গ্র্যান্ডমাস্টাররা সরে যান, মোকাদ্দেস তবু থেকে যান by শাহজাহান কবির

নেক অনিয়ম, অব্যবস্থাপনার অভিযোগ নিয়েই দাবায় দুই বছর পার করে দিয়েছেন সাধারণ সম্পাদক মোকাদ্দেস হোসেন। অথচ তিনি নির্বাচিত কেউ নন, ক্রীড়া মন্ত্রণালয় চাইলে অ্যাডহক কমিটিতে বদল আনতেই পারত। কিন্তু আনেনি, তাঁকে বহাল তবিয়তে রেখে দাবা থেকে দূরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে দুই গ্র্যান্ডমাস্টার আবদুল্লাহ আল রাকিব ও এনামুল হোসেন রাজীবকে।


২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে মোকাদ্দেস হোসেনের দায়িত্ব নেওয়ার শুরু থেকেই তাঁর যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন এই দুজন, সঙ্গে দেশের শীর্ষ দাবাড়ুদের অনেকেই ছিলেন। বাকিরা খেলায় ফিরলেও রাকিব-রাজীব তাঁদের অবস্থানে অনড় থেকে দাবা থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে আছেন। গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোর্শেদ, রিফাত বিন সাত্তার বা আন্তর্জাতিক মাস্টার আবু সুফিয়ান শাকিলের মতো শীর্ষ দাবাড়ুরা ফেডারেশন আয়োজিত টুর্নামেন্টগুলোতে খেলছেন ঠিকই, কিন্তু কায়মনোবাক্যে মোকাদ্দেসের নেতৃত্বাধীন কমিটির বিলুপ্তিও চাচ্ছেন। নিয়াজ মোর্শেদ শুরুতে সমর্থনই দিয়েছিলেন মোকাদ্দেস হোসেনকে। এখন তিনিও মনে করছেন, এই ব্যক্তি পুরোপুরি ব্যর্থ, 'নাহ্, যেমন ভেবেছিলাম তার কিছুই ও করতে পারেনি। ফেডারেশনে হয়তো সময় দেয়, কিন্তু কোনো ভিশনই নেই ওর। বয়সভিত্তিক দাবায় জোর দিতে বলেছিলাম, কিন্তু কিছুই করতে পারেনি এই দুই বছরে।' রাকিব, রাজীবরা এই শঙ্কা করছিলেন শুরু থেকেই। তাঁদের বক্তব্য ছিল, মোকাদ্দেস হোসেন দাবা অঙ্গনে প্রায় অপরিচিত একজন ব্যক্তি, ক্রীড়াঙ্গনে কোনো সাংগঠনিক অভিজ্ঞতাও নেই তাঁর। তাঁর সঙ্গে যাঁরা কাজ করতে চাইছেন, তাঁদের মধ্যে দক্ষ কেউ নেই, অর্থাৎ মোকাদ্দেস হোসেনকে এ পদে পুরোপুরিই অযোগ্য ঘোষণা করেছিলেন তাঁরা। 'আমরা যে অমূলক আশঙ্কা করিনি, দিন দিন সেটাই স্পষ্ট হয়েছে। দাবা এখন হাসি-তামাশার ব্যাপার হয়ে গেছে। এটাই বোধ হয় বাকি ছিল। তাঁর মতো অযোগ্য একজন লোকের পক্ষে দাবার জন্য ভালো কিছু করা সম্ভব নয়, এটা আমরা শুরুতেই স্পষ্ট করে বলেছি' বলেছেন গ্র্যান্ডমাস্টার এনামুল হোসেন রাজীব। দাবার দুর্ভাগ্য, মোকাদ্দেস সেই চ্যালেঞ্জটা উতরাতে পারেননি, পারলে নিয়াজ মোর্শেদকে আজ নিজের ভুল স্বীকার করতে হয় না।
