গল্প- প্রত্যাবর্তন: আমার ‘ফেরা’ নিয়ে যে কাহিনী না বললেও চলত by মানস চৌধুরী

পরপর ইমেইলগুলো আসতে থাকে।

অনেকগুলো। কিংবা অনেকগুলো নয়, কয়েকটাই মাত্র। কিন্তু পুনঃপৌণিকতায় কিংবা অন্যকিছুতে আমার অনেকগুলো মনে হয়। ইমেইলগুলো আমার নিরাসক্ত লাগে, এমনকি অমিশ্রিত, ডিসএনগেইজড। তবু প্রায় ভৌতিকভাবে সবগুলোতে একই জিজ্ঞাসা: ‘কবে ফিরছ?’ পয়লাতে আমি আসলে ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করি ফেরা নিয়ে। বলি কেন আমি ফিরি না, বা কেন ফিরবার জন্য ন্যূনতম শর্তগুলো আমি মেটাতে ব্যর্থ। আমার মনে পড়ে, আমি খুব দ্রুত বিদ্যাবিদ হয়ে যাই। এবং মুখে মাপা হাসি ধরে রেখে আমি লিখে চলি, ফিরবার জন্য অন্ততঃ দুটো, বা এর যে কোনো একটা, অভিলক্ষ্য লাগে। যেমন ধরা যাক, মানুষে ফেরেন ডিফিনিট সম্পত্তিরাজিতে; কিংবা মানুষে ফেরেন ডিফাইন্ড সম্পর্কমালাতে। আমি এসব শর্ত মেটাই না। আমি ফিরি না। আমি যাই। যাওয়া ভিন্ন আর কিছু করবার যোগ্যতা আমার নাই। এরকম অনুপ্রাসধর্মী শব্দচয়নে, আমি কল্পনা করি, শ্রোতার মুখে বিহ্বল হাসি খেলে যায়। কখনো চতুর হাসি।
 
এরকম একটা উত্তরে যা হবার কথা বলে আমি ভাবি তা আসলে হয় না। আমি ভাবি, এরকম উত্তরে সম্পত্তি ও সম্পর্ক নিয়ে তাঁরা আরও কথা কইবেন। কিংবা আমাকে কথা বলবার সেতু বানিয়ে দেবেন। আমি কম্প্যুটারের পর্দায় অস্তিত্বমান হয়ে থাকি। কিন্তু তাঁরা তা করেন না। একদল আর কিছু জানতে চান না। ওটাই ওই পর্যায়ের প্রথম ও শেষ যোগাযোগ হয়ে থাকে। হতে পারে এঁরাই বিহ্বল হাসির দল। আর অন্যদল, হতে পারে তাঁদের মুখে চতুর হাসিখানা ছিল, হতে পারে তাঁরা আমার বার্তা থেকে কেবল আমার কথাকার সত্তার এক জাদুকরী সামর্থ্য ঠাহর করে নেন। তাঁরা আমাকে দিয়ে আরও কিছু কথা লিখিয়ে নিতে চান। এবং হয়তো তাঁরা আশা করেন যে আমার সংজ্ঞাগুলোর একটা সীমানাতে এসে আমার কারিগরি ক্লিষ্ট হয়ে পড়বে। আর তাঁরা সিদ্ধান্তে আসতে পারবেন যে কথাকারের জাদুকরীর সীমানাটা তাঁরা চেনেন। কিন্তু আমি খেয়াল করি যে এরকম ব্যাখ্যাতে আমার ক্লান্ত লাগে। এমনকি একটা অঘোষিত মল্লযুদ্ধের হাতছানি সমেতও। আবার এসব ব্যাখ্যাতেও ইমেইলকারকেরা ডিসএনগেইজড থাকেন। বড়জোর একদম স্বতন্ত্র কোনো বিষয়ে নতুন এক আলাপ শুরু করেন। বা প্রকৃতার্থে আলাপহীনতা শুরু করেন। ফলে আমি আর ব্যাখ্যা দিই না। আসলে জিজ্ঞাসার উত্তরও করি না আর। হয়তো ইমেইলগুলোতে আমারই ডিসএনগেইজড লাগে।

