আমার বুকেই হচ্ছে এই অনুষ্ঠান by আখতার হুসেন

কামরুলকে ফোন করে আমি জানতে চাই, ‘কামরুল, আমাদের নাটকের সেই অনুষ্ঠানটা কবে হয়েছিল ’৬৮ না ’৬৯ সালে?’
কামরুল সোজা জানান, ‘কোনো ভুল নেই, সালটা ’৬৯।’
এবার আমার মনে পড়ে, মাসটা ফেব্রুয়ারি। একুশে ফেব্রুয়ারির আগেই হয়েছিল। কেননা, আমরা নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ২১ তারিখেই করতে চাওয়ায় তিনি বলেছিলেন, ‘আমার একটা জরুরি কাজ আছে সেদিন। থাকতে পারব না।’
তাঁর কথা আমাদের মানতে হয়েছিল। ঢাকায় আমাদের তখন যে কয়টা পোক্ত ডেরা ছিল, এর মধ্যে চামেলীবাগ ছিল অন্যতম। কামরুল আর বদরুলদের বাসাকে ঘিরেই ১৯৬৭ সালের দিকে গড়ে উঠেছিল ‘চামেলীবাগ খেলাঘর আসর’। নেপথ্যের মূল উত্সাহদাতা ছিলেন ওদের বড় ভাই মঞ্জুরুল আহসান খান। সে পাড়াতেই থাকতেন ইত্তেফাকের নির্বাহী ও বার্তা সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেন। একবারই মাত্র গিয়েছিলাম তাঁর বাড়িতে কামরুল ও বদরুলের সঙ্গে, তাঁকে যে আমাদের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি করব, সে ব্যাপারে তাঁর সম্মতি আদায় করতে। দ্বিধা ও সংকোচ ছিল তাঁর। কিন্তু অনুষ্ঠানটির সঙ্গে যে তাঁর ছেলেরা সক্রিয়ভাবে জড়িত! তাই না করতে পারেননি।
আমাদের নাটকের রিহার্সাল চলছে ধুমসে। নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের চামেলীবাগের বাসার সামনের মাঠটিতে। অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী সংগীত ছিল, মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের, ‘আমার সোনার বাংলা’, পরবর্তীকালে যে গান আমাদের জাতীয় সংগীত হয়। এর পরই প্রধান অতিথির ভাষণ। তিনি তাঁর ভাষণে বড় সুন্দর করে গুছিয়ে বলেছিলেন যত দূর মনে পড়ে, ঠিক এই কথাগুলো—‘উপস্থিত অভ্যাগত-অতিথিবৃন্দ, আমাদের পাড়ার মা-খালারা এবং আমার প্রাণপ্রিয় ছেলেমেয়েরা, যে মাঠে এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে, সে মাঠ আমার বুকের মতো। সেই বুকেই হচ্ছে এই অনুষ্ঠান।’ এ রকম আরও কিছু বলেছিলেন। তবে মনে পড়ে, চলমান রাজনীতি-সম্পৃক্ত একটি কথাও তিনি সেদিন বলেননি। অথচ ভয়ানকভাবে রাজনীতিমনস্ক মানুষ। তার প্রমাণ আগেও পেয়েছি। পরেও পাব।
নাটকের দুই পালোয়ান চরিত্রের একটি যখন ভুল করে বলে, ‘আমাকে দেখলে বাঘের শীতে মাঘও গিয়ে পুকুরের তলায় লুকায়।’ তখন তাঁর সে কী প্রাণখোলা হাসি! অথচ সংলাপটি ছিল, ‘আমাকে দেখলে মাঘের শীতে বাঘও গিয়ে পুকুরের তলায় লুকোয়।’
পরের দিন বিকেলের দিকে অনুষ্ঠানের বিবরণসংবলিত প্রেস রিলিজ নিয়ে আমি আর মোস্তফা ওয়াহিদ খান চলে যাই ইত্তেফাক-এ। হাজির হই তাঁর দরবারে। আমি প্রেস রিলিজটা তুলে দিতেই বলেছিলেন, ‘নাটকের উপস্থাপনা এবং বক্তব্যটা খুবই ভালো লেগেছে! লিখেছেন কে?’ আমি যে লিখেছি, সেটা নিজের মুখে বলতে পারিনি। ওয়াহিদ আমাকে দেখিয়ে বলে, ‘ইনি’।
আমাকে আর কথা বলতে দেননি। মুখের দিকে ভালো করে তাকিয়ে বলেন, ‘এর আগে আপনার সঙ্গে আমার কোথাও কি দেখা হয়েছিল?’
বলি, ‘জি, হয়েছিল ১৯৬৩ সালের জানুয়ারি মাসে।’
‘কোথায় বলুন তো?’