বয়সভিত্তিক দাবায় জোর দেওয়া তো দূরের কথা, নিয়মিত হওয়া ছোটদের একমাত্র টুর্নামেন্ট স্কুল দাবাও বন্ধ হয়ে গেছে এ বছর। মোকাদ্দেস হোসেন দাবি করেন, তাঁর বুদ্ধিতেই ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী গত বছর সব খেলায় প্রতিভা অন্বেষণ কার্যক্রম শুরু করেন। অথচ দাবার প্রতিভা অন্বেষণ কর্মসূচি চালিয়ে দিয়েছেন তিনি জুনিয়র আর সাব-জুনিয়র চ্যাম্পিয়নদের মতো পরিচিত দাবাড়ুদের নিয়ে। কোচের দায়িত্বে থাকা আবু সুফিয়ান শাকিল তখন এ নিয়ে প্রতিবাদও করেছেন; কিন্তু প্রতিকার পাননি। দাবার সবচেয়ে বড় দুটি টুর্নামেন্ট গ্র্যান্ডমাস্টার্স ও আন্তর্জাতিক মাস্টার্স দাবা হয়নি গত দুই বছর। কিন্তু এ নিয়ে মোকাদ্দেস হোসেনকে জবাবদিহি করতে হয়নি কোথাও। 'এত বড় টুর্নামেন্ট আয়োজনে খরচ অনেক' বলে তিনি আত্মসমর্পণ করে নিয়েছিলেন আগেই। অথচ গত বছর নিয়াজ মোর্শেদ ব্যক্তিগত উদ্যোগে এমন দুটো টুর্নামেন্ট করেছেন। মোকাদ্দেস হোসেনের সাংগঠনিক দক্ষতা শেষ পর্যন্ত হাসাহাসির পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। প্রিমিয়ার লিগের মতো গুরুত্বপূর্ণ আসরের উদ্বোধনী দিনেও স্পন্সর ঠিক হয় না, কম্পিউটার ক্র্যাশ করার কারণে টুর্নামেন্টই স্থগিত হয়ে যায়। দলের সঙ্গে বিদেশ ভ্রমণে গিয়ে তাঁর দাবা বোর্ডে বসে যাওয়া দেখেও বিরক্ত খেলোয়াড়রা।
দাবা ফেডারেশনের সবচেয়ে পুরনো ও জানাশোনা লোক হিসেবে পরিচিত ছিলেন আন্তর্জাতিক আরবাইটার হারুন-অর-রশিদ। মোকাদ্দেস হোসেনের কমিটি দায়িত্ব নেওয়ার বছরখানেকের মধ্যেই 'দাবায় আর সেই পরিবেশ নেই' বলে ফেডারেশন থেকে সরে গেছেন তিনিও। মোকাদ্দেস হোসেনের কমিটিতে কাজ করেন হাতে গোনা কয়েকজন। যুগ্ম সম্পাদকদের একজন খন্দকার কায়েস হোসেন শুরু থেকেই অনুপস্থিত ফেডারেশনে। মোকাদ্দেস হোসেন কাজ করেন মাসুদুর রহমান মলি্লক দীপুকে সঙ্গে নিয়ে। যিনি নিজে কখনো দাবা খেলেছেন বলে শোনা যায় না, নিয়াজ মোর্শেদের ব্যবসা ও ব্যক্তিগত কাজে সহকারীর ভূমিকা পালন করার সূত্রেই তাঁর ফেডারেশনে যাতায়াত। সাধারণ সম্পাদক হওয়ার আগে মোকাদ্দেস হোসেনও দাবা খেলেছেন নামমাত্র। ছেলেকে খেলতে নিয়ে এসে বিকেলবেলা নিজেও বসে যেতেন বোর্ডে। দাবাড়ুরা অন্তত তাঁকে সেভাবেই চিনতেন, সেখান থেকেই তাঁর হুট করে দাবার অভিভাবক বনে যাওয়াটা আরো অনেকের সঙ্গে মানতে পারেননি রাজীব, রাকিব। কিন্তু কোনো এক অদ্ভুত কারণে দেশের শীর্ষ দাবাড়ুদের চেয়ে মোকাদ্দেস হোসেনের মতো অখ্যাতকেই পছন্দ ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের। নানা অব্যবস্থাপনার পরও, অলিম্পিয়াডে স্মরণকালের সবচেয়ে বাজে ফল হওয়ার পরও তিনি বহাল। বছর শেষ হতে চলল অথচ এখনো জাতীয় দাবারই খবর নেই, হয়নি প্রথম বিভাগ, দ্বিতীয় বিভাগও; কিন্তু এসব দেখার যেন কেউ নেই।

No comments

Powered by Blogger.