কিন্তু ততদিনে আমাকে অন্যেরা জিজ্ঞেস করতে শুরু করেছেন। ইমেইলে নয়। সরাসরি। তাঁরা ওই প্রান্তের মানুষ। ফলে যে পরিমণ্ডলকে ‘আমার’ বলে কেউ কেউ ধরে নিয়েছেন সেখানকার বাসিন্দা তাঁরা নন। তাঁদের বড়জোর জিজ্ঞেস করবার কথা কবে যাচ্ছি আমি। কিন্তু তাঁরাও জিজ্ঞেস করলেন কবে ফিরছি। ফেরা বিষয়ক আলাপ না করবার উপায় থাকে না। আমি ওই প্রান্তেও একই আলাপ সম্পন্ন করি। এতে একমাত্র যে লাভটা আমি নিশ্চিত করতে পেরেছি তা হলো প্রায় প্রতিদিন একই প্রশ্ন করা যাঁদের অভ্যাস হয়ে পড়েছিল তাঁরা প্রশ্নটা প্রত্যাহার করে নেন। কিন্তু এতে আবার আমি লক্ষ্য করি যে আমার নিজেকেই প্রায় প্রত্যাহার করে নিতে হচ্ছে। এবং সেটাও বেশ অসুবিধাজনক একটা অনুশীলন। হতে পারে যে আমার এই তথাকথিত ফেরা সংক্রান্ত বিষয় ছাড়া আর কোনোভাবে তাঁরা আমাকে অনুধাবন করতে পারছিলেন না। এবং এই একমাত্র অনুধাবন-লক্ষণাটি আমি ভেঙে দিতে চাইলে তাঁরা ভঙ্গুর হয়ে পড়েন। কিংবা হয়তো আমাকেই ভঙ্গুর ভাবেন। কিন্তু আসলে তা ছিল না ব্যাপারটি, এমনকি পরেও তা হয়নি।

এভাবে আমার প্রত্যাবর্তন নিয়ে আলাপ গুটিয়ে আনতে পারা যায়। ইমেইল কিংবা সাক্ষাৎ-জবান দুটোতেই।

তবে একটা নিস্তরঙ্গ অশান্তি কোথায় যেন আমি টের পাই। আমি বুঝে উঠতে পারি না কেন আমার সহজ আলাপটাও লোকে বুঝে উঠতে পারছেন না। কিংবা, এর থেকেও বেশি যে ভাবনাটা আমাকে পেরেশান করতে শুরু করল, কীভাবে আলাপটাকে দাঁড় করালে মানুষজনে সেটাতে সংমিশ্রিত হবেন এবং তাঁদের বোধগম্য হবে।

পেরেশান থেকেও, আমি তাই করতে থাকলাম অন্যান্য দিনে যা আমি করতাম।

যেমন ধরা যাক, স্বীয় ইমেজে সকাল বেলার সিগারেটের সঙ্গে হাগার সম্পর্কটা আমার পছন্দ নয়। কিন্তু সেটাই দাঁড়িয়ে গেছিল। ফেরা সংক্রান্ত আলাপবিভ্রাটের কালে, কিংবা বিভ্রান্ত আলাপের কালেও, হাগাটা সিগারেট সাপেক্ষ হয়েই থাকল। কিংবা উদরকেন্দ্রিক আরও উদাহরণ, ঠিক যেরকম উদাস মুখে যে কয়টার সময় সমবায়ের যে অফিসে যে কোম্পানির যে স্যান্ডউইচটা আমি আগে কিনতাম এবং যে জায়গায় যেভাবে বসে সেটা খেতাম ঠিক একই ভাবে এগুলো তখনও চলতে থাকল। আবার দিনের যে সময়টা নেহায়েৎ আর কিছু করার কল্পনা আমার মাথায় খেলত না বলে আমি পশ্চিমের লাইব্রেরির কোনার দিকটাতে কফি মেশিনে পয়সা পুরে দিয়ে একটা কাগজের কাপের জন্য অপেক্ষা করতাম, সেটাতেও কোনো বদল আসেনি। এরকম।

ফলে আমি অবাক হইনি যে আমার প্রশ্নকারীরাও, আমার সঙ্গে একটা বিহ্বল আলাপ সত্ত্বেও, তাঁদের দৈনন্দিন কাজকর্ম অবিকল জারি রাখলেন।

