্থ ওরস ছিল। এর আয়োজন করেন পীরজাদা খন্দকার মো. আবদুল বাতেন ইবনে দাউদ। সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে ওয়াজ মাহফিল। এর আগে ওরসে আসা লোকজনদের মাঝে বিতরণের জন্য চাল, ডাল, মাংস ও আলুর তৈরি তবারক (খাবার) পলিথিনের ব্যাগে ভরে রাখা হয়। ওয়াজ মাহফিল শেষে উপস্থিত লোকজনদের মাঝে তা বিতরণ করা হয়।
গ্রামবাসী সূত্রে জানা গেছে, ওই খাবার কেউ ওয়াজের মাঠে, কেউ বাড়ি গিয়ে পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে খায়। রবিবার বিকেল পর্যন্ত ওরসের তবারক খাওয়া লোকজন ভালোই ছিল। সন্ধ্যার পরপরই শুরু হয় বিষক্রিয়া। তাদের সবারই বমি ও পাতলা পায়খানা হচ্ছিল। গভীর রাত থেকে অসুস্থ লোকজনকে গ্রাম থেকে রিকশা, ভ্যান, অটোরিকশা ও পিকআপে করে হাসাপাতালে নেওয়া হয়। গতকাল সকাল থেকেও অ্যাম্বুলেন্স, মাইক্রোবাস ও পিকআপে করে অনেককে হাসপাতালে পাঠানো হয়।
রংপুরের স্থানীয় সাংবাদিকরা জানান, রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শতাধিক রোগী ভর্তি আছে। সেলিমের পর নতুন করে আর কারো মৃত্যু হয়নি।
গতকাল দুপুরে নীলফামারী জেলা প্রশাসক আবদুল মজিদ, সিভিল সার্জন (ভারপ্রাপ্ত) ডা. আবদুল মজিদ ও সৈয়দপুর উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট এস এম ওবায়দুর রহমান ঘটনাস্থল ও হাসপাতালে ছুটে যান। নীলফামারী সিভিল সার্জন দপ্তর থেকে চিকিৎসকদের একটি দল ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়েছে।
রোগীর চাপে হাসপাতালে জায়গা সংকুলান হচ্ছে না। হাসপাতালের মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে তাদের। রোগীদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে চিকিৎসক ও সেবিকারা। হাসপাতালে স্যালাইন সংকট কাটাতে তাৎক্ষণিকভাবে নীলফামারী সিভিল সার্জন দপ্তর এবং স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এগিয়ে আসেন।
আইসঢাল গ্রামের মোশারফ হোসেন জানান, সন্ধ্যার পরপরই গা কাঁপিয়ে প্রচণ্ড জ্বর ও মাথাব্যথা শুরু হয়। এরপর শুরু হয় বমি ও পাতলা পায়খানা। এভাবে ওরসের খাবার খাওয়া ১০ গ্রামের প্রায় দুই হাজার মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে। গুরুতর অসুস্থ অনেককে রাতেই হাসপাতালে নেওয়া হয়। সকালে অসুস্থের সংখ্যা আরো বাড়তে থাকে।
খাদ্যে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত গ্রামগুলো হচ্ছে_কামারপুকুর, আইসঢাল, আইসঢাল পীরপাড়া, হাজীপাড়া, হাজীর বটতলা, ঠাকুরপাড়া, নিজবাড়ি, কাচারীপাড়া, জেলেপাড়া, ডাক্তারপাড়া ও কুজিপুকুর।
ওই গ্রামগুলোতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি বাড়িতে অসুস্থ রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। অনেককে বাড়ির বাইরে মাঠে রোদে শুইয়ে স্যালাইন দেওয়া হয়। উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের চিকিৎসা দিচ্ছে। সৈয়দপুর হাসপাতালে গিয়েও একই চিত্র চোখে পড়ে।
ওরসের আয়োজক গদিনশিন পীর খন্দকার মো. আবদুল বাতেন ইবনে দাউদ বলেন, 'আমার বাবা পীর হযরত দাউদ আলী খন্দকারের মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রতিবছরের মতো এবারও ওরসের আয়োজন করা হয়। ওরসে আসা কয়েক হাজার লোকের জন্য তবারকের ব্যবস্থা করা হয়।'
বাতেন জানান, সকাল থেকে রান্না করে খাবার পলিথিনের ব্যাগে ভরে রাখা হয়েছিল। ওরস শেষে গভীর রাতে সেই খাবার লোকজনের মাঝে বিলি করা হয়। তিনি দাবি করেন, খাবারে বিষক্রিয়া ঘটার কোনো কারণ দেখছেন না। তবে তাঁর অনেক শত্রু রয়েছে দাবি করে বাতেন বলেন, 'খাবারে কেউ বিষাক্ত কিছু দিয়ে থাকতে পারে।'
স্থানীয় ইউপি সদস্য আবদুল জলিল জানান, প্রতিবছরই এ ওরসের আয়োজন করা হয়। এর আগে এমনটি কখনো ঘটেনি।

No comments

Powered by Blogger.