‘আপনার এই অফিসেই। আমি এসেছিলাম রাম সাইদ ভাইয়ের সঙ্গে।’
‘আরে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই তো। রামপাঁঠাটা এখন কোথায়?’
‘সিরাজ সিকদারের দল করেন। কালেভদ্রে দেখা হয়।’
‘অথচ ও ভয়ানক সাহসী, অন্য রকমের মানুষ ছিল। সাত দিন সাত রাত তাঁকে কেন্দ্রীয় কারাগারে জেরা করেছিলেন সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা। ভয়ানক নির্যাতন চালিয়ে তাঁর মুখ থেকে একটি কথাও বের করতে পারেননি তাঁঁরা।’
কে এই রাম সাইদ? ষাটের দশকের বামপন্থী মহলে বেশ পরিচিত ছিল তাঁর নাম। সাংবাদিক শিশুসাহিত্যিক ফয়েজ আহমেদ এবং সাংবাদিক নির্মল সেনের কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধের মাধ্যমে তাঁর পরিচয় তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। সাইদের আসল নাম আর এ এম সাইদ। তার থেকে রাম সাইদ। বাইরে থেকে তিনি ছিলেন তখনকার ন্যাপের সমর্থক।
সিরাজুদ্দীন হোসেন আমার হাত থেকে প্রেস রিলিজটি নিতেই আমি বলি, ‘আমি সেবার আপনার হাতে একটা ছোটগল্প দিয়েছিলাম।’
‘হ্যাঁ, মনে আছে। আপনি লিখবেন।’ তাঁর হাত ঘুরে আমার জীবনের প্রথম ছোটগল্প ছাপা হয়েছিল ইত্তেফাক-এর সাহিত্য পাতায়। তারপর একটু থেমেই বলেছিলেন, ‘সাইদের সঙ্গে যদি দেখা হয়, বলবেন আমার সঙ্গে দেখা করতে।’
‘বলব।’
এ এম সাইদ আজ বিস্মৃত একটি নাম। অথচ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৩ সালে যে ১০-১১ জন সঙ্গীসহচরসহ আগারতলায় গিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন তাঁদের একজন। যাওয়ার আগে গফরগাঁও থেকে ঢাকায় এসে দেখা করেছিলেন অনেকের সঙ্গে। সিরাজুদ্দীন হোসেনও ছিলেন। তিনি জানতেন, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে স্বাধীন করার মিশনে ভারতে যাচ্ছেন। জানতেন আহমেদুর রহমানও। না হলে, ১৯৬৩ সালে যেদিন সাইদ ভাই সিরাজুদ্দীন হোসেনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন, সেদিন আমাকে একটু বাইরে যেতে বলে তাঁরা তিনজন—সিরাজুদ্দীন হোসেন, আহমেদুর রহমান ও সাইদ ভাই কী শলাপরামর্শ করেছিলেন নিজেদের মধ্যে?
সিরাজুদ্দীন হোসেনকে বাইরে থেকে দেখলে মনে হতো সাদাসিধা, কারও সাতে-পাঁচে নেই। কিন্তু এ দেশের মুক্তি ও স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিটি পর্বের সঙ্গে নেপথ্য থেকে ছিল তাঁর গভীর সংযোগ সূত্র। ‘মঞ্চে নেপথ্যে’ থেকে কলাম লিখেই কেবল ক্ষান্তি দেননি।
এখনো মাঝেমধ্যে যাওয়া পড়ে চামেলীবাগে। গেলেই তাকাই সেই জায়গাটির দিকে, যেখানে সপরিবারে তিনি থাকতেন। সে বাসা থেকে জল্লাদরা আজকের এই দিনে ধরে নিয়ে গিয়েছিল মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম এই রূপকারকে। সেই মাঠজুড়ে গড়ে উঠেছে পাকা বাড়ি, যে মাঠে আমরা ঊনসত্তরে নাটক মঞ্চস্থ করেছিলাম। করেছিলাম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যার প্রধান অতিথি ছিলেন তিনি। তাঁর ভাষণে তিনি যে বলেছিলেন, ‘আমার বুকেই হচ্ছে এই অনুষ্ঠান।’ চামেলীবাগে গেলে, ওই জায়গাটির দিকে তাকালে আমাকে উদ্বেল করে তুলতে তুলতে বেজে চলে তাঁর বলা এই কথাটা।

No comments

Powered by Blogger.