ততদিনে ডিজিটাল জনগণ নিরস্ত হলে এ প্রান্ত নিয়ে আমি নৈর্লিপ্তি অর্জন করি। মানে যে প্রান্তে আমার পৌঁছানোর কথা। আমি প্রাত্যহিক ক্রিয়াদি করি এবং আমার হাওয়াই জাহাজের টিকেটের জন্য বায়না করি এবং আমার ব্যাগ ও অন্যান্য পোঁটলা বানাবার চেষ্টায় লিপ্ত থাকি। আমি মাঝে মধ্যে রুটিন করি সকালে উঠে। ঠিক সকাল আসলে নয়। সকালের পর। কখনো প্রায় দুপুর। আবার অন্য সময়ে একদম সন্ধ্যাবেলা। আমি বিছানা ছেড়ে যখন পূর্ববৎ ওকোনোমিয়াকি খেতে যাই, কিংবা খেতে না-যাবার বেদনা সমেত অন্যকিছু খাই, তখন আমি রুটিন বানাই মনে মনে।

আগামী ২/৩ দিন কম্প্যুটারের ফাইল-টাইল গোছগাছ …
তারপর অত তারিখ থেকে তত তারিখ যত কাগজপত্র আছে তা বাছবিচার …
তারপর অফিসঘরের মেঝেতে লেগে থাকা কফির ঝোল ও অন্যান্য কুৎসিত দাগ মোছাই অমুক দিন …
এই শেষোক্তটা নিয়ে মন অনেক সায় দেয় না। কারণ অনেক দাগই আমি দাগাইনি। কিন্তু একটা জেশ্চার হিসেবে আমার করাই ঠিক মনে হয়। এটা ভাবতে গিয়েই আবার মনে হয় Ñ
বাসার যৌথ হাগুখানার চিনামাটির ডাব্বাটা ঝকঝকে করে মোছাই তমুক দিন …

বাসাটাতে আমিই একমাত্র বিদেশী। আবার বিদেশী বলতে একটা বাংলাদেশীকে গ্রহণ করা বাড়ির মালকিন অশীতিপর বৃদ্ধার পক্ষে ভীষণ কঠিন ছিল। ফলে আমি যারপরনাই কৃতজ্ঞ ছিলাম। একটা চকচকে চিনামাটির ডাব্বা যখন হাগুখানায় তিনি দেখবেন তখন, আমি আসবার পর, আমার প্রতি তাঁর অপত্য স্নেহ তিনি বায়ুমণ্ডলে বিতরণ করবেন। এরকম ভাবলাম আমি। কিন্তু সেটাও সহজ নয়। আমি আসবার পর, হতে পারে, কেউই বুঝতে পারবে না যে ওই চকচকে ভাবটা আমার কারণে সৃষ্ট। যৌথতায় যা হয় আরকি! হাগুখানা কিংবা অন্য যা কিছু। আমি আবার রুটিন করি Ñ
১৭ তারিখ বাক্সে কাগজপত্র ভরা …
১৮ আর ১৯ যৌথ ধোলাইমেশিনে সবকিছু ভরে দেয়া …

ক্রমশঃ আমি আমার হাওয়াই জাহাজের টিকেট আর ব্যাগ-বাক্সকে আমার দুনিয়া ভাবা রপ্ত করে ফেলি। এটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ, যেহেতু এরূপ অভ্যাস অন্যকালে তেমন ছিল বলে আমার মনে পড়ে না। এবং সেই নবলব্ধ ভাবনা সমেত আমার উচ্ছ্বাসকেও যথাসম্ভব লুক্কায়িত রেখে আমি পোশাকাবৃত হই, এবং ঘরের বাইরে চলতে থাকি। এভাবে জোভান কিংবা ইভান কিংবা ওইশি কিংবা মিকা আমি সমানে সামলে চলি। মাঝে মাঝে হিসিখানায় জিপার আটকাতে আটকাতে আয়নায় আমার হাসি আর চোখের মাপসই কম্বিনেশন রিভিউ করে নিই। লক্ষ্য করি, দিনকে দিন ওদুটোর কম্বিনেশন বিস্ময়কর সমর্থ হয়ে চলেছে। আমি নিয়মিত, এবং নির্লিপ্তভাবে, দিনপাত করি।

তবে একদম অকস্মাৎ যেদিন এই নতুন প্রশ্নটার সম্মুখীন হই, আমি স্তম্ভিত হয়ে পড়ি।

‘কী? খুশি খুশি লাগছে নিশ্চয়ই?’

আমার বুঝতে একটুও সমস্যা হয় না যে, কোনোপ্রকার মীটিং ছাড়াই, এখন থেকে অন্যরা সকলেই এই প্রশ্ন করে যাবেন আমাকে। রুটিন করে প্রতিদিন। কিংবা হয়তো একই দিনের নানান সময়ে। এমনও হতে পারে একত্রে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকলেও একাধিক প্রশ্নকারেরা, প্রশ্নটির গুরুত্ব অনুধাবন করে নিশ্চয়ই, অপেরার মতো প্রশ্নটা করতে থাকতে পারেন। নতুন এই পরিস্থিতি নিয়ে আমার কোনোই পূর্বধারণা কাজ করছিল না। এটাতে হতভম্ব না হবার উপায় ছিল না। হতভম্বতার মূল কারণ অবধারিত। এই প্রশ্নটার কোনো উত্তর করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। ওই সেকেন্ডগুলোতেই খুব দ্রুতগতিতে আমি সম্ভাবনাগুলো খতিয়ে দেখতে থাকি।

এর একটা উত্তর হতে পারত ‘হ্যাঁ খুবই খুশি খুশি লাগছে।’ কিন্তু এটা একটা নিরর্থক উত্তর। এমনকি ডাহা মিথ্যা। কিন্তু আমার খুশি খুশি লাগছে না বলার অবধারিত মানে দাঁড়াবে আরও জটিল কিছু। আমার ঘোষণা দিতে হবে যে তুলনামূলক বৈভবে আমার অধিকতর খুশি খুশি লাগছিল এদ্দিন। কিন্তু সেটাও সত্যি নয়। কিংবা আমাকে প্রশ্নকারীরা অকারণ একটা ঘ্যানঘেনে কিছু ভেবে বসতে পারতেন। অন্ততঃ সেই সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না। কিংবা আমি যদি বলতাম ‘কেন? খুশি খুশি লাগার কী আছে!’ তাহলেও তাঁরা এটা বুঝতেন না যে আমি খুশি লাগার ব্যাকরণ নিয়ে ভাবছি। অনায়াসেই তাঁরা খুশি লাগছে না উত্তর ধরে নিয়েই পরের আলাপ সাজাতেন। এসব চিন্তা ওই দ্রুত সময়ে করার কারণে যা হবার তাই হলো। একটা ভ্যাবদা-মারা হাসি সমেত কোনো উত্তর না-করা হলো। এতে নিশ্চিত হলো যে এই প্রশ্নটা এরপর যতবার করা হয়েছে, আসলে অনেকবার, প্রত্যেকবারই ওই নিরুত্তর ভ্যাবদা হাসিই আমার উত্তর হলো। এবং প্রশ্নকার তরফেও এটা নিশ্চিত হলো যে ‘ফিরে’ যেতে আমি খুশি হয়েই আছি।

এই দুর্ঘটনাকে মেনে নেয়া ছাড়া আমার উপায় ছিল না। অনেক ভেবে দেখেছি যে এই খুশির প্রশ্নটাও গুরুতরভাবে ফেরা বিষয়ক তাঁদের তত্ত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত। যেহেতু ফেরার তত্ত্ব নিয়ে কোনোরকম ব্যাকরণ-পল্টান আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি, খুশির প্রশ্নের সঙ্গে আলাপ গড়ে তোলাও আমার পক্ষে অসম্ভব।

এরকম একটা দুরূহ পরিস্থিতিতে কেবলমাত্র হাওয়াই জাহাজের টিকিটের তারিখ ধরে কাউন্টডাউন করতে থাকাই তখন আমার কর্তব্য মনে হলো। এটার একটা নিজস্ব উত্তেজনা আছে। শেষবার, সম্ভবতঃ, ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আগে আমি এরকম কাউন্টডাউন করেছিলাম। আমার যদ্দুর মনে পড়ে সেবার যেমন ক্রিকেটটা শুরু হয়ে যাওয়া পর্যন্ত আমি দম ধরে অপেক্ষা করছিলাম, এবারও হাওয়াই জাহাজে ওঠা পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করছিলাম। এমনকি অতটা পর্যন্তও না। ইমিগ্রেশনে প্রাক-নাঙ্গা দরবার পর্যন্ত। যদ্দুর পর্যন্ত বিদায়দাতারা দেখতে পারেন। অপ্রাসঙ্গিক না যে দু’জন অন্ততঃ বিদায় দিতে এসেছিলেন। যে খুশি আমার লাগছে বলে তাঁরা ফয়সালা করতে পেরেছিলেন সেই খুশি তাঁদের মুখ পর্যন্ত বি¯তৃত রেখে, এবং আমাকে বিদায় দেবার কারণে যতটা বেদনা তাঁদের বোধ করবার কথা বলে তাঁরা মনে করছিলেন ততটা বেদনাও মাখামাখি রেখে তাঁরা পুরোটা সময় থাকেন। এর কোনোটা নিয়েই আমি নেগোশিয়েট করার আর ইচ্ছা করিনি। বরং যতটা পারা যায় সেগুলোর গ্রহীতা হয়ে আমি বিদায় নিই।

কিন্তু মন্দ ব্যাপারটা হচ্ছে হাওয়াই জাহাজ চিরকাল আকাশে ভাসে না। এগুলো সাধারণতঃ নেমে আসে। এবং নামে সাধারণতঃ টিকেট মোতাবেক। টিকেটে যে গন্তব্য লেখা থাকে তার বাইরে অন্যান্য কিছু খতিয়ে দেখা হাওয়াই জাহাজের অভ্যাস না। সেটা আমি জাহাজে বসেই জানতাম। এমনকি তার আগে থেকেও। জাহাজে, ফলে, সেটাই প্রধান ভাবনা হয়ে দেখা দিল। জাহাজ নামার পরও দেখা গেল আমি সেটাই ভাবছি। অন্ততঃ জিয়া থেকে একটা লাইনে থাকা ট্যাক্সিওয়ালা পাওয়া পর্যন্ত এই ভাবনা আমার কিছুমাত্র পাৎলা হয় না। ট্যাক্সিটা পেতে সাহায্য করলেন একজন পুলিশ। এরকম পুলিশ অনেক দেখিনি আগে আমি। কিছু পরে আমার মনে হলো এই ট্যাক্সি নেটওয়ার্কের তিনি একজন অনুগ্রাহী। কিন্তু তাতেও আমার সন্তোষ কিছু কমেনি। এর একটা কারণ হতে পারে আমাকে নিতে কেউ আসেনি শুনে, সম্ভাব্য একটা জেরা করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও, তিনি সেটা না করে ট্যাক্সি খুঁজে দিতেই আগ্রহ দেখিয়েছেন।

তবে আমার ভাবনাপ্রবাহ বাধা পড়ে যখন ট্যাক্সিচালক জানতে চাইলেন যে আমি কোথায় যাব। সেটা তিনি রাস্তায় নামতে না-নামতেই জিজ্ঞাসা করে বসেন। এবং কোনোরকম দ্বিধা ছাড়াই আমি মেসবাড়ির ঠিকানাটা তাঁকে বলি। এই পুরা রাস্তায় তিনি অবশ্য ফেরা বা খুশি বিষয়ক থিসিসের তেমন ধার ধারেননি। বা, হতে পারে, আমার থিসিসের ব্যাপারে তিনি শ্রদ্ধাশীল হয়ে পড়েছিলেন। ফলে আমরা ওই সময়টাতে অন্য নানান কিছু নিয়ে আলাপ করলাম। যেগুলো আসলে চাইলেই ভুলে যাওয়া সম্ভব। যেমন ওর বাড়ি কোথায়। কবে এসেছে। এই ট্যাক্সিই চালাতে চেয়েছিল কিনা। কত টাকা চালান দিতে হয়। কে কে কোথায় থাকেন। এইসব। বহুদিন ধরে অভ্যাস গড়ে তোলায় এসব আলাপ অনায়াসে করে যেতে পারি। এমনকি হয়তো ভুলে যেতেও। কেবল অভ্যাসটাই মনে থাকে। কারণ এই যেমন এখন, এখন কিন্তু সেসব তথ্য আমার একটুও মনে পড়ছে না যা সেই ট্যাক্সিচালক আমাকে দিয়েছিলেন। আবার আমার অভ্যাস মোতাবেক যে প্রশ্নগুলো করেছি সেগুলো কিন্তু ঠিকই মনে আছে আমার।

ট্যাক্সিটার সারা শরীর একটা ঝনঝনানো আওয়াজ করতে করতে কাঁপছে। এই আওয়াজটা আর তার মধ্যে আমার অভ্যাস মোতাবেক ড্রাইভারের সঙ্গে আলাপ করতে থাকায় আমার সন্তোষ লাগতে থাকে। গাড়িটা এভাবে ঝনঝনিয়ে বনানী ডিঙায়, মহাখালির হাওয়াই সেতুতে চড়ে, আবার নামে, প্রধানমন্ত্রীর অফিসের সামনে লটকে থাকে, ডিজ্যুসের তরুণদের সাইনবোর্ড পাশে রেখে আগারগাঁওয়ের দিকে যায়। এভাবে যেতে থাকে। আর আমরা কথা বলি। আমার মেসবাড়ির কিছু আগে এসে সরু রাস্তার অভিযোগে আর যেতে না চাইবার আগ পর্যন্ত ড্রাইভারের সঙ্গে এরকম নির্লিপ্ত অথচ রেওয়াজমাফিক সম্পৃক্ত যোগাযোগ চলতে থাকে। আসলে সরু রাস্তা নিয়েও আমাদের বিশেষ গোলযোগ সম্পন্ন হয় না। বরং আমি প্রায় মুখস্ত দক্ষতায় নেমে রিকশা ডাকি। যদিও, এটা একটা উপায় হতে পারত, তাঁকে দাঁড় করিয়ে রেখে আমি অন্য আরও বড় গাড়ির ওই রাস্তায় চলাচল দেখাতে পারতাম। কিন্তু সেটা করি না।

বাসার নিচে কলাপসিবল দরজাটা কায়দামাফিক আটকানো, কিংবা খোলা। মানে অর্ধেক কিংবা তারও বেশি আটকে রেখে একটা শিকল পরিয়ে দরজাটা রাখা। তালাটা বিশ্রিভাবে বেঁকে আছে। দেখে মনে হয় যেকোনো সময়েই ওটা গভীরভাবে আটকে যেতে পারে। এমনকি কলাপসিবলের এই কায়দাটুকু না রেখেই। তখন খুলবার জন্য সাধ্যসাধনা করতে হবে। ওটুকু খোলা পেয়ে আমার সন্তুষ্টি অটুট থাকে।

আমার লাল রঙের ব্যাগটা ওই ফাঁকটুকুতে আটকে গেল। আমি লক্ষ্য করি, তাতে আমার খানিক ছন্দোপতন ঘটে। আমি সামনে বা পেছনে ব্যাগটা ছাড়াবার চেষ্টা করি। মানে নিজেকেও। ব্যাগটা থেকে আমাকে ছাড়ানো তখন আরও কঠিন হয়ে গেছে। নিচতলার মহিলা গণ রান্নাঘর থেকে দেখতে পেলেন। এগিয়ে এলেন। কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। হাসলেনও না। মন খারাপ করেছেন বলেও মনে হলো না। কেবল আমার ব্যাগে-থাকা কাঁধটা একপাশে ঠেলে ব্যাগটা কায়দামাফিক টান দিলেন। আমি বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়লাম।

আমার বাসায় সাত জন বাসিন্দা। নানান বয়সের। আমার মনে নেই কে দরজা খুলে দিলেন। আমার এও মনে নেই সবাই তখন বাড়িতেই কিনা। কিন্তু দরজা খুলে হাসির অধিকন্তু কেবল বললেন Ñ
‘চলে আসছেন?’
পরে লক্ষ্য করলাম সেই প্রশ্নটাই সবাই করছেন Ñ
‘চলে আসছেন?’
গতবার যার ভাষাশিক্ষা হয়নি, সেই ছোটটা, সম্ভবতঃ ওর মা দরজা খুলে দিলেন, সেও এসে বলল Ñ
‘কাকা আসছেন?’
ফেরা বা খুশি সংক্রান্ত কোনো থিসিস নিয়ে কিছুমাত্র আমার আলাপ করা লাগল না। আমি ব্যাগটা নামিয়ে আমার ঘরের তালা খুললাম না আগে। আগে দাঁড়িয়ে থাকলাম। তারপর তাঁরা জিজ্ঞেস করলেন Ñ
‘থাকবেন তো এখন?’
‘হ্যাঁ থাকব তো! কই যাব!’ এটা বোধহয় নিজেকে বললাম। ছোটটাও জিজ্ঞেস করল Ñ
‘কাকা থাকবেন?’
আমাকে যে কাকা ডাকা যায় এই জ্ঞান নিশ্চয়ই আমি আসার আগেই পেয়েছে। সামনে তো কই দেখলাম না! অথবা হতে পারে ওর আগেই ওর বড়টা ডেকেছিল এবং একই প্রশ্ন করেছিল। সম্ভবতঃ।

দরজার তালা খুলে আমি কেবল ব্যাগটা রাখি। জুতা খুলি। চপ্পল পায়ে দিই। তারপর চা খেতে বের হই।

পাড়ার লন্ড্রিতে চোখাচোখি হয় Ñ
‘আসছেন?’
তারপর হয় আলুপটলের দোকানের চাচার সঙ্গে Ñ
‘আসছেন? আমি তো চটপটি ছাইড়া শব্জি ধরলাম।’
চুলকাটার দোকানের ছেলেটার সঙ্গে শব্দ ছাড়াই এই ভঙ্গি বিনিময় হয় Ñ
‘আসছেন?’
তারপর পাড়ার পুরি আর ভাতের দোকানের দু’জন Ñ
‘চইলা আসছেন?’

আসমা পান খাওয়া মুখে ওর স্বামীকে বেঞ্চ পরিষ্কার করতে বলে। লোকটা ঠিকমতো হাঁটতে পারে না। বেঞ্চ পরিষ্কার করে দিয়ে কোথায় গেল। সম্ভবতঃ মুততে। যাবার আগে বলল ‘বসেন’। দোকানটাকে আসমার দোকান বললেই ভাল বোঝায়। চায়ে চিনি দিয়ে ঘুটতেই থাকল সে। আমার আর বলতে ইচ্ছা করে না যে ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। আমি নিশ্চয়ই আরও কয়েক কাপ চা খাব। ফলে আসে যায় না এটা গরম থাকল কিনা। আমি রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকি। আসমা আমার দিকে তাকায়। আর চা নিয়ে দেরি করতে থাকে। কিন্তু আমার একট্ওু তাড়া লাগে না।
‘আপনারে এট্টা কথা জিগামু।’
‘হ্যাঁ জিগান। আমি আরও চা খাব।’
‘না এহন জিগামু না।’
‘পরে একটু সুবিদামতো সোময়ে জিগামু।’
‘আচ্ছা, আমি আবার আসব।’
‘না আসলে আমি ডাইকা জিগামু।’

আমি মাথা নেড়ে চা খেতে থাকি। ততক্ষণে চা আমার কাছে দিয়ে গেছে আসমা। মাথার উপর ঘড়ঘড় করে একটা বহু পুরাতন ফ্যান ঘুরছে। এই ঘরটাতে ওরা বোধহয় রাতে ঘুমায়। আমার মনে হলো। আমি আবার চা খেতে চাই। আসমা কী জিজ্ঞেস করবে কিংবা আদৌ কিছু করবে কিনা এ নিয়ে আমার কোনোই চিন্তা কাজ করে না।

ওর প্রশান্তি দেখে আমার মনে হলো জানানো দরকার Ñ
‘আজকেই আসলাম।’
‘হ দেখি নাই তো মইদ্দে।’

পাশে চা খেতে-থাকা লোকটা ততক্ষণে একটা কথা খুঁজে পেল Ñ
‘হ কই জানি আছিলেন।’
‘হুঁম।’ আমি জানাই।

একটা বছর নিমেষে তিন কাপ চায়েই মিটে গেল। আসমাকে পয়সা দেবার আগে দাম জিজ্ঞেস করি। দাম বাড়বার কথা। বেড়েছে। কিন্তু নয় টাকা ও নেয় না। ও ছয় টাকাই নেয়। বলে পয়লা কাপটা ও খাওয়াল। আমি মানা করলাম না। নেমে হাঁটা দিলাম।

আশ্চর্য! ফেরা নিয়ে দেখি এদের কোনো ভাবনাই নাই!

(০৮ই জুলাই ২০০৭॥ শেওড়াপাড়া, ঢাকা; ০৩-০৮ অক্টোবর ২০০৭॥ লালমাটিয়া, ঢাকা)
=========================
গল্প- আলিমের নিভৃতিচর্চা by রাশিদা সুলতানা

bdnews24 এর সৌজন্যে
লেখকঃ মানস চৌধুরী


এই গল্পটি পড়া হয়েছে...
free counters

No comments

Powered by Blogger.